গল্প 

অঙ্কন: শুভ


ফি নি ক্স

প্রিয়ঙ্কন চ্যাটার্জী 

"আচ্ছা দাশুকাকা, মরে গেলে কী হয়?" প্রশ্নটা করে দাশুকাকার দিকে তাকালেই, তাতাই দেখতো কেমন অদ্ভুতভাবে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতো দাশুকাকা- সমাজ যাকে পাগলা দাশু, দাশুবুড়ো, দাশুপাগলা নামে ডাকতো৷ পাড়ার ছেলেরা বিরক্ত করতো৷ বড়োদের চোখে থাকতো অবজ্ঞা আর তাচ্ছিল্য৷ শুধু তাতাই ওর কাছে এসে বসতো৷ স্কুল থেকে ফেরার পথে টিফিন বাক্স খুলে কেক, বিস্কুট যা বাঁচিয়ে রাখতো সেটা দাশুকাকাকে দিতো৷ দাশুকাকার চোখে মুখে যে হাসিটা ফুটে উঠতো, সেটা দেখেই তাতাই খুব আনন্দ পেতো। দাশুকাকাও তার জন্য বসে থাকতো পথ চেয়ে৷ এভাবেই তাতাইয়ের কাছে দাশুপাগলা, দাশুকাকা হয়ে গেছিলো। বদ্যিপাড়ার শেষে যে পুকুর আছে, সেই পুকুরের পাশের বাড়িটা দাশুপাগলার৷ একসময় কলেজে নাকি পড়াতো৷ একটা অ্যাক্সিডেন্টে বউ আর মেয়েকে চোখের সামনে মারা যেতে দেখে; আর তারপর থেকেই সে মানসিক ভারসাম্যহীন৷ এসবই তাতাই শুনেছিলো, ওর বাবার থেকে। 
যতোবার তাতাই জিজ্ঞাসা করেছিলো, মানুষ মরে গেলে কী হয়, আকাশের দিকে তাকিয়ে থেকে দাশুপাগলা বলেছিলো
মানুষ মারা গেলে পশুপাখি হয়ে যায়। দাশুপাগলা সারাদিন ওই, বুড়ো শিবমন্দিরের সামনের বটতলাতেই বসে থাকতো। আর নিজের মনে বিড়বিড় করে কীসব বলে যেতো৷ তাতাই সামনে বসে শুনতো। অনেক রকম না জানা গল্প বলতো, কিন্তু সাথে মিশে থাকতো দাশুপাগলার কিছু উপলব্ধি৷ হতাশা৷ পাগলের উপলব্ধি কেউ পাত্তাই দেয়নি। "যত্তসব পাগলের প্রলাপ"- বলেই সমাজ দায় সেরেছে৷ 
উচ্চমাধ্যমিকের শেষ এক্সামটা দিয়ে ফেরার পথে তাতাই দেখেছিলো দাশুপাগলা ওই বটতলাতে নেই৷ বিকেলে রিকিদের সাথে সাইকেল নিয়ে বেরিয়েও দেখতে না পেয়ে যখন দাশুপাগলার বাড়ি যায়; ওরা দেখে, দাশুপাগলা নিজের ঘরে গলায় দড়ি দিয়েছে৷ 

কেটে গেছে বেশ কয়েক বছর৷ তাতাই ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করেছে৷ গানের দল আছে নিজের৷ কিন্তু বাড়ি থেকে তীব্র আপত্তি৷ ডাক্তার বাবা আর প্রফেসর মায়ের একমাত্র সন্তান কিনা শেষ অবধি গানের দল খুলবে৷ দিন গড়িয়েছে, তাতাই এর মনের বিশ্বাস বয়স বাড়ার সাথে দৃঢ় হয়েছে যে, তার দাশুকাকা বোধহয় ঠিকই বলত। যে  বটতলায় দাশু থাকতো সেখানে একটা বক পাখিকে দেখা যেতো৷ বক অতি দার্শনিক পাখি। মহাভারতে ধর্মরাজ, বকের রূপে ছিলেন৷ জ্ঞানী, দার্শনিক৷ ঠিক যেমন দাশুকাকা ছিল। তাতাইয়ের ডাক্তারদাদা ঠিকই বলে, প্রত্যেক দার্শনিকই পাগল হয়, অথবা প্রত্যেক পাগলের মাঝেই হয়তো দার্শনিক থাকে। তাই কি, সমাজ ওদের কথা না বুঝে পাগল বলে হাসাহাসি করে? তাহলে আসলে কারা পাগল? 

বাকীরা এসব কথা শুনলে তাতাইকেও পাগল বলে। তাহলে কি তাতাইও ধীরে ধীরে দার্শনিক হয়ে যাচ্ছে? তাতাইয়ের জীবন দর্শনটাই বা কেমন! সমাজ তো জিতে যাওয়া মানুষের দর্শন জানতে চায়, কিন্তু যে হেরে যায় তার জীবনদর্শন? সেটার খবর কেউ রাখেনা৷ তাতাইয়ের খবরও তাই কেউ রাখতে চায়না৷ 
ঠিক যেমন ওর বাবা মাও তাতাইয়ের খবর রাখেনা৷ কাল রাতে কনসার্ট সেরে ফেরার পরে বাবা তো কুলাঙ্গার অবধি বলে দিলো৷ ওর জন্য বসুবাড়ির সম্মান নষ্ট হচ্ছে।  মেঘনাও শেষের দিকে একই কথা বলতো। ওর মতো একজন ট্র‍্যাশ লোকের সাথে থাকা সম্ভব না৷ 
 বারবার তাতাইকে বলেছে,  তোমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে। এরকম ব্রাইট কেরিয়ার নিয়ে কে নিজেকে নষ্ট করে? এসব প্যাশন দিয়ে পেট চলেনা। তাতাই আগে ভাবত, মেঘনা মরে গেলে নিশ্চয়ই কোকিল হবে। কলেজের প্রথম আলাপের সময়ে যা মিষ্টি করে কথা বলতো! গোটা কলেজ ওর ফ্যান ছিলো। কিন্তু মেঘনার সাথে  তাতাইয়ের সম্পর্কটাই গড়ে উঠলো৷ সাথে ছিলো রিকি। ওর স্কুলবেলার বন্ধু৷ তাতাই ধরে নিয়েছিলো রিকি মৃত্যুর পরে কুকুর হবে। এতো বিশ্বস্ত বন্ধু!! কিন্তু শেষদিকে ওই ঝগড়া অশান্তির সময় তাতাইয়ের মনে হতো, ও আবার হেরে গেছে৷ ওর দর্শন আবার ভুল হয়ে গেছে। মেঘনা কোকিল নয়, বরং শকুন, কাক  কিছু হবে। আজকাল সবসময় রিকি আর মেঘনাকে একসাথে দেখা যায়! বন্ধুমহলে কানাঘুষো চলে। রিকিকে ফোন করলেই বিজি টোন আসে। জিজ্ঞাসা করাতে রিকি বলে, "বস, অফিসের কাজের প্রেশার! তুমি আর কি বুঝবে!" তাতাই বোঝে না, এটা কি শুনিয়ে বিদ্রুপ করছে নাকি নিছকই কথা! তাতাই বোঝে ও আবার হেরে যাচ্ছে৷ 
আজ সকালে ঘুম থেকে উঠতে দেরী হয়েছে তাতাইয়ের৷ কাল অনেক রাত অবধি জেগে ছিলো। প্রথমে, শো শেষে ব্যান্ড মেম্বারদের সাথে ঝামেলা। বেশকিছুদিন রাইটার্স ব্লক চলায়  নতুন গান আসছেনা৷ আর বেস গিটারের ছেলেটা কর্ড মিস করছিলো৷ তাতাই ওকে বলাতে, গিটারিস্ট ছেলেটা ওকে যা পারলো কথা শুনিয়ে দিলো৷ বাকীরা চুপ করে শুনলো৷ একটা নতুন মেম্বার, ব্যান্ডের সিনিয়ার ফাউন্ডার মেম্বারকে অপমান করছে, কেউ কিচ্ছু বললোনা৷ ভাবখানা এমন, যেন সবার সায় আছে। তারপরে বাড়ি ফিরেই, বাবা মায়ের সাথে হট ডিসকাশন৷  স্লিপিং পিলসও ঘুম পাড়াতে পারেনি৷ ঘুম থেকে উঠে দেখলো, গত সপ্তাহে যে দুটো চাকরির ইন্টারভিউ দিতে গেছিলো বাবার জোরাজুরিতে, সেখান থেকে রিগ্রেট মেইল এসেছে। বাবা অলরেডি হাসপাতালে বেরিয়ে গেছে৷ মাও বেরিয়ে গেলো৷ তাতাই কথা বলতে চাইলো, কিন্তু মা মোবাইলে অন্য কোনও এক প্রফেসরের সাথে ব্যস্ত৷ ও ফোন করলো রণজয়কে৷ রণজয় ব্যাংকে জব করে৷ ফোন ধরলো। তারপরেই বললো," খবরটা পেয়েছি রে৷ কি আর হবে বল! এখন ব্যাংকে আছি৷ প্রেশার আছে৷ পরে কথা বলছি৷ "
-"মানে? কিসের খবর!" তাতাই চমকে উঠলো। 
-" সে কি! তুই জানিস না? রিকির প্রোফাইল দেখ৷ আমি তোর সাথে রাতে কথা বলছি৷ বাই!" রণজয় ফোন কাটতেই ও ফেসবুকে এসে দেখলো আজ সকালে ফেসবুকে, রিকি ফেসবুকে রিলেশনশিপ স্টেটাস দিয়েছে- সেখানে জ্বলজ্বল করছে তাতাইয়ের দীর্ঘ ছয় বছরের প্রেমিকা মেঘনা! তাতাইয়ের বন্ধু, ফলোয়ারস সবাই কি সাবলীল ভাবে আনন্দ করে উদযাপন করছে, শুভেচ্ছা জানাচ্ছে৷ স্ক্রিনে জ্বলজ্বল করছে, রিকি আর মেঘনার ছবি৷ একে অপরকে জড়িয়ে রেখেছে৷
ফেসবুক থেকে বেরিয়ে ও রিকিকে ফোন করলো৷ বুঝলো, মেঘনার মতো রিকিও ব্লক করে দিয়েছে। তাতাই ফোন বন্ধ করে দিলো। ওর ফেসবুক পেজের কুড়ি হাজার ফলোয়ারস সবাই যেন ওর দিকে তাকিয়ে বিদ্রুপ করে হাসছে৷ আজ মেঘনারা শকুন হোক বা শিয়াল তাতাইয়ের কিছু যায় আসে না। কিচ্ছুনা!

কিছুক্ষণ ও নিজের বেডরুমে চুপচাপ বসে থাকে৷ চাকরির রিজেকশন লেটার, ব্যান্ডের সমস্যা, রাইটার্স ব্লক, বাবা মায়ের উদাসীনতা, রিকির বিশ্বাসঘাতকতা সব কিছু চোখের সামনে ভেসে আসে। একসময় ও ধীর পায়ে ওদের হাইরাইজ অ্যাপার্টমেন্টের ছাদে উঠে আসে৷ বিকেল হচ্ছে৷ জীবনানন্দ শঙ্খচিল হয়েছিলেন। রাজকীয় ভাবে উড়ে উড়ে দেখেছেন বাংলার রূপ। বিবেকানন্দ হয়তো সিংহ হয়েছেন- রাজার মতো মেপে দেখেছেন ভারতের মাটির প্রতিটা ধূলিকণা৷ তাতাই হতে চায় ফিনিক্স পাখি! নিজেকে ধ্বংস করে দিয়ে আবার নতুন করে পাওয়া৷ পায়ে পায়ে হেঁটে ছাদের পাঁচিলের ধারে আসে ও। আকাশের দিকে চোখ রাখে ও৷ সূর্যটা লাল বর্ণ নিয়েছে৷ সেই সূর্যের তেজে পুড়ে গিয়ে নতুন করে ফিরতে চায়৷ এবারে এমন সমাজে ফিরতে চায়, যেখানে দাশুকাকা দার্শনিক বলেই স্বীকৃতি পাবে, পাগল না৷ যেখানে প্যাশনকে পেশা করে নেওয়া যাবে, যেখানে ভার্চুয়াল জগতের বাইরের জীবনটা গুরুত্ব পাবে৷

পাঁচিলের উপরে উঠে বসে তাতাই। আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখে, একদল পরিযায়ী পাখি উড়ে চলে যাচ্ছে দল বেঁধে৷ মানুষও তো ওদের মতো একসাথে থাকতে পারতো! 

তাতাইয়ের খুব ইচ্ছে হয়, ওদের দলে মিশে উড়ে যেতে৷ নিজেকে ভাসিয়ে দেয় ওই শূন্যে, ফিনিক্স হওয়ার আশায়।

( এই যান্ত্রিক সমাজে আজও যারা প্রাণের খোঁজ করে, তাদের বিষন্নতার অনুভূতি বাদে গল্পের বাকী সব কিছু কাল্পনিক। লেখাটির মূল ধারণা পাই আমার লেখকদাদা ডাঃ হিমাংশু চৌধুরীর কাছে৷ দাদার কাছে কৃতজ্ঞ)





খে লা ঘ র 
কণিকা দাস

    
 ছোট্ট দুটো হাতের ছোঁয়ায় ঘুম ভেঙ্গে গেল প্রত্যাশার। দেখে, বুবাই গাল ফুলিয়ে আছে।

  -- কী হল বুবাই, এত সকালে আমার ঘুম ভাঙালে কেন? আজ তো রোববার। জানো না রোববারে আমি একটু বেলা করে ঘুম থেকে উঠি। 

      বুবাই কাঁদো কাঁদো স্বরে বলে--- দেখো না দিদি, দোলা আবার আমায় ক্ষ্যাপাচ্ছে। নাক বোঁচা, কেলো এসব বলছে।

    বুবাইয়ের ফোলা ফোলা গাল দুটো টিপে দিয়ে প্রত্যাশা বলে --- ও তাই! দাঁড়াও, দোলাকে এক্ষুনি বকে দিচ্ছি-- বলেই বিছানা ছেড়ে উঠে পড়ে। ওদিকে দোলা সুসানের দিকে তাকিয়ে মিটি মিটি হাসছে। সুসানও দোলাকে চোখ টিপে দিল। তা দেখে প্রত্যাশার খুব হাসি পেল। কিন্তু না, একদম হাসা চলবে না। তাহলে বুবাইয়ের মন খারাপ হবে। ভাববে দিদিটা একপেশে।

    প্রত্যাশা দোলার কাছে গিয়ে ওর কান ধরে বলল-- আর কক্ষনো বুবাইকে ক্ষ্যাপাবি?

   দোলা হাসতে হাসতে বলল--না না, কক্ষনো না।

   তোদের জ্বালায় আর পারিনা বাপু। সারাদিন এ ওর পিছনে লেগেই থাকিস। আমি আর কতদিক সামলাবো। বলতে বলতে বাথরুমে ঢুকে পড়ে প্রত্যাশা। 

        মুখিয়াটা তখন বুবাই এর কাছে এসে হিন্দি ভাষায় কি যেন বলতে চাইলো। ওর কথায় কেউ কান দিলো না দেখে এক কোণে গিয়ে ওর কাজে মন দিল।

      প্রত্যাশা বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান। ক্লাস ওয়ানে পড়ে। বাবা বিজনেস ট্যুরে বাইরে গেলেই ওর জন্য নানা রকম পুতুল আনে। পুতুল ছাড়া ওর আর কোন বায়না নেই। ওর শোবার ঘরের সেলফে  আছে নানান দেশের নানা রকম ছেলে পুতুল, মেয়ে পুতুল। আর সব পুতুলের আলাদা আলাদা নাম।

      প্রত্যাশার ইচ্ছে ছিল ওর বাবা-মা ওর জন্য ভাই বা বোন নিয়ে আসুক। ওর খেলার সাথী হবে। কিন্তু বাবা-মা কেউ রাজি নয়। বাবা ওকে একটা পুতুল হাতে দিয়ে বলে-- জীবন্ত পুতুল আমাদের একটাই যথেষ্ট। তুমি এই পুতুলগুলো দিয়ে খেলবে। 

      প্রথম প্রথম ওর খুব অভিমান হতো। বাবা বেশিরভাগ সময় ব্যবসার কাজে বাইরে থাকে। আর মা সকাল আটটায় অফিসে গিয়ে ফেরে রাত আটটায়। এসেই রান্না ঘরে। তারপর খাওয়া দাওয়ার পর ল্যাপটপ নিয়ে বসে। সারাদিনে কত কথা জমা হয় প্রত্যাশার মনে। কিন্তু বলবে কার সাথে? আন্টি তো কাজ শেষ হলেই টিভি দেখতে বসে। তখন কোন কথা বললে বলবে, “এখন কথা বলো না তো। দেখছো না সিরিয়াল দেখছি। পরে শুনবো তোমার কথা।” কি আর করবে সে। অগত্যা মন খারাপ করে শুয়ে বসে কাটায়।

        এমনি একদিন মন খারাপ করে শুয়ে আছে প্রত্যাশা। হঠাৎ পুতুলের সেলফে চোখ পড়তেই দেখে একটা পুতুল ওকে দেখে চোখ টিপে দিল। প্রথমে ভাবল হয়তো ভুল দেখেছে। চোখ রগড়ে আবার তাকাতেই দেখলো সত্যি সত্যি চোখ টিপে ওকে ডাকছে। কাছে যেতেই কিচিরমিচির করে কি যেন বললো কিছুই বোঝা গেল না। মনে মনে ভাবলো বাবা তো ওকে জার্মান থেকে এনেছিল, তাহলে কি ও জার্মানি ভাষায় কথা বলছে! ভাবল ইংরেজিতে বলে দেখাই যাক ন। যেই না ইংরেজিতে বলল-- হোয়াট ডু ইউ সে? অমনি ভাঙ্গা ভাঙ্গা ইংরেজীতে পুতুলটি বলল-- আই অ্যাম ফিলিং দ্যাট ইউ আর ক্রাইং। হোয়াই আর ইউ ক্রাইং? আনন্দে প্রত্যাশার চোখ চিকচিক করে উঠল। আর মন ভাল হয়ে গেল। খুশিতে হাততালি দিয়ে লাফাতে লাগল। তারপর থেকে সে ওই পুতুলগুলোর সাথেই কথা বলে, আদর করে। আবার ঝগড়া করলে বকেও দেয়।

      প্রথমে পুতুলগুলো নিজেদের ভাষায় কথা বললেও প্রত্যাশা ওদের বাংলা শিখিয়েছে। এখন ওরা বাংলাতে কথা বলতে পারে। প্রত্যাশা ইংরেজি মাধ্যমে পড়লেও বা স্কুলে বন্ধুদের সাথে ইংরেজিতে কথা বললেও বাড়িতে বাংলায় কথা বলে। দাদুর কড়া হুকুম বাড়িতে সবার সাথে বাংলায় কথা বলতে হবে। তাই পুতুলদেরও বাংলা বলাটা বাধ্যতামূলক। কেবল রাজস্থানী মুখিয়াটা নতুন এসেছে বলে বাংলা এখনো রপ্ত করতে পারেনি। হিন্দিতে যা-ও বা বলে তার অর্ধেকই বোঝা যায় না। কলকাতা থেকে কেনা পুতুলগুলো এতো বকবক করে যে প্রত্যাশার কান ঝালাপালা হয়ে যায়।

         মারিয়া এসেছে দুবাই থেকে। ওর পোশাক আরবীয় মেয়েদের মত। খুব লাজুক আর কম কথা বলে। আর এত মিহি সুরে কথা বলে যে, অনেক সময় কি বলতে চাইছে তা বোঝাই যায়না। রাজস্থানী ড্রেস পরা ওই মুখিয়া যখন এলো তখন তো দুদিন লজ্জায় ও লুকিয়েছিল। ওদের দেশের ছেলেরা নাকি হাটুর উপরে কাপড় পরে না। প্রত্যাশা অনেক বুঝিয়ে ওকে বের করেছে। এখন তো মুখিয়ার সাথে আকারে-ইঙ্গিতে কত কথা বলে। তা আড়াল থেকে সব লক্ষ্য করে প্রত্যাশা। জাপান থেকে যে পুতুলটা আনা হয়েছে ওর নাম ওসাকা। ওর পরনে কিমোনো  আর সুন্দর করে চুল বাঁধা।  চোখগুলো ছোট আর ভাসা ভাসা। কেনিয়া থেকে যে পুতুলটা এনেছে ওর নাম উদুম্বে। কালো, নাক মোটা, কোঁকড়ানো চুল। খুব ছটফটে। এসেই সবাইকে বন্ধু করে নিয়েছে।  

     বেশিরভাগ পুতুলের নাম প্রত্যাশার দেওয়া। তবে কখনো কখনো নামের জন্য অন্যের দ্বারস্থও হতে  হয়েছে। যেমন নেপাল থেকে যে পুতুলটা এনেছে তার নাম দাদুভাই রেখেছে তেনজিং। বাংলাদেশ থেকে যে পুতুলটা এসেছে ছোটকা ওর নাম রেখেছে জোনাকি। ওর চোখ গুলো নাকি রাতের বেলায় জোনাকির মতো জ্বলে আর নেভে।

        রোববার টা হল পুতুলদের আনন্দের দিন। সেদিন প্রত্যাশাকে কোথাও যেতে দিবে না ওরা। সারাদিন কেবল বায়না আর বায়না। এ বলবে দিদি একটা ছবি এঁকে দাও না। ও বলবে দিদি আমার সাথে গান করো না। সোনালী নামের একটা মনিপুরী পুতুল আছে ও খুব সুন্দর মনিপুরী নাচ করে। ঘুরে ঘুরে মন্দিরা বাজিয়ে। তখন আবার তাকে কীর্তন শোনাতে হবে। মুম্বাই থেকে আনা করিণাকে শোনাতে হবে রবীন্দ্র সংগীত। ও নাকি রবীন্দ্র সংগীত প্রথম শুনেছে শান এর কন্ঠে। সেই থেকে রবীন্দ্র সংগীতএর ভক্ত। বুবাই শুনবে হিন্দি গান।  

     সপ্তাহের বাকী পাঁচ দিন স্কুলে থাকে বলে পুতুলগুলো কেমন চুপসে থাকে! আগে অবশ্য স্কুল থেকে ফিরেই প্রত্যাশা ওদের নিয়ে খেলতো। টিচারের কাছে পড়তে যেতে চাইতো না। একদিন ওর মা খুব বকেছে। বলেছে সব পুতুল ডাস্টবিনে ফেলে দিবে। সেই শুনে ওদের কি কান্না! ওরাই প্রতিজ্ঞা করিয়েছে যেন রোববার ছাড়া প্রত্যাশা ওদের সাথে বেশি কথা না বলে, খেলাধুলানা করে। শুধু প্রতিদিন ঘুমানোর আগে ওদের সাথে একটু কথা না বললে প্রত্যাশার ঘুম আসতে চায় না।

          আজ প্রত্যাশার জন্মদিন। সারাদিন বাড়িতে কত লোকজন! দাদু দিদা, মামা-মামী, ছোটকা কাকিমনি, বন্ধুরা সবাই এসেছে। সারাদিন খুব হৈ হৈ করে কেটেছে। আজ ৫টা পুতুল গিফট পেয়েছে সে। 

       রাতে বাড়ি ফাঁকা হয়ে গেলে প্যাকেট বন্দি পুতুল গুলোকে একবার দেখে নেয়। মা বলেছে আজ আর কোন প্যাকেট খুলতে হবে না। কাল রোববার অনেক সময় পাবে খেলার। এখন ঘুমাতে যাও। অনেক রাত হয়েছে তাই বিছানায় শুয়েই ঘুম। বুবাই, মুখিয়া, সোনালী, মারিয়া, ওসাকা, উদুম্বে সবার মুখ ভার। ওরা কত আশা করে আছে দিদি ঘরে এলে গল্প শুনবে। আর দিদি কি না ঘুমিয়ে পড়ল! প্রত্যাশা ঘুমিয়ে যেইনা নাক ডাকতে শুরু করলো অমনি সবগুলো পুতুল একসাথে হাততালি দিয়ে ঘুরে ঘুরে নেচে নেচে বলতে লাগল--হ্যাপি বার্থ-ডে টু ইউ। প্রত্যাশার ঘুম গেল ভেঙে। তবে রে দুষ্টুরা-- বলে দৌড়ে এসে ওদের জড়িয়ে ধরে আদর করতে লাগলো।

           ওদিকে প্রত্যাশার মা দরজায় দাঁড়িয়ে দেখছে সবগুলো পুতুল দুলে দুলে নাচছে আর প্রত্যাশা মাঝখানে দাঁড়িয়ে হেসে কুটিপাটি হচ্ছে। তারও মনে হলো হাততালি দিয়ে ওদের সাথে গান করে। কিন্তু পরক্ষণেই আবার থেমে যায-- থাক না মেয়েটা একটু খেলা করুক। সেই দু বছর বয়স থেকেই তো স্কুল আর বইয়ের সাথে সম্পর্ক। এই কম্পিটিশনের যুগে কিই বা করার ছিল? মেয়েটাকে পড়ার জন্য এত চাপ দেওয়া হয় যে বেচারা একটু খেলা করারও সময় পায়না। আর খেলা করবেই বা কার সাথে? ওর সমবয়সী সব বন্ধুদের তো একই অবস্থা। যদি এই পুতুলদের সাথে একটু সময় কাটায় তাতে ক্ষতি কি? এমন সময় একটা পুতুল এসে প্রত্যাশার মায়ের আঁচল ধরে টানতে থাকে। ও আন্টি এসো না আমাদের সাথে খেলবে। এসো না। প্রত্যাশার মা কী একটা বলতে যাচ্ছিল। হঠাৎ ঝাঁকুনি খেয়ে জেগে ওঠে।

        -- কী গো এমন গোঙাচ্ছ কেন? স্বপ্ন দেখছিলে বুঝি?

         হ্যাঁ তো স্বপ্নই দেখছিল। সারাদিন যে মেয়েটাকে পুতুলদের সাথে কথা বলতে দেখে!

        অত্যাশার মা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে ওর বাবার দিকে। ঠিক তখনই ওরা দুজন শুনতে পায় পাশের ঘরে অত্যাশা বলছে--- তোরা এত বিরক্ত করিস! হল তো অনেক গল্প। এবার একটু ঘুমাতে দে না।





অঙ্কন: শুভ




আ ল মা রি      
ঋভু চট্টোপাধ্যায়


-হ্যাঁ মা বলো।
-কোথায় আছিস রে?এতক্ষণ ধরে ফোন করেই যাচ্ছি কোন রেসপন্স নেই। 
-কেন আমি তো টিউসনে ছিলাম।তোমাকে তো বলেই এলাম, কলেজ ফিরতি টিউসন করে ফিরব।কিছু কি দরকার আছে?এত গুলো মিস্ কল!
-তোর বাবার ফোন অনেকক্ষণ ধরে বন্ধ আছে।তোকে কি কিছু বলে গেছে ?
-না তো।দুটো নম্বরই বন্ধ?
-হ্যাঁ।অনেকক্ষণ ধরে চেষ্টা করছি।সেই দুপুর থেকে। 
-কোথাও গেছে হয়ত।
-আজ পর্যন্ত কোন দিন তোর বাবা না বলে কোথাও গেছে?অফিসে দেরি হলেও ফোন করে জানিয়ে দেয়।
-তুমি চিন্তা কোরো না, আমি দেখছি।তুমি একবার বীরেনকাকুকে ফোন করে দেখ। 
-তিন্নি, অফিসে ফোন করেছিলাম।বলল, সেই দুপুরেই বেরিয়ে গেছে।
তিন্নি আর কথা না বাড়িয়ে ফোনটা কেটে বাবার নাম্বার ডায়াল করল।বাবা ওয়ান, বাবা টু। সুইচট অফ্।মোবাইলে দেখল আটটা কুড়ি।স্ট্যান্ডে না গেলে অটো পেতে সমস্যা হবে।কিন্তু বাবা গেল কোথায়?একে একে ব্যাচের ছেলে মেয়েরা সব বাড়ির দিকে পা বাড়াল।তিন্নির সাথেও দুজন এল।একজন মাঝ রাস্তাতেই অটো পেয়ে গেল।তিন্নি অন্য আরেক ব্যচমেটের সাথে কয়েকটা পা এগিয়ে এসে একটা এ.টি.এম কাউন্টারের কাছে দাঁড়িয়ে সঙ্গিকে এগিয়ে যেতে বলে নিজে এ.টি.এম কাউন্টারের ভিতরে ঢোকে।টাকা তুলে স্ক্রিনে চোখ রাখতেই চমকে ওঠে।একি! এত টাকা!প্রিন্ট বের হল না।এই এক নতুন সমস্যা এসেছে, অর্ধেক কাউন্টারে প্রিন্ট বের হয় না।মেসেজটা বাবার মোবাইলে যাবে তিন্নির নাম্বার ট্যাগ করেনি।কিন্তু এতগুলো টাকা হিসেব মিলছে না।কেউ কি,তাহলে ইচ্ছে করে এতগুলো টাকা ব্যাঙ্কের আকাউন্টে ফেলে দিল?তাও আবার দু’লাখ।বাবার চিন্তার মাঝে আচমকা এই টাকার চিন্তাও পেয়ে বসল।এত সমস্যা এই ভাবে চলে আসবে ভাবেনি, তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরতে হবে।বাবা এতক্ষণেও না ফিরলে মা এখন একা।
এক কথা বলতে বলতে প্রকাশের জিবে পলি পড়ে গেল।একেক সময় রেগে যায়, পরেক্ষণেই নিজেকে বোঝায়, বেচারা এরাও বা কোথায় যাবে, কয়েকদিন আগেই সেই টাক মাথার ভদ্রলোক এসে প্রকাশের ডেক্সে চেল্লাতে আরম্ভ করে ছিলেন,‘এর থেকে আমাকে একটু বিষ এনে দিন, খেয়ে সবাই মিলে বাঁচি।কোথায় ছিল আর কোথায় এসে দাঁড়িয়েছে।’প্রকাশ সেদিন রাগেনি।ক্যাসুয়্যাল স্টাফ সমীরকে বলে, ‘এনাকে এক গ্লাস ঠাণ্ডা জল দাও তো।’জল পান করে ভদ্রলোক বেশ শান্ত স্বরেই বলেন,‘বলুন তো ম্যানেজারবাবু, এভাবে ইন্টারেস্ট কমালে খাবো কি?রাজ্য সরকারের চাকরি করতাম, রির্টায়ার করে কতই বা পেয়েছি।এতে খাবো,ডাক্তারকে দেব, না জমাবো।’ভদ্রলোকও সব বোঝেন, কিন্তু  কি করা যাবে, নিয়ারেস্ট গায় দ্য গিলটি ওয়ান।
এদিকে দিন দিন কাজের চাপটাও বাড়ছে।টিফিন খেতেই সময় পায়না।দুটো থেকে আড়াইটের সময় কিছুনা কিছু কাজ এসে যায়।নিদেন পক্ষে লিঙ্ক ফেলিওর।একে ওকে ফোন করা তো আছেই।তবে কাস্টমাররা ভাবে এটা হয়ত ব্যাঙ্কের লোকেদের ফাঁকিবাজির নতুন অস্ত্র।কথায় কথায় লিঙ্ক ফেলিওর।অর্ধেকজন বোঝেনা এই ভার্চুয়াল ব্যাঙ্কিংএর যুগে অর্ন্তজালই প্রধান স্তম্ভ।এত বোঝা সবার কম্ম নয়।ঘরের ভদ্রমহিলাই বোঝেনা। 
কাজ করবার ফাঁকে একবার মোবাইলের স্ক্রিনে চোখ রাখল।না, এখনও পর্যন্ত মিস্টি কল নেই।ভালোই আছে, দরকার হলে মিস্ট্ কল দিয়ে ছেড়ে দেয়।কিছু বললে  জবাব দেয়,‘তুমি কেন্দ্রিয়, আমি রাজ্য।জানোই তো কতটাকা কম বেতন পাই।’কঠিন অবস্থা হাসবেন্ট ওয়াইফ, তাতেও কেন্দ্রিয় রাজ্য।মায়ের দেখে মেয়েটাও হয়েছে ঐরকম।কথা বলতে না বলতেই,‘বাপি কিছু ফান্ড ট্রান্সফার করে দেবে?’
-কত ? 
-বেশি নয়, হাজার পাঁচেক দিলেই হবে।
-হাজার পাঁচ!ভগবান, বাড়ি ভাড়া লাগেনা নিজেরা রান্না করে খায়, তাও হাত খরচ হাজার পাঁচ, সেটা আবার শেষ মাসে।প্রথমে আরেকপ্রস্থ পাঠানো হয়।মায়ের থেকে টাকা নেওযা তো আছেই।প্রকাশ ঘড়িটার দিকে আরেকবার তাকালো।দুটো চল্লিশ।সিগারেট খেতে হবে।খিদেও পেয়েছে।কি টিফিন দিয়েছে কে জানে?প্রকাশ ব্যাগ খুলে টিফিন কন্টেনার বের করল।মুড়ি, একটুকড়ো শশা।প্রতিদিন এক‌।নিকুচি করেছে টিফিনের।উঠে ডাস্টবিনে পুরো টিফিনটা ফেলে সমীরকে বলল,‘রায়বাবুকে বলবে খেতে যাচ্ছি।দেরি হবে একটু।’ম্যানেজার শোনে, কিন্তু রুমা শোনেনা।ব্যাঙ্কের দরজার বাইরে পা দেওয়া মাত্র মিস্ট্ কল।একসাথে পাঁচবার।প্রকাশ একটু বিরক্তির সাথেই ফোন ডায়াল করে বলল,‘কি হলটা কি?এত তাড়া কিসের?’
-কোথায় আছো?
-ভাগাড়ে।এইসময় কোথায় থাকি তুমি জানো না।
-শোনো আমি আজ বিকালেই তিন্নির কাছে যাচ্ছি।ওর শরীর খারাপ।তুমি এই কটা দিন একটু হোম ডেলিভারি থেকে আনিয়ে চালিয়ে নেবে।আমি কবে ফিরব জানিনা।
-তিন্নির কি হয়েছে? চমকে ওঠে প্রকাশ।
-শরীর খারাপ বললাম না।
-শরীর খারাপ শুনলাম, কিন্তু কি হয়েছে সেটা তো জানতে হবে।
-তোমার এইসব মেয়েলি ব্যাপারে নাক গলাতে হবেনা।
-অদ্ভুত তো।মেয়েটা কি তোমার একার?
-শোনো অতো বকার সময় নেই।আমি রাখছি, আর হ্যাঁ কিছু টাকা ট্রান্সফার করে দেবে। 
-কেন সিরিয়াস কিছু, ভর্তি করতে হবে?
-তুমি বড্ড ইনকুইজিটিভ হয়ে যাচ্ছ।
-এক কাজ কর কার্ড নিয়ে যাও সে রকম হলে কোথাও ভর্তি করে দেবে।ক্যাশলেশ হয়ে যাবে।
-তোমাকে যা করতে বললাম তাই কর।এরকম বেশলেশ কথা বলনা।আমি চিন্তা ভাবনা করে যেটা ভালো ভাবব, সেটাই করব।তোমাকে কিছু বলতে হবেনা।
-ভালো।আমি টাকা দেব, কিন্তু কোনো আলোচনাতে থাকব না?আমার মেয়ে অথচ শরীর খারাপ হলে কি করবে সেটা বলবারও অধিকার নেই।এই না হলে বাবা।তা তুমি যাচ্ছ যে তোমার অফিস কি হবে?
-ইন্টিমেসন দিয়ে যাচ্ছি, ছুটি নিয়ে নেবো।আর শোনো ডোন্ট বি সেন্টিমেন্টাল প্রকাশ।এখন ওসবের সময়ও নেই, লেট হার কিওর সুন।
প্রকাশ অনেকক্ষন ধরে চেপে রাখা একটা শ্বাস ছাড়তে ছাড়তে বলল,‘আমি একবার তিন্নিকে ফোন করছি।’
- না না।রূমা প্রায় চমকে উঠল।
-না না মানে ?
-ওকে এখন ফোন করতে হবেনা।আমি পৌঁছে সব কিছু তোমাকে জানাব। 
রুমার ফোনটা রাখবার সঙ্গে সঙ্গে প্রকাশ কিছুসময় হতভম্ভ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।কি হল তিন্নির! আর খাবার মুখে উঠবে না।এক কাপ চা  বলল।বিস্কুটটা ভিজিয়ে মুখে তোলার আগেই মাটিতে পড়ে গেল।
এরা বড্ড বেশি চিন্তা দেয়।রুমার এই স্বভাবটা ইদানিং হয়েছে।আগে এরকম করত না।কথাবার্তা সমস্ত কিছু শেয়ার করত।এমনকি চাকরি পাবার বছর দুই পরে আপার ডিভিসনের একটা ছেলেকে ভালো লাগত।সে কথাও গোপন করেনি।তিন্নির স্কুলে পড়বার সময় ম্যাথসে রিপিটেড কম নম্বর পাওয়া, বা এক বন্ধুর বার্থডে পার্টিতে ড্রিঙ্ক করে বাড়ি আসা, সবেই প্রকাশের থেকে রুমাই বেশি বলত। সেসময় বরং প্রকাশ বোঝাত, শান্ত করবার চেষ্টা করত।এইচ.এস পাস করবার পরেই সব হিসাব কেমন যেন গোলমাল হয়ে যেতে আরম্ভ করল।উল্টে যেতে লাগল সব কিছু।তিন্নি কোনরকমে ফাস্ট ডিভিসনে পাশ করল।প্রকাশ বলল,‘শোনো ওর যা মেরিট তাতে সাধারণ লাইনে গ্র্যাজুয়েশন করুক।তারপরে না হয় কোন একটা প্রফেসনাল কোর্স করানো যাবে।’
রুমা প্রথমে সব কথা শুনেও ছিল।প্রকাশের কথাতে রাজিও হল।কিন্তু বাধা এল রুমার দিদির কাছ থেকে।দিদির ছেলেটাও হায়ার সেকেণ্ডারি পাশ করেছে।জামাইবাবু একটা সরকারি জীবনবিমা কম্পানি ডেভেলপমেন্ট অফিসার।হাবেভাবে টাকা আছে জাহির করে।কথায় কথায় বলে,‘বুঝলে ভায়া সন্ধেবেলা ঠিক জল খেতে ইচ্ছে করে না।’ ঘরে ড্রিঙ্ক ক্যাবিনেটও আছে।বছরে দু’একবার প্রকাশও যায়।তবে দুইবোনের সাথে কি সব কথা হয় কে জানে?
 একদিন অফিস থেকে প্রকাশ বাড়ি ফিরতেই রুমা বলে,‘তিন্নিকে এঞ্জিনিয়ারিংএ ভর্তি করে দাও।রাকাও ভর্তি হচ্ছে।’
-কোথায় ?
-কোলকাতায়। 
কথাগুলো শুনে প্রকাশ এক্কেবারে আকাশ থেকে পড়ল।রুমার দিকে তাকিয়ে বলে উঠল,‘আরে দাঁড়াও, আমি সব কিছু আগে ভেবে দেখি।কোন কলেজ, কি তার ইনফ্রাস্ট্রাকচার, ক্যাম্পাসিং কি হচ্ছে, এই সব কিছু না দেখে শুনে তো আর ভর্তি করা যায় না।তাছাড়া এখন এঞ্জিনিয়ারিংএর বাজার ভালো নয়।’
-ও সব কিছু তোমাকে দেখতে হবে না।তুমি ও’সব বুঝবেও না, তার থেকে যে দেখছে তার ওপরেই সব কিছু ছেড়ে দাও।
-কার ওপর, তোমার জামাইবাবু?তা হলেই হয়েছে।
- সে তো হবেই দু দুটো ফ্ল্যাট, গাড়ি, সব তো তুমি কিনেছ তাই না ?
- বাদ দাও। 
-বাদ দেওয়ার কিছু নেই, জামাইবাবু সব কিছু দেখে এসেছে।খোঁজ খবরও নিয়েছে।রাকা তিন্নি দুজনাই ওখানে ভর্তি হবে।
-থাকবে কোথায়?
-কেন, গড়িয়াতে জামাইবাবু অতো বড় ফ্ল্যাট কিনেছে, ওখানেই থাকবে।
-শুধু দু’জন এই বয়সে এক সাথে!ব্যাপারটা ক্রুশিয়াল হয়ে যাবে না?
-তোমার কাছে হতে পারে, আমার কাছে নয়, ওদের কাছে তো নয়ই।তাছাড়া মাঝে মাঝে আমরা যাবো, জামাইবাবুরা যাবে।
 প্রকাশ আর কথা না বাড়িয়ে উত্তর দিল,‘ভালো।সবই যখন ঠিক করেই নিয়েছ তখন আর আমাকে বলবার কি হয়েছে?’ 
রুমার কথামতই তিন্নি ভর্তি হল।ক্লাসও চলল।সাত মাস কেটেও গেল।তারপরেই একদিন অফিসে ফোন করে রুমার এই সব কথা বলে, তিন্নির শরীর খারাপ নিয়ে এই রকম অদ্ভুত নাটক তৈরি করে, এই রকম আচমকা চলে যাওয়া। 
রুমা ফোন করতে বারণ করলেও প্রকাশ তিন্নিকে ফোন করে।এক, দুই, তিন বার।না ফোন সুইচ্ট্ অফ্।রাকাকেও ফোন করে।বেজে গেল, ধরল না।
রুমার ফিরতে ফিরতে দিন দশ কেটে গেল।এর মাঝে প্রতিদিনই প্রকাশ ফোন করে যাওয়ার কথা বলতেই রুমা বলে ওঠে,‘ না না আমি যখন তোমাকে বারণ করেছি তখন তুমি আসবে না।’  একদিন অফিস ফেরত রাকাকেও ফোন করে এই ব্যাপারে জিজ্ঞেস করল।রাকাও কোন স্পষ্ট উত্তর না দিয়ে ফোন কেটে দিল।সীমা আবার নিজের বোন রুমাকে দোষ দিয়ে বলল,‘আমার বোনটাই বাজে।সাধারণ একটা ঘটনাকে তাল বানিয়ে দিল।’ভাইরাভাই আবার হাসতে হাসতে  বলে উঠল,
‘আমি আবার ওসব মেয়েলি ব্যাপারে থাকিনা।’
 তিন্নি বাড়িতে ফিরে আসার পরেও প্রকাশ কিছুই জানতে পারেনি।তিন্নি সব সময় চুপ থাকে।রুমাকে কিছু প্রশ্ন করলেই রেগে রেগে উত্তরটা দেয়,‘তুমি বড্ড বেশি মেয়েলি স্বভাবের হয়ে যাচ্ছ।মেয়ের গাইনোকলজিক্যাল প্রবলেম, তোমাকে সব জানতে হবে?যেগুলো মেয়েলি ব্যাপার সেগুলো আমাদের মধ্যেই রাখতে দাও।তুমি ফল টল আনো।ওকে এখন বেশি করে ফল খেতে হবে।আর একটু সুস্থ হলে এখানকার কোন একটা কলেজে ভর্তি করে দাও, ও আর ওখানকার কলেজে পড়বে না।’
এরপর প্রকাশ আর একবারের জন্যেও কাউকে কোন প্রশ্ন করেনি।অফিস থেকে দেরি করে বাড়ি ফিরে খেয়ে শুয়ে পড়ে।ছুটির দিনে কোন না কোন কাজ নিয়ে বাইরে বেরিয়ে যায়।রুমার কথা মত তিন্নিকে একটা প্রাইভেট কলেজে একটু বেশি ফিস দিয়ে ভর্তি করে দিয়েছে।এরপর শুধু ফল কেনা, টাকা পয়সা দেওয়ার কোন রকম গাফিলতি করেনা।প্রয়োজনের থেকে বেশিই কেনে।ফল পচে যায়, জামাকাপড় আলমারি ছাড়িয়ে যায়।কারোর সাথে কোনরকম অতিরিক্ত কথা বলেনা।একদিন শুধু একটা দরকারে তিন্নির আলমারি খুলে একটা ব্যাগ বের করে প্যান ক্যাড আর আধার কাড বের করেছে, তাও অবশ্য তিন্নিকে বলেই।এর বেশি আর কিছু না।
প্রকাশের নিরুদ্দেশ হওয়া প্রায় মাস সাত হয়ে গেল।তিন্নি ও রুমা অনেক চেষ্টা করেও প্রকাশের কোন ঠিকানা জোগাড় করতে পারল না।এমনকি মানুষটা বেঁচে আছে না মারা গেছে, প্রথম কয়েক দিন তো সেটাই বুঝতে পারেনি।সাতদিন পরেই তিন্নির মোবাইলে ব্যাঙ্কে দ্বিতীয়বারের জন্যে টাকা ক্রেডিট হওয়ার মেসেজ আসে।ব্র্যাঞ্চে গিয়ে শোনে ড্রপ বক্সের চেক থেকে ক্যাশ করা হয়েছে।যে ফেলেছে তার ঠিকানা বলা সম্ভব নয়।প্যান নম্বর দেওয়া থাকায় সমস্যা হওয়ারও কোন কথা নয়।তবে ব্রাঞ্চের এক চেনাজানা কাকুকে প্রকাশের কথা জিজ্ঞেস করতে উনি বলেন,‘উনি তো ভি.আর.এস দিয়ে দিয়েছেন, এখন কোথায় আছেন কেউ জানেনা।টাকা পাবার আগে মাঝে মাঝেই আসতেন, সব টাকা পেয়ে যাওয়ার পরে আর তো আসেন নি।’এর মাঝে মা মেয়েতে অবশ্য অনেক জায়গায় ঘুরে বেরিয়েছে।আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু বান্ধব বাদ পড়েনি কেউই।সবার মুখে সেই এক কথা।মাঝে অবশ্য বেশ কয়েকবার তিন্নির মোবাইলে টাকা জমা পড়বার মেসেজ এসেছে।রুমা ও প্রকাশের জয়েন্ট আকাউন্টেও টাকা জমা পড়বার মেসেজ এসেছে।এই কয়েকমাসে দিদির সাথে সম্পর্ক খারাপ হয়ে গেলেও দিদি জামাইবাবু এমনকি রাকাও এসেছে।সব শুনে পাশে থাকবার আশ্বাস দিয়ে গেছে।প্রকাশকে খোঁজার চেষ্টা করবার কথাও বলেছে।কিন্তু সেখানে  কিছুই লাভ হয়নি।
দিনদিন তিনকামরার ফ্ল্যাটের ভিতরের শূন্যতা দুটি মানুষকে গ্রাস করে ফেলেছে।সেই একাকিত্ব এতটা তীব্র, কষ্টদায়ক, এর আগে কোনসময় কেউই বোঝেনি।অথবা বোঝবার চেষ্টাও করেনি।প্রয়োজনের আগেই প্রয়োজন মেটানোর যে দায় একজন কাঁধে চাপিয়ে নিয়েছিল, তার কাঁধের ব্যথা বা না ব্যথার কথাও কেউ জিজ্ঞেস করেনি।কিন্তু আচমকা কাঁধ অর্ধেকটা সরে যাওয়াতে ভূমিকম্পের আরম্ভ।সেখান থেকেই টালমাটাল অবস্থা। 
রুমা বা তিন্নিকে হাতে হাতে সব কাজ আরম্ভ করতে হল।সেই দোকান, বাজার, ইলেকট্রিক বিল এমনকি ব্যাঙ্কে লাইন দিয়ে টাকা তোলা।দুজন এক সাথে এই প্রথম তৃতীয় আরেকজনের জন্যে অকাতরে কাঁদতে আরম্ভ করল।অবশ্য এই কান্না তৃতীয়জনের অলক্ষে।
রুমা এই কয়েকমাসে নিজের অফিস আর বাড়ির চাপে আরো অসুস্থ হয়ে গেল। কথায় কথায় রেগে যায়, তিন্নির ওপর তো এক্কেবারে খাপ্পা হয়ে থাকে।মাঝে মাঝে হাতও চালিয়ে দেয়।তিন্নিও গুম হয়ে থাকে।কিছু বলতে পারেনা।কলেজেও নিয়মিত যায়না,টিউসনেও অনিয়মিত।নিজেকেই সব সময় দোষারোপ করে, মাঝে মাঝে নিজেকে শেষ করে দেওয়ার কথাও ভাবে, পরেই আবার নিজেকে সামাল দেয়।মাকে মাঝে মাঝেই ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে হয়।এমনি চেক আপ হলেও ডাক্তার বলেন, টেনসেনের থেকে হাইসুগার ধরেছে, সঙ্গে প্রেসার, কোলেস্টেরল রক্তে ক্রিয়েটিনিন বেশি থাকায় কিডনিও কিছুটা আক্রান্ত হয়ে গেছে।নিশ্চিন্তের বিশ্রাম দরকার, শারীরিক ও মানসিক।অফিস থেকে ছুটি নেয়, কিন্তু মানসিক বিশ্রাম ?
আরো দুই মাস পরে এক দুপুরে খেতে বসে ভাতের থালাতে আঙুল দিয়ে নাড়াচাড়া করবার সময় দিদির ফোন পেয়ে রুমা চমকে ওঠে।ফোনটা রেখেই মাখা ভাত ফেলে তিন্নিকে বলে,‘রেডি হয়ে নে, মাসিরা আসছে।তোর বাবাকে খুঁজে পাওয়া গেছে, তবে কোথায় জানিনা, মেসো জানে।’
কলকাতা শহর ছাড়িয়ে গাড়ি ছুটে যায় উত্তর চব্বিশ পরগণার বাংলাদেশ সীমান্তের দিকে।রুমা তিন্নি ছাড়াও দিদি জামাইবাবু এমনকি রাকাও সঙ্গে থাকে।অবশ্য রাকা আর তিন্নি দুজন বসে দু’প্রান্তে।একজন পিছনের সিটে একজন সামনের সিটে।গ্রামের মেঠো রাস্তার বুক ধরে কিছুটা গিয়ে গাড়ি দাঁড়াল একটা ছোটগাছ আর বাঁশের বেড়া দিয়ে ঘেরা জায়গায়।অনেকটা জায়গা।ভিতরে ছোট ছোট ঘর।গাড়িতে যেতে যেতে রুমা শুনল জামাইবাবু আগে একবার নিজে এসে সব খোঁজ খবর নিয়ে গেছে।প্রকাশের সাথেও দেখা করে সবাইকে নিয়ে আসবে কিনা জিজ্ঞেস করেও গেছে।প্রকাশের একটা জীবনবীমার পলিশি ম্যাচুরিটি হয়ে যাওয়ার সূত্র ধরেই গোপনে খোঁজ খবর চালিয়ে  প্রকাশের ডেরা খুঁজে পেয়েছে।গাড়ি থেকে নেমে দিদি জামাইবাবু রুমা আর তিন্নিকে ভিতরে যেতে বলে নিজেরা বাইরে দাঁড়িয়ে থাকে।রুমা জিজ্ঞেস করলে উত্তর দিল,‘তোমরা আগে যাও আমরা একটু পরে যাচ্ছি।’
বাইরে তখন পচা ভাদ্রের রোদ।শরীরে আছড়ে পড়া ঝলসানো আলো আর তাপ সহ্য করে রুমা আর তিন্নি এদিক ওদিক তাকিয়ে ঘেরা জায়গাটার ভিতরে ঢুকে এগিয়ে চলে।কিছুদূর যাওয়ার পরেই কমবয়সি একটা ছেলে জিজ্ঞেস করল,‘আপনারা কি কাউকে খুঁজছেন?’ রুমা একটু আমতা আমতা করে সব কিছু বলতেই সেই নাম না জানা ছেলেটি একটা ঘরের দিকে আঙুল তুলে দেখিয়ে বলে,‘উনি এখন ঐ’ঘরে ক্লাস নিচ্ছেন।’
-ক্লাস নিচ্ছেন!
চাকরি পাবার আগে প্রকাশ চাকরির পরীক্ষা দেওয়ার পাশে টিউসন করত।চাকরি পাবার পরেও প্রথম দিকে অভ্যাসটা চালিয়ে গেছিল।তারপর টুকটাক একে ওকে এমনি দেখিয়ে দিলেও আর টিউসন আরম্ভ করেনি।তিন্নিকে পড়াত।নিজেও অবসর সময়ে চাকরির বিভিন্ন বইপত্র নাড়াচাড়া করত।রুমা কিছু জিজ্ঞেস করলে বলত,‘আপডেট থাকা যায়।’ 
 কিন্তু সেদিন কথাগুলো শুনে দুজনেই অবাক হয়ে একে অন্যের দিকে তাকিয়ে ছেলেটির দেখানো ঐ’ঘরটির দিকে এগিয়ে এসে দরজার সামনে দাঁড়াল।ঘরের ভিতর তখন তিন্নির বয়সি বা ছোট  বড়, জনা কুড়ি ছেলেমেয়ের সামনে ক্লাস নিচ্ছে প্রকাশ।দরজার বাইরে দুজনকে আকস্মিক দেখে প্রথমে কেউ কোন কথা বলতে পারল না।কিছু সময় পরে  প্রকাশ বলল,‘আমার ঘরে গিয়ে বোসো আমি আসছি।’ তারপরেই একজন ছাত্র এগিয়ে এসে রুমা আর তিন্নিকে প্রকাশের ঘরে বসিয়ে এল।রুমা ও তিন্নি ঘরের ভিতরে একটা তক্তার ওপর বসে চারদিকটা দেখতে লাগল।সাদামাটা ছিটে বেড়ার ঘর।দুটো জানলা আছে।একটা টুলের ওপর রাখা রয়েছে একটা টেবিল ল্যাম্প।চারদিকে ঝোলানো রয়েছে কয়েকটা শার্ট, প্যান্ট কয়েকটা গেঞ্জি।এককোণে থাক থাক করে বেশ কয়েকটা বই।দরজার বাঁদিকের দেওয়ালে টাঙানো রয়েছে রুমার শ্বশুর শাশুড়ির একসাথে একটা ছবি।নতুন ঘরে আসার পরে ছবিটা স্টোররুমের স্ল্যাবে তোলা ছিল।
কিছুসময় পরে প্রকাশ ঘরের ভিতর আসতেই রুমা বেশ উত্তেজিত ভাবে বলে উঠল,‘এর মানে কি?এরকম ভাবে কাউকে কিছু না বলে চাকরি বাকরি ছেড়ে, এই অজ গ্রামে এসে তুমি কি আরম্ভ করেছ?’
-চা খাবে? এই কয়েকমাসেই তো খুব রোগা হয়ে গেছ।
-যা জিজ্ঞেস করলাম উত্তর দাও।
প্রকাশ একটা শ্বাস নিয়ে বলল,‘আমাকে আর তোমাদের দরকার নেই এই সত্য উপলব্ধি করেই চলে এলাম।তবে তোমাদের কাউকে ঠকায় নি।ব্যাঙ্ক থেকে একপয়সাও তুলিনি।যা টাকা পেয়েছি সব দিয়ে দিয়েছি।’
-বাবা সব কিছু কি টাকার হিসাবে মেলে, না চলে?
-ঠিক তো আজ তোরা বুঝেছিস, কিন্তু যেদিন আমার আপত্তি অগ্রাহ্য করে মায়ের কথা শুনে রাকার সাথে থাকতে গেলি, তারপর..................।প্রকাশ একটা লম্বা শ্বাস ফেলে কথা বন্ধ করে দিল।পাশ থেকে তিন্নি বলে উঠল,‘থামলে কেন?বল............’
-থাক।আমার কাছে তো সব কথাই গোপন করেছিলি, তাই না।খুব রাগ হয়ে ছিল, ভাবলাম এবার তোরা তোদের মত করে থাক আমি আমার মত।তবে এখন আর অতটা রাগ নেই ,তোদের খুব দেখতে ইচ্ছে করছিল।
প্রকাশের কথা শুনেই রুমা তিন্নি দুজন দুজনের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।কিছুসময় পরে তিন্নি বলে,‘আমি তো কিছু গোপন করিনি বাবা।’প্রকাশ মুচকি হাসে,‘সবাই খরগোশ নয় রে।’ তারপর আবার কিছুসময় চুপ থেকে বলে,‘জানিস আমাদের সমাজ, শাস্ত্র, কাছের আত্মীয়দের সাথে বিয়ের অনুমতি দেয় না, তবে আগে দিত।মহাভারতে অনেক উদাহরণ আছে।আবার তুতেনখামেন তার নিজের বোন আনাক-সু-নামুনকে  বিয়ে করেছিল।দক্ষিণ ভারতের কয়েকটি সম্প্রদায়ের মধ্যে এই বিয়ে এখনো প্রচলিত।’
-এসব আমাকে বলছ কেন?আমি জেনে কি করব?
প্রকাশ তিন্নির মুখের দিকে তাকিয়ে বলে,‘আসলে এখানে ক্লাস নেওয়ার ফাঁকে শুধু তোর কথাই ভেবেছি, ভেবেছি ভুল কার তোর, না আমার ?’
-তুমি যে কি বলছ  কিছুই বুঝতে পারছি না।
 একটা লম্বা শ্বাস ফেলে প্রকাশ বলে উঠল,‘তোরা কিছু না বললেও আমি কিছুটা আন্দাজ করেছিলাম।তোর মনে আছে একদিন তোর আলমারি খুলে তোর প্যান ক্যার্ড বের করেছিলাম, সেদিন ব্যাগের মধ্যে নার্সিংহোমের একটা ফাইল পাই।প্রথমে ভয় লেগে গেছিল তারপর কয়েকটা পাতা পড়তেই ব্যাপারটা পরিষ্কার হল।তাও রাকাকে ফোন করে ওর কলেজ গেলাম।প্রথমে রাকাও সব অস্বীকার করছিল, একটু জোর করতে হয়েছিল, বুঝলাম এত বড় ঘটনা যখন আমার কাছেই গোপন করা হল, তখন তোদের কাছে আমার কোন মূল্যই নেই।’
রুমার গলাতে অবাক হয়ে যাওযার স্বর।‘না শোনো তুমি ব্যাপারটা ওরকম ভাবে ভেব না।আসলে তিন্নির সাথে আমার নিজেরও খুব লজ্জা করছিল।তিন্নি যে এত বড় একটা ঘটনা ঘটিয়ে ফেলবে ভাবতে পারিনি।’
-এটা তোমার দূরদৃষ্টির অভাব রুমা।আমি কিন্তু প্রথমদিনেই বলেছিলাম।তুমি বিশ্বাস করনি আমার ওপরেই রেগে উঠে বলেছিলে,‘নোংরা হয়ে যাচ্ছ, তুমি, ভাই বোন একসাথে থাকবে তাতে এরকম ভাবাটাই অন্যায়।’
-তুমি বিশ্বাস কর আমার খুব খারাপ লেগেছিল।
-খারাপ!কিসের খারাপ?সব কিছু হয়ে যাওয়ার পরে খারাপ?রুমা আমরা তো বুদ্ধি দিয়ে নিজেদের নিয়ন্ত্রন করি।এখানে খারাপ ভালোর তো কোন প্রশ্ন নেই।দুটো টিন’এজ ছেলেমেয়ে এক সাথে এক ঘরে থাকলে অনেক কিছুই হতে পারে, সেখানে অনেক সম্পর্কই গৌণ হয়ে যায়।আবার একটা দুর্ঘটনাও ধরা যায়।
-তোমার কথা শুনে মনে হচ্ছে, তুমি এখন সব সাপোর্ট করছ।এমনি ভাবে তুমি সবকিছু মেনে নেবে?তুমি এমন ভাবে বলছ যেন কোন ব্যাপারই ঘটেনি।বিয়ে, মহাভারত সব কিছু নিয়ে আসছ।
-আমাদের এই বাংলার হিন্দু সমাজে এইরকম মাসতুতো ভাইবোনের মধ্যে বিয়ের প্রচলন নেই।তবে ওদের ক্ষেত্রে আমার মেনে নেবার বা না নেবার সাথে কি কিছু এসে যায়?যেটা ওরা ঠিক করবে সেটাই হবে।আমি অবশ্য এটাও জানিনা ওদের এটা প্রেমশূন্য না অন্যকিছু?
-না, ওদের ঠিক করবার কিছু নেই।রাকার সাথে তিন্নি এখন আর মেশে না।
-বেশ ভালো তো।তবে বিপদের আগে সাবধান করতে হয়, কিন্তু বিপদে পড়লে তো সাহায্য করতেই হবে।
প্রকাশ আরো কিছু বলতে যাচ্ছিল।তিন্নি থামিয়ে বলে উঠল,‘বাবা, তুমি কবে ফিরে আসবে বল?’ প্রকাশ হাল্কা হেসে উঠল,‘মা’রে  তোদের জন্যে মন খারাপ করলেও এখানে দিব্যি আছি।সকালে একটা স্কুল চলে বিকালের দিকে আশেপাশের ছেলে মেয়েদের প্রতিযোগীতামূলক পরীক্ষার প্রস্তুতি হয়।আজকে অবশ্য স্কুল ছুটি তাই ওরা এই সময় ক্লাস করছে।এরা সবাই আমাকে খুব ভালোবাসে, শ্রদ্ধা করে।বেশ ভালো আছি বুঝলি, বেশ ভালো।’
-তাহলে আমরা কি করব?রুমা প্রকাশের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল। 
-তোমার দিদি জামাইবাবু এসেছে তো?’
-রুমা কিছুসময় চুপ থেকে উত্তর দিল,‘হ্যাঁ।’ কথাতে জড়িয়ে থাকা কান্নাটা প্রকাশের কানে গেল।
-ওদের ডাকো।তারপরেই তিন্নির দিকে তাকিয়ে বলে উঠল,‘কিরে তুই কি করবি?রাকাকেও ডাকব?’
রুমা তখন সেই মাত্র উঠে বাইরে  দিদি জামাইবাবুদের ডাকতে যাচ্ছিল।তিন্নি পিছন থেকে ডেকে বলে উঠল,‘মা, দাঁড়াও।মাসিদের ডাকতে হবে না।’তারপরেই প্রকাশের দিকে তাকিয়ে বলল,‘বাবা যেটা বেরিয়ে গেছে সেটা শুধু মাত্র  একটা  প্রাণ ছিল না।তাও বলছি সব দোষও আমার, ভুলও। আমাকে আর একটা সুযোগ দেবে না?আমি আর ঐ সম্পর্কের কথা ভাবতেও চাইনা।শুধু তোমাকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে চাই।তুমি বাড়ি ফিরে চল।’ 
বাইরে তখন দারুন রোদ।গরম হাওয়া দরমার ঘরে ঢুকলেও প্রকাশের বেশ শান্তি লাগল।তিন্নিকে কাছে ডেকে মাথায় হাত বুলিয়ে বলে উঠল,‘খেপি একটা।’