গল্প 

অ সু খ
দেবারতি রায়
অঙ্কন: ঋজু

কাজলটা চোখে লাগাতে গিয়ে খানিক ইতস্তত করলো প্রেরণা, কি জানি কেমন লাগবে! কানের একটা ঝুমকো একবার গালের পাশে ঠেকিয়ে দেখলো ঠিক লাগছে কিনা; হাসপাতাল থেকে বাড়ি আসার পর এই প্রথম সে নতুন করে সাজবে, কাজে যাবে। গাঢ় নীল রঙের চুড়িদারের সাথে ঝুমকো দুল আর কাজল ; চুল আর আগের মতো নেই একেবারেই, নাহ্! আফসোস হয়না। অনেকের কাছে শুনছে, চুল পড়ার সমস্যাটা আজকাল খুব স্বাভাবিক হয়ে গেছে।

আলুপরোটা আর স্যালাড খেলো জলখাবারে, মা - ই খাইয়ে দিলো ; মুখ খুলতে, চিবোতে বেশ কষ্ট হচ্ছে প্রেরণার। কামিজের পাশ দিয়ে ঘাড়ের কাছে উঁকি মারা ব্রা-র স্ট্রিপটা ঠিক করে ভিতরে ঢুকিয়ে নিলো। বিধবা মাকে প্রণাম করে বেরোলো অফিসের জন্য। অফিসে ঢুকেই দেখলো, বস, কলিগরা সবাই হুমড়ি খেয়ে পড়ছে ওর ওপর, প্রায় প্রত্যেকের হাতেই ফুলের তোড়া। কেউ কেউ ওকে জড়িয়ে ধরে সেল্ফি তুললো। স্পেশাল টিফিন, কেকের ব্যবস্থাও করা হয়েছে। আড়চোখে প্রেরণা দেখলো নির্লিপ্ত প্রতীক করিডোরে দাঁড়িয়ে সিগারেট টানছে। প্রেরণাকে ঘিরে মাতামাতিতে ওর কোনও ইন্টারেস্টই নেই আর থাকবেই বা কেন! আহত ইগো যে সম্পর্ক ব্যাহত করতেই শিখেছে বরাবর। এবার একটু অস্বস্তি লাগতে শুরু করলো ওর। যাইহোক, কেক খাওয়া হলে সবাই যে যার কাজে গেলো। প্রেরণা প্রতীকের ডেস্কে গিয়ে জিজ্ঞেস করলো কি হয়েছে ওর। প্রতীক ওর মুখের দিকে না তাকিয়েই উত্তর দিলো, কিছু না। এতদিন বাদে অফিস গিয়েও কেমন আধমরা হয়ে ঘরে ফিরল বিকেলে ।

মোবাইলের কীপ্যাডে বারবার হাত চলে যাচ্ছিল ওর। মানসিক যুদ্ধরত প্রেরণা আজকাল খানিক অস্থিরচিত্তেই থাকে, তবু মনের জোরই সম্বল। বেশ খানিকক্ষণ দ্বন্দ্বে দুলে শেষে প্রতীককে ফোন করেই ফেললো। ওপার থেকে হতাশা মেশানো গম্ভীর গলা ~
- হ্যালো।
- আমি, আমি রেণু, প্রতীক!
ময়দানে বসে প্রতীকেরই দেওয়া নামটা।
- বলো, কিছু বলবে?
- না, মানে কি হয়েছে তোমার? এতো মনমরা কেন?
- তোমার সাথে কথা আছে কিছু, কাল অফিসের পর অপেক্ষা কোরো।
- ঠিক আছে বলে ফোন কেটে দিলো প্রেরণা, কেমন একটা চমকানো ভয়মিশ্রিত আনন্দ ঘিরে ধরলো ওকে!

পরের দিন অফিস ফিরতি পথে প্রতীককে জিজ্ঞেস করলো প্রেরণা,
- তুমি কি এখনও রেগে আছো আমার ওপর?
- নাহ্, আমাদের বিয়েটা ক্যানসেলড্ প্রেরণা! তোমার বাড়িতে বলে দিও।
বিগত আড়াই বছরে এই প্রথম প্রেরণা বলে ডাকল সে, অনেকটা দূর থেকে ডাকটা এলো মনে হলো।
- মানে!!
- মানে একটাই, সেদিন যদি আমার কথাটা শুনতে তাহলে আজ এ অবস্থা দেখতে হতো না কাউকেই!

প্রেরণা প্রতীকের ইঙ্গিত বুঝতে পেরে আর কথা খরচ না করে অটো ধরতে এগিয়ে গেলো। প্রতীক পকেট থেকে সিগারেট বের করে টানতে লাগলো, ইদানীং নিকোটিনে বড্ড বেশি পুড়ছে প্রতীক।

মা বেশ কয়েকবার ডেকে গেলেও রাতে কিছু খেলোনা প্রেরণা। অন্ধকার ঘরে শুধু নাইট বাল্ব জ্বলছে। আজ খানিক শীতশীত করছে, ফ্যান বন্ধ করে চাদর গায়ে দিলো ও। সত্যিই কি সেদিন প্রতীকের কথা শুনলে এমনটা হতো না? মা পাশের ঘরে কি করছে কে জানে! কদিন ধরে মায়ের কাশিটাও বেশ বেড়েছে। ডাক্তার দেখাতে বললেই মায়ের ওই এক রা!
' তোর বিয়েটা দিতে পারলেই সব ঠিক হয়ে যাবে '!

প্রতীক যে বিয়ে করবে না বলেছে সেটা কিভাবে বলবে মা'কে! একরাশ চিন্তায় ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়লো প্রেরণা।
আজ বিকেলে পাঁচটা নাগাদ চেক আপ আছে ওর।
অফিসে দু একবার চোখাচোখি হলেও কোনও কথা হয়নি প্রতীকের সাথে।
অফিস থেকেই সোজা হাসপাতালে পৌঁছালো প্রেরণা, প্রেসক্রিপশন, রিপোর্ট আগে থেকেই ঢুকিয়ে রেখেছিলো ব্যাগে।
টোকেন নম্বরে ডাকলে ডাক্তারের রুমে ঢোকে ও।
- নমস্কার। বসুন। আমি ডঃ অর্ক সিনহা। আমিই আপনার সার্জারি করেছিলাম।
- নমস্কার। না, আসলে আমি তখন বুঝতে পারিনি, যা অবস্থায় ছিলাম!
- নো ইস্যু! এখন কেমন আছেন? চামড়ায় টান ধরছে? অন্য কোনো অসুবিধা?
ডাক্তারবাবুর দেওয়া নতুন ওষুধগুলো কিনে ঘর ঢুকলো প্রেরণা, কাশতে কাশতে দরজা খুলল ওর মা।
রাতে খেতে খেতে মা বিয়ের কথা তোলায় প্রেরণা খানিক ইতস্তত করছিলো, শেষে বিদ্ধস্ত মন মুখ খুলেই ফেললো ; জানালো যে প্রতীক অন্য কোম্পানিতে জয়েন করেছে আর ওদের বিয়েটা হয়তো হবে না।
ঘুমের ওষুধ খেতে হবে বলে ওর মা বাকি ভাতটা চুপচাপ খেয়ে এঁটো বাসনগুলো সিন্কে রেখে দিলো। রাতটা কেমন যেনো বার্ষিক গতিতে পেরিয়েছিলো সেদিন।

একটা নতুন সকাল, স্নান করে তুলসী তলায় জল দিয়ে মায়ের মৃত্যুবার্ষিকীর জোগাড় করতে লাগলো প্রেরণা। তিন বছর হল মা নেই আর। মেয়ের বিয়ে দেখার শখ মিটিয়ে যেতে পারেনি অবশ্য। অর্কর ফোনটা ক্রমাগত বাজছে, কাল অনেক রাতে ফিরেছে বেচারা, তবু কাছে গিয়ে কপালে, চুলে আলতো হাত বুলিয়ে ওঠালো অর্ককে। ফোনটা রিসিভ করেই প্রেরণাকে তোয়ালে, শার্ট বের করে রাখতে বললো অর্ক , হাসপাতাল যেতে হবে, এমারজেন্সি। মুখে কিছু না বললেও প্রেরণা যে কষ্ট পেয়েছে সেটা বুঝলো অর্ক ; জড়িয়ে ধরে তাড়াতাড়ি ফিরে আসার কথা বললো। বেশ তাড়াহুড়ো করেই বেরিয়ে গেলো অর্ক।
প্রেরণার মায়ের মৃত্যুবার্ষিকীর পুজো হলো, অফিসে ছুটি নিয়েছে আজ ও।
একি! তাড়াহুড়োতে অর্ক না টিফিন নিয়ে গেছে না ওয়ালেট! ঘরের গাড়ি তো ফিরে চলে এসেছে! ওর ও কিছু কেনাকাটা করার আছে, গাড়ি নিয়ে যেতে হবে। এইসব সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে ঠিক করলো বাজারে যাওয়ার পথেই তো হাসপাতাল, তখনই বরং পৌঁছে দেবে জিনিসগুলো। তৈরী হয়ে বেরোলো প্রেরণা। একটা কলাপাতি রঙের শাড়ী পড়েছে, চোখে সানগ্লাস। হাসপাতালে নেমে আউটডোর পেরিয়ে মূল বিল্ডিং এর দিকে এগোলো। ডঃ অর্ক সিনহার স্ত্রী বলে হাসপাতালে মোটামুটি সবাই চেনে ওকে। লিফটে করে দোতলায় উঠে নক্ করে অর্কর রুমে ঢুকলো। ঢুকেই দেখলো একটা বেশ কমবয়সী মেয়ে কেঁদে কেঁদে চোখ মুখ ফুলিয়ে ফেলেছে, তখনও কাঁদছে!

যাইহোক, ওই অবস্থায় কিছু বলা ঠিক হবে না ভেবে অর্ক কে টিফিন আর ওয়ালেট টা দিয়ে বেরিয়ে এলো হাসপাতাল থেকে।

রাতে শোয়ার আগে প্রতিদিনের মতো মুখে, হাতে ওষুধ লাগাচ্ছিল প্রেরণা যদিও আগের চেয়ে এখন অনেক ভালো আছে ও । অর্ক শিলিংয়ের দিকে নিষ্পলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে।
- কি হয়েছে তোমার? এত অন্যমনস্ক যে? প্রেরণা জিজ্ঞেস করলো।
- যে মহিলাটিকে দেখলে আজ, ওর নাম সৌমি, সৌমি সরকার। ভদ্রমহিলা হোম-মেকার। হাজব্যান্ড একটা মাল্টি ন্যাশনাল কোম্পানিতে চাকরি করে। কিছু দুষ্কৃতী অন্য একটি মেয়েকে টার্গেট করেছিলো বলে মনে হচ্ছে, ভদ্রলোক বেকায়দায় সামনে এসে পড়েন, ফলে অ্যাসিডটা ওর মুখেই লাগে, একটা চোখ একেবারেই গেছে! লাইটটা অফ করে দাও তো, আর টানছে না শরীর।
চুলের মধ্যে দিয়ে চিরুনি আর নামছে না প্রেরণার। কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করলো অর্ক কে, লোকটির কি নাম?
- অর্ক ঘুম জড়ানো গলায় বলল, পি দিয়ে, মনে হয় প্রতীক.. সারাদিনে কত রোগী আসে!
- তুমি নিশ্চিত ওর নাম প্রতীক? অর্ক?
অর্ক সারাদিনের পরিশ্রমে নেতিয়ে গেছে তখন!
পি দিয়ে কত নাম হয় এই পৃথিবীতে! আর প্রতীক হলেই বা, এ যে তারই অতীত চিহ্ন তারও কোনো মানে নেই! ফিনফিনে সাদা পর্দাটা সরিয়ে দাঁড়ালো জানলার পাশে। কেমন শিরশিরে হাওয়া দিচ্ছে আজ। কে জানে মেয়েটি এখনও কাঁদছে কিনা, খেয়েছে কিনা!

এই দিনটা আমার পাওনা ছিল বোধহয়, প্রেরণা সেদিন বস্তির বাচ্চা মেয়েটাকে বাঁচাতে গিয়ে এই একই ভাবে পুরস্কৃত হয়েছিল, বারণ করেছিলাম ওকে, শোনেনি, কিন্তু আমি! আজ অজান্তেই আমিও একজনকে অনৈতিক সমাজের একপেশে বিচার থেকে মুক্তি দিলাম! হাসপাতালের বেডে শুয়ে থাকা প্রতীকের চোখের নোনা জলের স্রোত মোছাতে পারেনি কেউ, ব্যান্ডেজটা শুষে নিলো কেবল।





আ কা শ টা কে ই  দা ও  উ ড়ি য়ে
  সুমনা  রায়

নস্বার্থে প্রচারিত করোনা সতর্কীকরণের ক্লান্ত আর অবসন্ন ব্যানারটা গায়ে দিয়ে ফ্লাইওভারের নিচে জ্বর গায়ে নিয়ে শুয়ে আছে ছেলেটা।পরীক্ষাগার থেকে তার জীবন না মৃত্যু কোনটা বেশি কাছে সে জানে না…

হ ঠিক  দাঁড়াচ্ছে না।  রোহিত আবার মুছে ফেলে।একঘন্টা ধরে  চেষ্টা করেও গল্পটা এখনো শুরুই করতে পারছে না ।এখন নিজের ওপরই রাগ হচ্ছে। কথা দিয়ে খুব ভুল হয়েছে। কখনো এমন করেও না। সোজা বলে দেয় লেখা হলে জানাবো।এখনই কথা দিতে পারছি না। কর্পোরেটের ভাইস প্রেসিডেন্ট রোহিত সেনের ব্যস্ততা চরম হলেও লেখার হাতটা কিন্তু খুব ভালো।আজ দেশে তো কাল বিদেশে বিজনেস আর প্রফিটের এক্সেল শিট সামলানোর পরও একজন প্রতিষ্ঠিত গল্পকার এখন।

তবে মুশকিলটা হল রোহিত আর সবার  মতো করে ঋতুকে তো বলতেও পারে না গল্পের কথা। আর শুধু গল্প কেন! ঋতুর কোন কথাটাকেইবা ও না বলে  ঠেলে দিতে পারে!  কোনদিনই পারবে না।বরং মনে মনে অপেক্ষায় থাকে একবার যদি ঋতু আসে ওর কাছে!নিজে কিছু চেয়ে নিয়ে যায়!

সন্ধ্যা সাতটা। ঘড়িটাও যেন আজ পেরিয়ে যাচ্ছে সময় একটু বাড়তি তাড়াহুড়োয়। অন্তত বারোটার মধ্যে না পাঠালে কী করে রবিবাসরীয়তে বেরোবে! এখন অব্দি  দুটো রিমাইন্ডারও এসে গেছে। স্বনামধন্য গল্পকার রোহিত সেনের গল্প থাকছে এই রবিবাসরীয়তে-এইসব ভেবে যেন আরো হয়ে উঠছে না লেখা । যেমন তেমন গল্প তো ঋতুকে দিতেও পারবে না। এলোমেলো আঙ্গুল চলছে কিবোর্ডে। মাথায় এলোমেলো প্লট।যতটা লেখা তার থেকে বেশি হচ্ছে মোছা। যেমন ভেবেছিলো ঠিক চলেই এলো কলও।

— রোহিতদা গল্প কতদূর? কখন পাঠাচ্ছ? এই তাড়া দিচ্ছি ভেবে রাগ করোনা যেন প্লিজ!



— হয়নি রে! বসেছি কিন্তু কিছুই লেখা হচ্ছে না।

— তুমি বসলেই হয়ে গেলো...চাপ নেই। তোমার লেখায় তো আর কেউ এডিটও করতে যাবে না...এলেই সোজা চলে যাবে বিজনদার কাছে। আর তারপর বেরিয়ে যাবে প্রিন্টে। আমি বলে রেখেছি ওদের। জানো, অফিসে সবাই খূব খুশি তোমার গল্প আসবে জেনে। দেরি হলেও অসুবিধা নেই। আমি জেগেই আছি।দু’একটা কাজ নিয়ে বসেছি।হয়ে গেলে তুমি জানিও। 

— তুই এতো বলেছিস যদি কিছু না দাঁড়ায়! তখন আমাকে তো লোকে গালি দেবেই, তোকেও ছাড়বে না।

— ছাড়ো তো! রোহিত সেনের গল্প আবার দাঁড়াবে না! এইসময়ে কজন আছে এমন রোহিত সেন শুনি? আমাদের কাগজের সেল বেড়ে যাবে শুধু তোমার গল্পের জন্য এটা জানো! আর শোনো তুমি চাপ নিও না। সর‍্যি গো শনিবারের ছুটিতে তোমার রিলাক্স আর হল না। তবে শোনো যদি আজ  নাই হয়ে থাকে তাহলেও ভেবো না। তোমার একটা  পুরোনো গল্প আছে আমার কাছে। ওটা দিয়েই আজ চালিয়ে দেব। তবে তোমাকে কিন্তু লিখতেই হবে এক্সক্লুসিভলি  আমাদের কাগজের জন্য। আমি কিন্তু অফিসে সবাইকে বলে রেখেছি রোহিত সেনের গল্প এনে দেব।

ঋতুর এই একটা ব্যাপার। অন্যদের আত্মবিশ্বাস বাড়িয়ে দিতে  আর প্রশংসা করতে যেমন ওর জুড়ি নেই তেমনি আপ্রাণ চাইবে কারো যেন কোনো সমস্যা না হয়। অন্যদের বিপদে পাশে দাঁড়াতেও এতটুকু ভাবে না। অথচ আজ নিজে কী ভাবে বেঁচে আছে ক’জনই বা তার খবর রাখে! ‘সংবাদ শিরোনামে’ আর ওনাদেরই আরেকটি কাগজ ‘চলা অন্তহীন’এ কাজ করে। সামান্য আয়ের হলেও কাজগুলো খুব যত্ন নিয়েই করে। সঙ্গে আছে ছ’বছরের বাচ্চাটা আর  আছে বেশ কিছু টাকার লোন। অবশ্য তারপরও বাঁচিয়ে রেখেছে কিছু স্বপ্ন। বরের চিকিৎসার জন্য কত কী করলো মেয়েটা! তবু আর শেষরক্ষে হলো না। ইমতিয়াজ চলেই গেল।আর তারপর! কতজনই তো সাহায্যের হাত বাড়িয়েছে। কত যে লোভ দানা ছড়িয়েছে চারদিকে থেকে কিন্তু ওকে নড়াতে পারেনি। এইটুকু বয়স থেকেই এতো আত্মসম্মানবোধ! বয়সে ছোট হলেও খুব শ্রদ্ধা করতে হয়। 

আবার একটা কল। সময়ের কথা ভেবে কলটা ধরার ইচ্ছে  না করলেও দেখে নিতে হয় যদি কোনো জরুরি কল হয়। সংকটকাল চলছে বলে আজকাল বিপদের কথাটাই বেশি মনে হয়। উঠে এসে চার্জার থেকে বের করে মোবাইলটা।

— এই শুনেছিস ক্যাফে স্বপ্নঘুড়ি নাকি বন্ধ হয়ে যাচ্ছে?

— কী বলছো অনিদা! ঋতুর সাথে কতবারই তো কথা হলো! কই একবারও তো বললো না!

— আফতাব ভাই বললেন এখন। ঋতু আফতাব ভাইকে ফোন করে বলেছে ও বন্ধ করে দিতে চায়। দু’মাসের মধ্যেই সব বই আর ফার্নিচার সরিয়ে খালি করে দেবে।ও আর চালাতে পারছে না। আর কবে লকডাউন উঠবে আর কবে পরিস্থিতি পুরো ঠিক হবে সবটাই তো অনিশ্চিত। পরে কখনও আবার ভেবে দেখবে।

— এটা শুধুমাত্র একটা ক্যাফেই নয় অনিদা! ওর স্বপ্ন – ওর ভালোবাসা। আমরা কত যাই ওখানে! সাহিত্য আড্ডায়।কখনও শুধু কফির আড্ডায়।এখান থেকে ওখান থেকে কত ভালো ভালো বই ও সংগ্রহ করেছিল। কত খাটতো এই ক্যাফের জন্যে। কোথা থেকে কোথায় চলে যেত বইয়ের জন্যে! ভালো বই সংগ্রহে এলে ফোন করে বলতো নিজের খুশিগুলো।

— আমি জানি তো। শোন তুই একবার কথা বল। তোকে ও খুব ভালবাসে। শ্রদ্ধা করে। একবার বলে দেখ। দেখি আমরা সবাই মিলে এটা আটকাতে পারি কি না। জানিস আমি কিছু বলার আগে আফতাব ভাই  নিজেই বললেন ভাড়া কম করে দেবেন। দরকার হলে তিন মাসের ভাড়া নেবেনই না। তবু বন্ধ না করতে।

— অনিদা এটা ঋতু। তুমি তো জানোই ও কেমন। কেমন টানটান আত্মসম্মান। কতবার কতকিছু নিয়েই তো বললাম।ও কী শোনে! না খেয়ে থাকবে তবু কারো সাহায্য নেবে না।   

— তবু একবার কথা বল। আমিও বলব। আমিও দেখছি আরও অন্যদের সাথে কথা বলে।

মনটা খারাপ হয়ে গেলো। অনিরুদ্ধের ফোনটা রাখার পরই রোহিত কেমন যেন হয়ে গেলো। ল্যাপটপে আর মন নেই। কাগজের গল্প থেকে জীবনের গল্প অনেক বেশি ভাবিয়ে তোলে - তোলপাড় করে দেয়।

আজকে যে গল্পটা ওকে লিখতেই হবে, আর ও লিখবেই তারজন্যে শক্তভাবে প্রস্তুত হয়। এবার আর কোন কথা শুনবে না। বয়ে চলা গল্পটাকে এবার অন্যরকম করে তুলতেই হবে। মনকে কিছুটা তৈরি করে নেয় মিনিট দশে। তারপর অনেক সাহস করে মোবাইলটা নেয় হাতে…

— হ্যালো…

— হ্যালো গল্পকার! গল্প হয়ে গেল?

— তুই কী রে! আমাকে একবার বলারও দরকার মনে করলি না? 

— কী বলছ? কোন কথা? খুলে বলোনা! কিছুই বুঝতে পারছি না তো!

— তুই খুলে বলেছিস? তুই বুঝতেও পারছিস না কোন কথা? আমি এতটাই পর হয়ে গেলাম ঋতু?

— তুমি কী সব বলছ রোহিতদা? আগে বলো গল্পটা হল?

— কাগজের গল্প নিয়ে তো অনেক কথা বলিস! কই জীবনের গল্প নিয়ে এতটুকুও বলিস না তো! তুই  স্বপ্নঘুড়ি বন্ধ করে দিচ্ছিস আমার সাথে একবারও কথা না বলেই! আমাকে কথাটা জানতে হল অন্যদের কাছ থেকে?

— আরে তোমাকে তো বলতামই। আজই তো জানিয়েছি আফতাব ভাইকে। আজ তুমি নতুন গল্প লিখছ তাই আর এসব বলতে চাইনি। দু’মাস সময় আছে হাতে। জানো আফতাব ভাই খুব সুন্দর করে কথা বলেছেন। এইসময়ে কত জায়গায় শুনছি বাড়িমালিকেরা ভাড়া নিয়ে খুব বাজে ব্যবহার করছেন। সত্যি ওনার তুলনা হয় না। তুমি খুব ভালো জায়গায় ভালো সময়ে যোগাযোগ করিয়ে দিয়েছিলে।

— সব সিদ্ধান্ত নেবার পর জানিয়ে কী লাভ! শোন ওটা এখন কিছুদিন তো বন্ধ থাকছেই কিন্তু বন্ধ করে দেওয়া যাবে না কিছুতেই। তোকে কিছু ভাবতে হবে না। আমাদেরও একটু ভাবতে দে! আচ্ছা ঋতু জীবনের একটা ভুলের শাস্তি আমাকে কতবার দিবি? ক্ষমা করে দিতে পারবি না কোনদিন?

— আরে রোহিতদা তুমি কী সব বলে যাচ্ছ! আমি যে তোমার ওপর কতটা ভরসা করি আর সারাটা জীবন তুমি যে আমার কত বড় সাপোর্ট হয়ে আছো তুমি কি তা বোঝো না! তুমি আমার সাহস। মনে আছে তুমিই গেল পুজোসংখ্যায় লিখেছিলে – ‘জীরে-হলুদ-চাল-ডাল-স্কচব্রাইট-গ্যাস বিল আর ইলেক্ট্রিক বিলের বাইরেও কিছু সম্পর্ক থেকে যায় ... থেকে যায় একসাথে  কিছু বেঁচে থাকা... থেকে যায় কাছে থেকেও একটুখানি দূরে থাকা!’ সবই কি সুতোয় বাঁধা যায় রোহিতদা! বলো! আর স্বপ্নঘুড়ি নিয়ে এতো ভাবছ কেন! কেন এত মন খারাপ করছ! সব ঠিক হয়ে গেলে আবার নতুন কিছু ভাবা যাবে। আমরা একসাথে আবার নাহয় একটা নতুন স্বপ্ন উড়াবো।

তোমার মনে আছে তুমি যে বলেছিলে আমার কবিতার একটা লাইন তোমার খুব প্রিয়! ওটা আসলে আমার বিশ্বাস। আমার মনের কথা…

‘স্বপ্নঘুড়ির লাটাই ছিঁড়ে গেলে তুমি আকাশটাকেই দাও উড়িয়ে!’ 

রোহিত আর কোনও কথা বলতে পারে না। জানালার কাছে এসে দাঁড়ায়। বাইরে তখন মেঘের ঘন কারসাজি। কিছুক্ষণের মধ্যেই আকাশ থেকে নামবে পাটভাঙা বৃষ্টি। আর ভেজা পাতাগুলো থেকে গড়িয়ে পড়বে আলো। মেঘলা বাতাসে ভাসে প্রতিধ্বনি ‘স্বপ্নঘুড়ির লাটাই ছিঁড়ে গেলে তুমি আকাশটাকেই দাও উড়িয়ে…’





ঋ ণ                       
ঋভু চট্টোপাধ্যায়

বাজারটা পার হতেই পিছন থেকে ‘শুনুন’ শুনে থমকে দাঁড়াল সৌমক।ঘাড় ঘোরাতেই দেখল ওরই বয়সি একটা মেয়ে থ্রি-কোয়ার্টার প্যান্ট আর শার্ট পরে দাঁড়িয়ে আছে।সৌমক চেষ্টা করেও পূর্ব পরিচিত কিনা মনে করতে না পেরে কিছুটা ইতস্ততের সুরে জিজ্ঞেস করল, ‘আমায় বলছেন?’
–হ্যাঁ।আপনি আজকে নিয়ে দুবার আমাদের বাড়িতে এলেন। আগের দিনও ব্যালকোনিতে দাঁড়িয়ে সব লক্ষ করেছিলাম।আপনার সাথে মায়ের কিছু একটা বিয়য়ে কথা হল।শুনতে পাইনি, আজও চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু হল না।আপনি চলে আসার পরেই মা সোফাতে বসে পড়েছিল।আমি পিছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে আপনার পিছু নিলাম।কি ব্যাপার বলুন তো আপনার সাথে আমার মায়ের ঠিক কি সম্পর্ক?
সৌমক এত ক্ষণ মেয়েটির মুখে এক সাথে কথাগুলো শুনে গেল। মেয়েটি থেমে গেলেও কথাগুলো কানে ঢঙঢঙ করে বাজছিল।ওর দিকে তাকিয়েই দাঁড়িয়ে রইল।
মেয়েটি কিছু সময় কোন উত্তর না পেয়ে বলে উঠল, ‘কি হল বলুন, এমনি ভাবে ক্যাবলার মত দাঁড়িয়ে রয়েছেন যে মায়ের সাথে তো বেশ বকছিলেন।’
-আপনার মা আমাকে পুলিশে দেবেন বলেছেন, আমি আর আসব না, কি হবে সব শুনে, আসি।
-দাঁড়ান।পিছন পিছন দৌড়ে দৌড়ে মজা মারাতে আসিনি।আপনি দিন দশ আগে যখন এসেছিলেন….
-তেরো দিন আগে।
-যাইহোক, মা তারপর থেকে খুব অন্যমনস্ক হয়ে গেছে।আজকে তো দেখলাম বসেই পড়েছে।কি ব্যাপার বলুন, না হলে এই বাজারে জোর চেল্লাব, কেলিয়ে আপনার আঠা বের করে দেবে।
–তাতে যদি আপনি শান্তি পান করতে পারেন, তবে দুপুর বেলা তো লোকজন সেরকম নেই, আমি আসি।
সৌমক এক পা এগোতেই মেয়েটি সৌমকের সামনে এসে বলে উঠল,‘দেখুন আপনার সাথে যদি আমার মা না জড়িয়ে থাকত আমি কিছুই জিজ্ঞেস করতাম না,কিন্তু এখন আপনার থেকে সব কিছু না শুনে যাবো না, প্লিস বলুন না।’
সৌমক একটা ছোট্ট শ্বাস ছাড়ল, ‘এখানে দাঁড়িয়ে বলব? মানে অনেক সময় লাগবে তো।’
–আমরা একটু এগিয়ে গিয়ে বসতে পারি।একটা স্কুল আছে, আজ তো রবিবার, ফাঁকা থাকবে।
–কোন অসুবিধা হবে না?
-আমি তো আছি।
কি কষ্ট করে যে ঠিকানা জোগাড় করেছে তা একা সৌমকই জানে।বাবা মারা যাওয়ার ঠিক দুদিন পরে আলমারি থেকে পাওয়া একটা ডায়রির পাতা ওল্টানোর সময় একটা নামে চোখ দুটো আটকে যায়। চারদিকে লাল বর্ডার, মাঝে নীল কালিতে লেখা,‘রূপালি বোস কেড়ে নিল পরেশ সরকার, এখন কোতরং।’
সৌমকের খুব মজা লাগল। বাবা এমন কবিতা লিখতে পারত? ক্লাস এইটে মা মারা যাওয়ার পরে অর্ধেক জিনিস ভুলে যেত।কোন রকমে অফিসটুকু করে বাড়ি ফিরে চেয়ারে বসে থাকা ছাড়া বাবা আর কোন কিছুতে  নিয়মিত ছিল কিনা মনে করতে পারল না।প্রতিদিন সকালে সৌমককেই রান্নার মাসিকে সব কিছু বলতে হত।এই নিয়ে ক্ষোভ থাকলেও জানাবার মত কেউ ছিল না।গড়িয়ে গড়িয়ে কলেজ পাশ করে সরকারি চাকরি পেলেও জয়েনিং করবার আগেই বাবা মারা গেল, রেখে গেল ব্যাঙ্কে কিছু টাকা, একটা একতলা বাড়ি আর আর এই ডায়রি।
সৌমক প্রথম পাতাটা উল্টিয়ে খুব অবাক হয়ে গেল।তাহলে মা ছাড়াও বাবার জীবনে কি কোন প্রেম ছিল?কিন্তু বাবার আচার আচরণের মধ্যে কোনদিন তো তা ধরা পড়ে নি।মায়ের সাথেও কোনদিন কোন রকেমর খারাপ ব্যবহার করেনি।সংসারের টুকটাক যা হয়, তাছাড়া সৌমকের আর কিছুই মনে পড়ল না। তাহলে এই ভদ্রমহিলা কে?
 এর পর ডায়রির পাতা উল্টিয়ে বাবার হাতের লেখা কয়েকটা কবিতার লাইন চোখে পড়ল, ‘তোমার নদী পার হব, আমার এমন নৌকা কই/চোখের সামনে রাত নামল তবু কষ্টে জেগে রই।’
পরের পাতাগুলোতে এরকম অনেক দু’লাইন দুলাইন করে লেখা।ডায়রিটার শেষে পাতাটাতে এই রকম দু’লাইন লেখার পরেও সৌমকের জন্য একটা চিঠি লেখা আছে।
‘বাবলু তোর কাছে একট আর্জি আছে, আমি মারা যাওয়ার পরে এই ডায়রিটা সামনে লেখা মহিলার ঠিকানাতে পৌঁছে দিয়ে আসবি, বলবি বাবার কবিতা আপনার সাথেই শেষ হয়ে গেছে, এগুলো সব আপনাকেই লেখা।’
এত মহা মুশকিল।চেনা জানা নেই জায়গাটার নামই কোন দিন শোনেনি, তারপর ঐ ভদ্রমহিলাকে কি বলা যাবে। হট করে বলে দেবে আমার বাবা আপনাকে এই প্রেমের চিঠি লিখেছে।একটা মারও মাটিতে পড়বে না।সৌমক পাতার নিচে বাবার সই, তারিখ সব দেখে হিসাব করল,‘তখন ওয়ানে পড়ে।’
নিজেকে খুব অসহায় লাগল।বাবা মারা যাওয়ার দিনেও এতটা অসহায় লাগেনি।পরের দিন অফিসের সুবীরদার কাছে কোতরং জায়গাটার হদিস পেল। হিন্দ মোটর অন্য একটা নাম কোতরং।সুবীরদার আসল বাড়ি উত্তরপাড়ায়। একটা রবিবার দেখে সৌমক সকাল সাড়ে নটার মধ্যে হিন্দ মোটর স্টেশনে নামল।বাজার দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে যাকে পারল জিজ্ঞেস করল।সবার একই কথা,‘জায়গাটাকি ছোট, ঠিকানা না থাকলে শুধু নামে কি আর বলা যাবে?’
সারাদিন টিফিনও খায়নি।মা-বাবা চলে যাওয়ার পর এখন আর খাওয়ার ব্যাপারে জোর করে বলবার কেউ নেই। বসন্তের রোদ মাথায় হাঁটতে হাঁটতে একটা মিষ্টির দোকানে কিছু খেয়ে দোকানদারকে জিজ্ঞেস করল। দোকানদার বলতে না পারলেও একজন কাস্টমার একটা সূত্র দিল, ‘ডান দিকে তিনটে গলি পরে পরেশবাবু নামে একজন থাকেন, তবে সরকার কিনা বলতে পারব না।’ দরকার নেই পরেশকে পাওয়া গেছে, সরকারকেও পাওয়া যাবে। সৌমক ভালো করে ঠিকানটা বুঝে পরেশবাবুর বাড়িতে এল।কোন নেমপ্লেট চোখে পড়ল না।বেল বাজাতেই ভেতর থেকে বাসন ভাঙা গলা……..
-কে ?
সৌমক উত্তর না দিয়ে দাঁড়িয়ে রইল।
কিছু সময় পরে একজন মহিলা এলেন।জানা গেল বাড়ির মালিক পরেশ ভট্টাচার্য, সরকার নয়।
সৌমকের পরেশ সরকার নামে এ’পাড়ার কাউকে চেনেন কিনা প্রশ্ন করতেই উত্তর এল,‘সবাইকে চিনতেই হবে?’ আর কোন প্রশ্ন করবার সাহস হয় নি।তারপর আবার খোঁজ। ক্লাব, পার্টি অফিস খেলার মাঠ, বুড়োদের আড্ডা, বাদ গেল না কিছুই।আরো গোটা দুই পরেশ পেলেও সরকার পেল না।এবার বিরক্ত লাগল।পেটেও মোটা খাবার নেই, মনটাও স্থির থাকল না।বাড়ি আসতে ইচ্ছে করল।তার আগে একটা শেষ চেষ্টা।একটা কম বয়সিদের ঠেকের সামনে পরেশ সরকার নামটা শুনেই একজন বলে উঠল,‘আরে ঐ মালটাই বাবা, সেই ছোট ছোট প্যান্ট পরে বাজার আসে। স্কুলের সেই টাকলা স্যারটার সাথে লাইন মারে।’
-মালটার বাপের নাম পরেশ নাকি?
–কয়েকদিন আগে এসি নিল, এখানে দাঁড়িয়েই তো নাম ঠিকানা জিজ্ঞেস করছিল।
তারপরেই একজন সৌমককে ঠিকানাটা বলে দিল।এই বাড়িতে কিন্তু বাইরে নেমপ্লেট আছে।সৌমক দাঁড়িয়ে ভালো ভাবে দেখে পুরো ঠিকানাটা লিখে নিল।‘পরেস সরকার, আঠেরোর তিন, সজলচন্দ্র পথ, কোতরং, হুগলি।’ একটি ছেলে অবশ্য জিজ্ঞেস করেছে,‘দাদা, মেয়ের বিয়ের ব্যাপার?’ সৌমক হাল্কা হেসে উত্তর দিল, ‘না না, অন্য ব্যাপার।’ শেষের কথাগুলো বলেই সৌমক ঠিকানাটা আরো দুজনকে জিজ্ঞেস করে বাড়িটাতে পৌঁছাল।বেল বাজাতেই মাঝ বয়সি এক ভদ্রমহিলা বাইরে বের হয়ে জিজ্ঞেস করলেন,‘কাকে চান?’
–আপনি কি রূপালি বসু সরকার?
–হ্যাঁ।
-পরেশ সরকার?
-আমার হাসবেন্ড।আপনার বাবার বাড়ি আসানশোলে ছিল তো?
–হ্যাঁ। কিন্তু এভাবে প্রশ্ন করছেন কেন?
–আমি দেবাশিষ গাঙ্গুলির ছেলে।
কথাগুলো শুনে ভদ্রমহিলা প্রথমে কিছুটা চমকে উঠলেও তার কিছু সময় পরেই বলে উঠলেন, ‘কই আমি ঐ নামে কাউকে চিনি না।’
–উনি কিন্তু আপনাকে চিনতেন, একটা ডায়রি আছে, আপনাকে দিতে বলে গেছেন।
–বললাম যে ঐ নামে কাউকে চিনি না, চিনতামও না। আর ডায়রি কবিতা ওসব জানি না। আপনি চলে যান, ভবিষ্যতে আর আসবেন না, বিরক্ত করলে পুলিশ ডাকব।
শেষের কথাগুলো বলতে বলতেই বাড়ির দরজাটা শব্দ করে বন্ধ করে দিল।সৌমক কিছু সময় দাঁড়িয়ে মুচকি হেসে বাড়ির পথে পা বাড়াল। সেটা প্রথম দিন, তারপর আবার দ্বিতীয় দিনে এসেই এই ঘটনার মুখোমুখি।
মেয়েটা বসে বসে সব কথা শুনল।সৌমক চুপ করে যেতেই বলে উঠল,‘আমি ঐ ডায়রিটা একবার দেখতে পারি?’
-নিশ্চয়, দেখুন।
সৌমক ডায়ারিটা হাতে দিতেই মেয়েটি পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে একটা লেখা পড়তে লাগল,‘আজ আমার দেওয়াল ঘড়ি, রাতের ঘরে বন্ধ/ আমি এখন  আগের মতই দু’চোখ নিয়েও অন্ধ।’
-আপনার বাবা কি পোয়েম লিখতেন?
-জানিনা।
–মানে?
-মানে আমার বাবা কোন দিন সেই অর্থে সাহিত্য, শিল্প অনুরাগী ছিলেন না,অন্তত তেমনাটাই জানি।ইনফ্যাক্ট আমি কোনদিন গল্পের বইটইও পড়তে দেখিনি,পুজো সংখ্যা যা কিনত মা পড়ত, তাই এই কবিতাগুলো বাবারই লেখা কিনা আমি সে ব্যাপারেও নিশ্চিত নয়।
–হাতের লেখাটা?
-ওটা বাবার।
-একটা কথা বলব?
–বলুন।
-আপনি এই ডায়রিটা নিয়ে চলে যান।
-তারপর?
-তারপর আবার কি ফেলে দিন পুড়িয়ে দিন।
-ভেবেছিলাম, পারিনি। ক্লাস এইটে মা মারা যাওয়ার পরে বাবা তো সব কিছু ছিল।কোনদিন তো কিছুই বলেনি। অবহেলাও করে নি।এই ছোট্ট ইচ্ছেটা মেটাবো না?
-কিন্তু আপনার বাবার ইচ্ছে মেটানোর জন্য আমার মা, অথবা আমার পরিবারে যদি সমস্যা সৃষ্টি হয়?
সৌমক একটা শ্বাস ছেড়ে চুপ করে গেল।পাশে বসে থাকা মেয়েটা তখন আরেকটা লেখা পড়তে আরম্ভ করেছে,‘ভালোবাসলে ঠোঁট ফাটে, ফোস্কা পড়ে হাতে/ তবুও তো ভালোবাসা জাগে লড়াই বা সংঘাতে।’
পড়টা শেষ করে কিছু সময় চুপ থেকে বলে উঠলেন,‘ আসলে কি জানেন কিছু কিছু সময় উই সুড নট এক্সহিউম সাম ম্যাটার, স্পেশালি অফ আওয়ার পাস্ট, আনলেস ডিচ মে কাম টু আস।’
-আপনি সেই সিনেমাটা দেখেছেন, সেই যেখান একজন বিদেশিকে এয়ারপোর্টে কয়েকটা মাস বন্দি হয়ে থাকতে হয়, সেও কিন্তু বাবাকে দেওয়া কথা রাখতেই এসেছিল।এরপরও যদি আপনার মনে হয় এই ডায়রি আপনাদের সংসারে অশান্তি ডাকতে পারে তবে থাক।আমি ডায়ারিটা ফেলে দিচ্ছি।মনে মনে বাবাকে বলছি, ‘সরি।’ তারপরেই মেয়েটার হাত থেকে ডায়রি নিয়ে, ‘ঠিক আছে, আসি।আপনাকে ধন্যবাদ।আমার কথাগুলো এত সময় নিয়ে শুনলেন।’
সৌমক একপা এগোতেই মেয়েটা বলে উঠল, ‘কোথায় যাবেন?’
–বাড়ি।
-এখন বাড়িতে কে থাকেন?
-কেউ না। চাবি দিয়ে এসেছি।
-চলুন।
-কোথায়?
–মায়ের কাছে, ডায়ারিটা দেবেন না?
—কিন্তু....!.
রবিবারের দোকানের দরজায় দুপুর।
মেয়েটি সৌমকের দিকে তাকিয়ে বলে উঠল,‘কিন্তু নয়, অতএব।’