ধা রা বা হি ক
 ।। উপন্যাস ।। ২য় কিস্তি ।। 
অঙ্কন: ঋজু

ন র কে র  অ ন্ত রে
কৌশিক দে



চার


টিকবাবুর পাঞ্জাবিটা খুব পছন্দ হয়েছে। এই নিয়ে আজকে তিনবার পাঞ্জাবিটা পড়ে আয়নার সামনে সে দাঁড়িয়ে আছে। মালতি দেবী ঘরে ঢুকে বলল, ওমা , আবার পাঞ্জাবিটা পড়েছ ? এতবার পড়লে তো ইস্তিরি খারাপ হয়ে যাবে !

ফটিকবাবুর কোনো উত্তর নেই। মাঝেমাঝে আয়নার দিকে এক বিচিত্র হাসি দিচ্ছেন।

মালতি দেবী চা নিয়ে অসিতের ঘরে গেলেন। অসিত সবে উঠেছে। চা'এর কাপ এগিয়ে দিতে দিতে বললেন, তোকে একটা কথা বলব বলে ভাবছিলাম। কিন্তু ….

কথা শেষ হওয়ার আগেই অসিত বলল, বলো মামি। কি ব্যাপার ?

'আমার মনে হয় তোর মামার মাথাটা বিগড়েছে। কি সব যেন সব সময় বিড়বিড় করে। দিনে দশবার একি পাঞ্জাবি পড়ে ঘরের মধ্যে ঘুরে বেড়ায়। তুই একটু কথা বলে দেখতো।'

অসিত বলল, সে কি ! এসব আগে বলোনি কেন ?

'আমিই কি বুঝতে পেরেছি আগে, যে বলব ! এখন খবর পাচ্ছি পাঞ্জাবিটাও নাকি কার কাছ থেকে ধার দেনা করে বানিয়ে এনেছে। তুই একটু কথা বলে দেখ তো '

অসিত আর সময় নষ্ট না করে মামার ঘরে গেল। গিয়ে যা দেখলো তাতে তার চক্ষু চড়ক। ফটিকবাবু পাঞ্জাবি পড়ে ঘরের মধ্যে হনহন করে হেঁটে যাচ্ছেন। থামছেনা না। অসিত বলল, মামা। ফটিকবাবুর উত্তর নেই। শেষে অসিত গিয়ে তার হাঁটা থামিয়ে বলল, এসব কি শুরু করেছ তুমি ? ঘরের মধ্যে এভাবে হাঁটছো কেন ?

ফটিকবাবু চেঁচিয়ে বলে উঠল, তুই কে শালা আমায় প্রশ্ন করার? আমি হাঁটবো , হাগবো যা খুশি করবো।

'তুমি কার কাছ থেকে টাকা ধার করেছ ?'

'চোপ শালা। ফটিকচন্দ্রের টাকার অভাব। আকাশে তুড়ি মারলেই টাকা পরে আমার। শোন আজ কচি পাঠা নিয়ে আয় তো। ঘটঘট করে দু গ্লাস রক্ত খাবো। এবার থেকে আর জল খাব না। ' বলেই আবার মাথা নিচু করে হাঁটতে শুরু করলেন।

ছুটে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলো অসিত। অসহ্য ! অসহ্য এই জীবন তার কাছে। কাগজ বিক্রি করেও লোকটা কিছু টাকা আনছিল । এখন তো সেটাই বন্ধ হয়ে যাবে। এই অভাবের সংসার তার সামান্য কিছু টিউশনির টাকায় চলবে কি ভাবে! তাকে একটা কাজ জোগাড় করতেই হবে। যে ভাবেই হোক।

দেবেন্দ্রর কাছে গিয়ে লাভ নেই। মাছের গন্ধ এমনিতেই তার গা গুলিয়ে দেয়। একমাত্র অঞ্জনই তাকে উদ্ধার করতে পারে। প্রয়োজনে সে জুতোর সেলসম্যান হয়ে যাবে। না হলে কারখানায় কাজ করবে। কিছু একটা করতেই হবে তাকে। এবং খুব তাড়াতাড়ি।

পকেট থেকে ফোন বের করে সে অঞ্জনকে ফোন লাগলো।




কোলেমার্কেটের পিছন দিকে দোতলা বাড়ি অঞ্জনদের। বাড়িতে সকাল থেকে সন্ধে পর্যন্ত কিচিরমিচির। বাড়িতেই জুতোর গোডাউন। সারাদিন মাল আসছে , মাল যাচ্ছে। চেঁচামেচি , হুল্লোড় লেগেই আছে। তাই অঞ্জন বেলা দশটা পর্যন্ত ঘুমায়। ঘুম থেকে উঠে স্নান করে খেয়ে বেরিয়ে পরে । বেশির ভাগ সময়ই তার গন্তব্য হয় বই পাড়া। সন্ধে নাগাদ ফিরে আবার স্নান করে। আবার খায়। তারপর লিখতে বসে যখন বাড়ির সবাই ঘুমায়। সারারাত লেখে বা পড়ে।

কলকাতা ইউনিভার্সিটি থেকে বাংলায় এম . এ করে আর পড়েনি। কোথাও কাজ করে পেট চালানোর প্রশ্নই ওঠে না। বাবার অগাধ টাকা। মাস গেলে ঘরে বসে দশ হাজার টাকা হাত খরচ পায়। আর কি চাই ! সংসারের প্রতি তার কোনো নজর নেই। সংসারের কেউ তার প্রতিও তেমন নজর দেয় না। তার বাবা মা আর এক বোন। এরা সবাই নিজেদের নিয়েই ব্যাস্ত থাকে ।

অঞ্জনের কাছে যখন ফোনটা এলো তখন বেলা বারোটা বাজে। তার স্নান খাওয়া হয়ে গেছে। এবার তার বেরোবার পালা। এই সময় ফোন পেয়ে সে স্বভাবসিদ্ধ ভাবেই বিরক্ত হয়ে উঠলো। ফোন তোলার আগে দেখলো অসিত ফোন করছে। ফোনটা রিসিভ করেই বলল, ওই শালা , তোকে বলেছিনা সকালে ফোন করবি না।

ভাই , আমার বড় বিপদ। অথৈ জলে পড়েছি। তোর বাড়িতেই আসছি। একটা হেল্প করতেই হবে। না হলে সুইসাইড অনিবার্য।

ভ্যাটের কথা রাখ। বাড়িতে আসিস না। এক কাজ কর যদুবাবুর বাজারের পাশে সে পার্ক আছে সেখানে আয়। আধ ঘন্টার মধ্যে। আর তোর কিছু লেখা নিয়ে আসিস। আজ রাতে দেখে নেবো ভ্যাটের লেখার কোনো উন্নতি হলো কিনা তোর।




হো হো করে হেসে উঠল অঞ্জন। এমন হাসি সে আর থামতেই চায় না। নাক চোখ দিয়ে জল পড়তে লাগলো। মাঝে এমন অবস্থা হলো যে বিষম খেতে লাগলো। কোনো মতে হাসি থামিয়ে সে বলল, তুই করবি জুতোর কাজ ? তোর জাত যাবে না ? জানিস জুতোয় কত রকমের চামড়া থাকে ?

পাথরের মতন জবাব দিলো অসিত , কিছু তো একটা করতেই হবে ভাই।

তা বলে জুতোর কাজ ! অসিত চন্দ্র বর্মন জুতোর কাজ করবে ! যে কিনা আবার সখির কবিতা লিখে পৃষ্টা ভরায় ! তাও আবার আমার বাবার কাছে। তুই জানিস লোকটা এক নম্বরের চশমখোর । শালা মাইনে দেবে কিনা সন্দেহ ! কত লোক রোজ খিস্তিখেউর করে বাবাকে। সবার সাথে টাকা নিয়ে গন্ডগোল পাকিয়ে রেখেছে।

তাহলে উপায় !

উপায় আছে। শোন , একটি লোক আছে। লোকটাকে আমি চিনি। আমার কাছে লেখা পাঠায়। যা সব লেখে মনে হয় তার উপর বসে হাগি। কিন্তু কিছু করার নেই। এই লেবেলের লোককে হাতে রাখতে হয়। দু একটা লেখা আমি সুপারিশ করে ছাপিয়েও দিয়েছি। মালটা এখন খুশিতে ডগমগ হয়ে আছে আমার উপর। চল , তার কাছে যাই। ডালহৌসিতে অফিস। মালদার পার্টি। এখুনি চল।

এখন ?

ওই শালা , এখন না তো কখন ! আজকেই তোর একটা ব্যবস্থা করবো আমি । চল ।

টি বোর্ডের সামনের যে বিল্ডিংএর সামনে অঞ্জন এসে দাঁড়ালো সেখানে অসিত কিছুদিন আগেই ইন্টারভিউ দিয়ে গেছে। লিফটে ওঠার আগে সে বলল, লোকটার কি জাহাজের ব্যবসা ?

দাঁত মুখ খিচিয়ে অঞ্জন বলল, আমি কি জানি ? মালটার টাকা আছে , এটাই খবর ।

অসিতের অনুমান সত্যি হলো। এই সেই অফিস যেখানে সে ইন্টারভিউ দিয়েছিল। অঞ্জনকে সেকথা বলায় সে বলল, একবার ইন্টারভিউ দিলে কি আর দেওয়া যায় না ? ভার্জিনিটি নষ্ট হয়ে যায় নাকি ? এখানে বস , বলেই সে চলে গেল রোবটের মতন মেয়েটার কাছে। কি সব বলে ঢুকে গেল সেই লোকটার চেম্বারে। অঞ্জন পারে বটে ।


পাঁচ


আজ মনটা বেশ ফুরফুরে। অনেকটাই হালকা লাগছে। চাকরিটা যে এত সহজে হয়ে যাবে ভাবতেই পারেনি অসিত। সত্যি অঞ্জনের জবাব নেই। সে ঠিক করলো প্রথম মাসের মাইনে পেয়ে উত্তাল মদ গেলাবে অঞ্জনকে। এদিকে মনটাও কেমন যেন করছে। রিনাকে দেখতে ইচ্ছে করছে। একবার গেলেই হয় ওর বাড়ি। কাল তো যাওয়া হয়নি।

বেল দেওয়ার পর রিনাই দরজা খুলল। সামনে অসিতকে দেখে বলল, অসিত'দা , তুমি !

কাল আসা হয়নি তাই ভাবলাম আজ ঘুরে যাই। বাড়িতে কেউ নেই বুঝি , কেমন যেন চুপচাপ !

না, সবাই সিনেমা দেখতে গেছে। আমার বড় পিসি এসেছে বর্ধমান থেকে। তাকে নিয়েই গেছে। তুমি ভিতরে আসো।

ভিতরে যাওয়া উচিত কিনা অসিত বুঝতে পারলো না। কিন্তু এই সুযোগ হাত ছাড়াও করা যায় না। সে ভিতরে ঢুকে একটা সোফায় বসলো। রিনা বলল, একটু চা করে দিই।

চা পরে হবে তুমি একটু আমার সামনে বসো। তোমার সাথে কথা আছে।

রিনা মুখোমুখি একটা চেয়ারে বসলো। সে সাদা একটা ফ্রক পরে আছে। বুকের কাছে সুতোর কাজ। চুলটা এলোমেলো। এটাই বেশি ভালো লাগছে। মুখে কোনো মেকআপ নেই।তাতেই এত সুন্দর ! ঠিকঠাক পাশ করলে এই মেয়ে এখন উচ্চ মাধ্যমিক দেয়। সে এভাবে বাচ্চা সেজে থাকে কেন কে জানে ! বা হয়ত মেয়েরা বাচ্চা সেজে থাকতে চায় আজীবন। মানুষ কত বিচিত্র  !

অসিত বলল, তুমি আজকাল খুব চুপচাপ থাকো কেন ? আগে কত কথা বলতে। এখন বলো না কেন ?

রিনা বলল, বাবা বারণ করেছেন। বলেছেন , অসিতের সাথে বেশি গল্প করবি না।

আমার সাথে গল্প করতে তোমার ভালো লাগে ?

রিনা উত্তর দিলো না। মাথা নিচু করে দুই আঙুলে গিট পাকাতে লাগলো। অসিত বলল, আমার কবিতা তোমার ভালো লাগে ?

খুব। আমি সেই কবিতাটি যে কত বার পড়েছি। তুমি খুব ভালো লেখো অসিত'দা।

আচ্ছা আমি তোমায় আরও কিছু লেখা দেবো। পড়ো। রিনা , আমরা কি বাইরে কোথাও দেখা করতে পারি যেখানে আমরা অনেকক্ষণ গল্প করতে পারবো।

বাইরে ! বাইরে কোথায় ? আমি তো তেমন বাইরে কোথাও যাই না। তবে সোমবার বিকেলে আমি নাচের স্কুলে যাই। বিকেল পাঁচটায়। হরিমোহন স্ট্রিটে। ওই যে বৌবাজার ক্লাবের পিছনে।

আমি চিনি। তুমি কি চাও সোমবার আমরা দেখা করি ! তাহলে আমি চলে আসবো।

রিনা উত্তর দিল না। এই বয়সের মেয়েরা এই প্রশ্নের উত্তর দেয় না। বুঝে নিতে হয়। অসিত বুঝে নিলো।




অঞ্জন সেদিন ফেরার সময় প্রতিম ঘোষালের অনেক গল্প করছিল। ওর মুখে গল্প শুনতে বেশ লাগে। অঞ্জন বলছিল, জানিস মালটা এক নম্বরের মেয়েবাজ। বাড়িতে বউ আছে ছেলে আছে তাও শালা হোটেলে গিয়ে মেয়েদের সাথে ফূর্তি করে। কাঁচা টাকার ব্যবসা হলে যা হয়।

'তুই ওর লেখা গুলো ছাপাতে গেলি কেন ? এই তো ডায়লগ মারিস সাহিত্যের উঠানে নো কপ্রমাইজ।'

'তোর মাথায় গু ভরা। এই লেবেলের লোককে হাতে না রাখলে পত্রিকার দুর্দিনে কে দেখবে ! '

' ও , তারমানে বলতে চাস যে সব বড় পত্রিকাই এরকম কিছু বিটকেলকে হাতে রেখে দিয়েছে। ফর ফিউচার প্রসপেক্ট ?'

'একদম। আর শুধু সাহিত্য কেন সব ক্ষেত্রেই দেখবি  এরকম কিছু গু'খোর মানুষ ঢুকে আছে। শালা গুলো সব হারামির বাচ্চা। সে দিন আমায় বলে কি জানিস , বলে , অঞ্জনবাবু আজ মনটা খুব ভালো সকাল থেকে। আমি বললাম কেন দাদা, বলল, কাল রাতে একটা ধ্রুপদ কবিতা লিখেছি। ভাব এবার , ধ্রুপদ কবিতা। ওর কবিতায় আমি হাজার বার হাগি।'



ছয়


আজকে অসিতের জয়েনিং।

জাহাজ কোম্পানির ওয়েটিং রুমে সে বসে আছে। পরনে মোটামুটি ধরণের একটা জামা প্যান্ট। জুতোর সোলের চারিদিকে সেলাই করা। তবে সেটা ধরা যায় না হঠাৎ করে। জুতোর রঙের সাথে সেলাইয়ের সুতো প্রায় মিলে গেছে। অসিত ঠিক করল মাইনে পেয়ে প্রথম কাজ হলো একটা বাটার জুতো কেনা।

চোখের সামনে সেই মাছের মতন মেয়েটা। খুট খুট করে ফোন করে যাচ্ছে। আর রোবটের মতন কথা বলে যাচ্ছে। সকাল দশটায় অসিতের আসার কথা। সে সাড়ে নটায় চলে এসেছে। ঘড়িতে দশটা বাজতেই মেয়েটি বলল, আপনি ভিতরে যান। স্যার ডাকছেন।

অসিত বুঝে পেল না প্রতিম ঘোষাল কোন পথ দিয়ে তার চেম্বারে ঢুকলেন। সে তো এতক্ষন তার চেম্বারের সামনেই বসে আছে।

দরজা খুলে ভিতরে ঢুকে অসিত দেখলো প্রতিম বাবু চেয়ারে বসে , তার সামনে একটি লোক দাঁড়িয়ে। লোকটা বেঁটেখাটো। সাদা পাঞ্জাবি আর কালো প্যান্ট পরে। অসিতকে ঢুকতে দেখেই প্রতিমবাবু বললেন, হ্যাঁ, এই তো এসে গেছো। মুখার্জি আমি এর কথাই বলছিলাম। বসো অসিত।

প্রতিমবাবু সেই মুখার্জির দিকে হাত দেখিয়ে বললেন, ইনি হলেন প্রভাকর মুখার্জি। খুব কাজের লোক। গত পনেরো বছর এখানে কাজ করছেন। আমরা সবাই এনাকে ম্যানেজার বলে ডাকি। তুমি কি ডাকবে তোমার ব্যাপার। যাইহোক, তুমি করে বলছি বলে কিছু মনে করো না।

অসিত সামান্য হেসে বলল, না না তা কেন।

' যাক শোনো। আমি প্রায় সময়ই কলকাতার বাইরে থাকি।তোমাকে সব কাজ ম্যানেজার বুঝিয়ে দেবে। কোনো প্রবলেম হলে এনাকে বোলো। ইনি পারেন না এমন কোনো কাজ নেই। মাসের এক তারিখ মাইনে পেয়ে যাবে। তবে কাজে যেন ফাঁকি না দেখি। আমি ফাঁকি মারা লোক দেখতে পারি না। বুঝলে ?'

অসিত ঘাড় নাড়লো। এর অর্থ - 'হ্যাঁ , বুঝলাম।'

'তুমি তাহলে একটু বাইরে গিয়ে বসো। উনি আসছেন একটু পরে। কাজ বুঝিয়ে দেবেন।'

অসিত বাইরে গিয়ে বসলো। এখন সেই মাছের মতন মেয়েটা বুক ফুলিয়ে ফোনে কথা বলছে। কি বলছে শোনা যাচ্ছে না। কিছু মানুষ এত আস্তে কথা বলে যে পাশের মানুষও শুনতে পায় না। একবার বাসে একটি মেয়ে তার সামনে বসে পনেরো মিনিট কথা বলে গেল যার একটি শব্দও অসিত বুঝতে পারে নি। কি বিচিত্র মানবজাতি !

ম্যানেজারবাবু চলে এলেন। অসিত দেখলো লোকটার মুখটা যথেষ্ট ধুরন্ধর প্রকৃতির। পান খেয়ে খেয়ে ঠোঁট লাল হয়ে গেছে। লোকটা হাসতে হাসতে বলল, হে হে , থাকো কোথায় ? হোয়ার স্টে ?

আমহাসট্রিট।

সে তো সামনেই । হে হে। সিগারেট খাও ? স্মোক !

হ্যাঁ , খাই।

বেশ , এসো আমার সাথে। অসিতকে সে নিয়ে গেল পাশের একটা চেম্বারে। এটা তার চেম্বার। বেশ সুন্দর সাজানো।একটা টেবিল , দুটো চেয়ার। দেওয়ালে সুন্দর দুটো  অয়েলপেইন্ট। লোকটা বলল, বসো। মিতু দুটি চা দিতে বলো।

অসিত বুঝল ওই মাছটির নাম মিতু। চেয়ারে বসে অসিত বলল, আমার কাজটা কি একটু বুঝিয়ে বলবেন ? আমি কিছুই জানি না।

'বলব , বলব । বলার জন্যই তো এখানে আসা। তা , তোমার কোনো কাজের অভিজ্ঞতা আছে ? মানে , ওয়ার্ক অভিজ্ঞতা।হে হে। '

'নাহ। এটাই প্রথম কাজ। বলতে পারেন আজকেই আমার জীবনের প্রথম কাজের দিন।'

ম্যানেজারবাবু মনে হলো যেন বেশ প্রসন্ন হলেন। ইতিমধ্যে চা এসে গেল। চা'এ  চুমুক দিতে দিতে সুক সুক করে এক অদ্ভুদ শব্দ করতে লাগলেন। বললেন , তা হলে তো আজ বড় আনন্দের দিন ভাই। এই দিনটা মনে রেখো। এ এক স্মরণীয় দিন। রিমেম্বারফুল ডে । হে হে।

অসিত লক্ষ্য করলো এই ম্যানেজার তেমন বিশেষ ইংরেজি জানে না। আর কথায় কথায় হাসে। এটা এক প্রকার মুদ্রাদোষ।তবে ভুল ভাল ইংরেজি বললে অসিতের মাথা গরম হয়ে যায়। যদি নাই বলতে পারো তাহলে কে মাথার দিব্যি দিয়েছে ওই ভাষায় কথা বলার ! মানুষ সত্যিই বিচিত্র।

ম্যানেজারবাবু একটি ফাইল বের করলেন। সেটি অসিতের দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন , এতে প্রায় পাঁচশো ক্লায়েন্টের নাম , ঠিকানা , প্রিয় খাবার , প্রিয় কালার আর যা যা প্রিয় থাকার দরকার সেই সব প্রিয় জিনিস নোট করা আছে। মাসের বিভিন্ন সময় এই সব ক্লায়েন্টের কেউ না কেউ আমাদের কাছে ব্যবসা নিয়ে আসে। তবে সেটা আমাদের হাতে আসবে কিনা সেটা ডিপেন্ট করে আমরা তাকে কিরকম সার্ভিস দিচ্ছি। সার্ভিস মানেটা বুঝতে পারছো?

'পারছি। মানে ঘুষ। এরা সব বড় বড় কোম্পানির মাথা। এদের খুশি করলে তবেই এরা আমাদের কাছ থেকে জাহাজ কাটা লোহা কিনবে।'

'উহু ,শুধু লোহা না। একটা জাহাজ কেটে অনেক কিছুই পাওয়া যায়। একটা জাহাজের ওয়েস্ট মেটেরিয়াল বিক্রি করতে এক বছর লেগে যায়। জাহাজ বলে কথা , হে হে।'

'তাহলে আমার এখানে কাজ কি ?'

'হুম , গুড প্রশ্ন। যে কাজ তোমায় দেবো তার জন্য একজন খুব বিশ্বাসী আর শোভার ছেলে আমরা খুঁজছিলাম। তুমি শোভার সে বিষয়ে সন্দেহ নেই তবে বিশ্বাসী কিনা জানি না। আই নট নো ইউ বিলিভ অর নট ।'


অসিতের এই ইংরেজি শুনে কেমন যেন গা গুলিয়ে উঠলো। এখন অঞ্জন থাকলে এই লোকটার ষোলো গুষ্টিকে খিস্তি মারা শুরু করতো। আমায় কাজ দিয়ে দেখুন আমি বিশ্বাসী কিনা !

সে তো দেবই। উইল গিভ। তোমার কাছে যে ফাইলটা দিলাম তার দুশো পাঁচ নম্বর লোকটার নাম কি দেখো তো ? মনে হয় মেহবুব হাসান।

হ্যাঁ , ওই নামই লেখা আছে।

এই লোকটি কাল গ্রান্ডে আসছে। রুম নম্বর জানা নেই। তবে আসছে। কাল রাত নটায় তুমি এর কাছে চলে যাবে। তার আগে তোমাকে একটি মেয়ে ফোন করবে। নাম জানা নেই। এদের নাম সকাল বিকেল চেঞ্জ হয়। তোমার কাজ হলো মেয়েটিকে ওই লোকটার কাছে নিয়ে যাওয়া। আর ঘন্টাখানেক পর আবার সেই লোকটার কাছে ফিরে গিয়ে মেয়েটিকে ফিরিয়ে নিয়ে আসা। ব্যাস । ওয়েল ডান জব। হে হে।

এতে তো রিস্ক আছে ! যদি পুলিশ রেট করে ? এই সব পাঁচতারা হোটেলে পুলিশ সিভিলে ঘুরে বেড়ায়।

নো ওরি। পুলিশকে হাত করা আছে। কালকের কাজে তুমি সাকসেস পেলে কেল্লা ফতে। মানে , উইন ফোর্ট। হে হে।

তাহলে আমার কাজ শুধু ওই মেয়েটিকে নিয়ে যাওয়া আর নিয়ে আসা।

এটা দিয়ে শুরু। বিগিনিং অফ যাত্রা। আসতে আসতে আরও কাজ শেখাবো। সব একদিনে গিলতে পারবে না। পেট খারাপ হয়ে যাবে। হে হে। আর হ্যাঁ , আর একটা ইম্পরট্যান্ট কথা , খুশি হলে এই সব ক্লায়েন্ট পাঁচশো হাজার বকশিস দেয়। সেটা হবে তোমার উপরি পাওনা। কোম্পানি তাতে হাত দেবে না। নো হ্যান্ড অন উপরি।


সাত

বিকেল বিকেল অসিতের ছুটি হয়ে গেল।

রাস্তায় নেমে অসিত ভাবলো একবার পার্থদার ডেরায় যাবে। অনেকদিন চুটিয়ে তাস খেলা হয়নি। মনে চাপ নিয়ে তাস খেলা যায় না। এতদিনে মাথা থেকে একটা চিন্তা নামলো। চাকরিটা বেশ ভালোই । হোটেলে হোটেলে ঘোরো। আর টিপস আদায় করো। এ আর এমন কি কাজ ! যদিও বাকি কাজগুলোও শিখতে হবে। এই ম্যানেজার একদম খানদানি লোক। মালটা গভীর জলের মাছ।

পার্থদার ডেরাটা গিরিশ পার্ক মেট্রোর ঠিক পিছনে। পার্থদা বয়সে অসিতের থেকে অনেক বড়। বয়স পঞ্চাশ ছুঁই ছুঁই। ফেরসাস লোক। যাকে তাকে গায়ে হাত তুলে দেয়। এককালে একটা নাটকের দল চালাতো। সেই সব জমলো না। তারপর এই ডেরা খুলে বসে। ভালোই ব্যবসা। যে যা খাবে খাও । শুধু খাবার পিছু পঞ্চাশ টাকা তাকে দিতে হবে। এই করে করে দিনে হাজার টাকার উপরে ইনকাম। তবে মেয়েছেলে আনা যাবে না। এই একটাই প্রতীকী শর্ত।


আজ অসিতের মনটা বেশ ফুরফুরে। সে ঠিক করলো আর যাইহোক অঞ্জন বা দেবেন্দ্র'কে আজ আর ডাকবে না। পার্থদার  ডেরায় এই দুজন থাকা মানেই মারামারি হাতাহাতি হবেই।

বাসে চেপে বসলো অসিত। পার্থদার ওখানে পৌঁছাতে সন্ধ্যে সাতটা বেজে গেল। রাস্তায় মিছিল বেরিয়েছিল। শয়ে শয়ে কালো মাথাগুলোর নিচে প্রায় একই তারতম্যহীন ফ্যাকাশে মুখ। সবার দাবি এক। উদ্দেশ্য এক। তবুও যেন এরা সবার থেকে অনেক দূরে। নতুন সরকারের দাবিতে এরা পথে নেমেছে। যেখানে বেশিরভাগ মানুষই হয়ত পুরোনো সরকার থেকে এসে পথে ভিড় করেছে। এদের পাশ কাটিয়ে পৌঁছাতে প্রায় ঘন্টাখানেক লেগে গেল। আকাশে আজ আবার মেঘ করেছে। হয়ত বৃষ্টি হবে।

পার্থদার বাড়িতে মোট দুটো ঘর। সব মিলিয়ে দশজন ভালোভাবেই বসতে পারে। ধোঁয়ার কুন্ডলির মতন এখানে একেকটা ছোটো ছোটো গ্রুপ হয়ে সবাই বসে। বেশিরভাগ আলোচনাই হয় রাজনৈতিক আর সাহিত্য নিয়ে। কিছু অবশ্য ভুলভাল ছেলে আসে। তবে বেশি দিন এখানে টেকে না। কারণ এখানে যারা আসে তারা প্রায় সবাই হাই থিংকিং এন্ড লো লিভিং -এ বিশ্বাসী।

দরজার পাশের মানিক বসে। বয়স পনেরো ষোলো মতন। হৃষ্টচিত্তে বিড়ি টানছে। এ'হলো পার্থদার চাকর। কোথা থেকে জোগাড় করেছে জানা নেই। ফাইফর্মাস খাটে। ঠোঁট'টা বেঁকিয়ে ধোঁয়ার রিং বানানোর চেষ্টা করছে। অসিতকে দেখে প্রাণোজ্জল হাসি দিয়ে বলল, আরে দাদা , এত দিন পর!

অসিত হেসে বলল, ভিতরের খবর কি ?

খবর গরম। ওই পাগলটা এসেছে। আবার আজ একটা ঝামেলা হবে।

অসিতের মাথায় যেন বাজ পড়লো। যেখানে বাঘের ভয় সেখানে সন্ধ্যে হয়। পর্দা সরিয়ে সে দেখলো ঘরের একদম উত্তরের কোণে অঞ্জন বসে। সামনে পার্থদা। কোনো একটা বিষয় নিয়ে তুমুল তর্ক চলছে। অসিত ভাবলো পালাবে। কিন্তু তার আগেই অঞ্জন তাকে দেখে নিয়েছে আর হাতের ইশারা করল, যার অর্থ, আয় , এখানে এসে চুপটি করে বোস।

অগত্যা অসিত ভিতরের গিয়ে বসলো, অঞ্জন এখন তারস্বরে চেঁচিয়ে যাচ্ছে , আপনি সাহিত্যের লঙ্কা বোঝেন। নাটকের দল চালালেই সাহিত্য রপ্ত হয় না। অসিত , একটা পেগ বানা।

পার্থদা বলল, দুটো লেখা তোমার কাগজে বেড়িয়েছে বলে এত অহংকার ! কি এমন লেখো , অর্ধেক লাইনের মানেই বোঝা যায় না।

পার্থদা , খবরদার , আমার লেখা তোমার খারাপ লাগতেই পারে তবে ভুলভাল কথা বলবে না কবিতা নিয়ে।

অসিত দেখলো আজ একটা বাজে কিছু ঘটবে। পার্থদা যা মানুষ চোখের পলক ফেলার আগেই ঘুসি চালিয়ে দিতে পারে। আর ওই হাতের একটা যদি অঞ্জন খায় তাহলে আজ রাতে অন্তত উঠবে না।

অসিত টেনে হিঁচড়ে অঞ্জনকে সেখান থেকে বের করলো। পরিস্থিতি হাতের বাইরে চলে যাচ্ছিল। পার্থদা এই মারে কি সেই মারে।

রাস্তায় নামার সাথেসাথেই বৃষ্টি নামলো। অঞ্জন দাঁত কিড়মিড় করে বলল, ভালো করেছিস আমায় ওখান থেকে নিয়ে এসে। আমি যদি আর কোনদিন ওখানে যাই তাহলে আমি একটা শুয়োরেরবাচ্চা।

অসিত বলল, মুখ খারাপ করিস না। কোথায় যাবি এখন ? আটটা বেজে গেল। তাড়াতাড়ি ফিরতে হবে। কাল ডিউটি আছে।

'ডিউটি ! কিসের ডিউটি ? শালা হাবারে । তোর আবার ডিউটি কিসের ?'

'ভুলে গেলি। প্রতিম ঘোষাল। জাহাজ কোম্পানি ।'

'ওওওও , আজ তোর জয়েনিং ছিল তো। একদম ভুলে গেছি ব্রাদার। কেমন গেল প্রথম দিন ?'

'ভালোই। কাজটাও বিশেষ জটিল না ।  যাইহোক , এখন তাহলে কি করবো ? বাড়ি ফিরবি নাকি ?'

'বাড়িতেই ফিরে যাই। যা বৃষ্টি আজ আর কোথাও যাওয়া উচিত হবে না।'

দুজনেই বাসে উঠলো। বৃষ্টি যেন আকাশ ভেঙে নামলো। বাসের  জানলার পাশে জলের ঝাপটা খেতে খেতে অসিত ভাবলো , আর একদিন পরেই সে দেখা করতে যাবে রিনার সাথে। প্রথম দিনেই সব বলে দেবে। যা হয় হবে। এখন তার অনেক ক্ষমতা  , অনেক পয়সা হতে চলেছে। সে চাকরি পেয়েছে।

(চলবে)