অনুবাদ  




ওড়িআ অণুগল্প : অনিল কুমার পাঢী
বাংলা অনুবাদ :  প্রদীপ কুমার রায়



হোম‌  ডেলিভেরী       

আমার বালকোনী তে টবে কিছু কলম গাছ । একহাত , দেড় হাত উঁচু গাছে আম  , সেও , কমলা ।
এসব আমাকে যতটা প্রলুব্ধ করে , ততটা ভারাক্রান্ত ও করে । যেমন কি মুক্ত এবং অবাধ বাড়বার এই গাছগুলোকে জোর করে ছোট্ট করে দেওয়া হয়েছে । প্রত্যেকটি গাছ কে ছুঁয়ে দেখার সময় আমি অনুভব করি তার ভেতরে লুকিয়ে থাকা অশ্রু আর ব্যথা । সত্যি , কেউ ত এদেরকে শৈশবে মাতৃত্ব প্রদান করেছে। যন্ত্রণাদায়ক অবাঞ্ছিত মাতৃত্ব !

কলিং বেল বাজল । গেটে খুলে ভেতরে চলে এসেছে এক মহিলা , কোলে এক ছোট্ট মেয়ে , সঙ্গে আ‌র এক মেয়ে ।

_ কাজ পাওয়া যাবে ? মহিলা জিজ্ঞাসা করে । যেমন কাজ হলে ও চলবে - সে বলে । - আমার এই মেয়ে সব ধরণের কাজ  করতে পারে ।
তখন আমার নজর মেয়েটির উপরে পড়ে । আনুমানিক দশ কি এগারো বছরের হবে ।অথচ লাগছে কুড়ি বছরের যুবতী । আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকি ।
_ মেয়ের কথা ভাবছেন ! ওর বয়স এগারো বছর । এই মাঘ মাসে বারো তে পড়বে ।সব ধরণের কাজ ও করতে পারে ।
বারবার সব ধরণের কাজ করতে পারে বলার অর্থ কি ! কি কাজ !
_ মা ঝিলি , বাবুকে বলে দে , তুই কি সব কাজ করতে পারিস ।
ঝিলি আমার কাছে এগিয়ে আসে , এক্কেবারে কাছে । ফিসফিস করে আমার কানের কাছে যা সব বলে, শোনার পর আমার বাক্ রুদ্ধ হয়েযায় ।
এবার মেয়েটি তার মা কে বলে - মা তুই মিলিকে নিয়ে এখানে বসে থাক , আমি কাজ শেষ করে আসছি ।
তারপর আমাকে বলে - চলুন !
আমি  জোরকরে মেয়েটিকে ঠেলে দিয়ে দরজা বন্ধ করি ।

আধঘন্টার পর বালকোনী র দরজা খুলি । একটি কলম গাছের টব উল্টে পড়েছে । সেই টবকে সোজা করে রাখতে রাখতে রাস্তা র দিকে তাকাই  । আমার ঘরের পাঁচটা ঘরের পর , ছয় নম্বর ঘরের গেটের পাশে মহিলাটি কোলে ছোট্ট মেয়েকে নিয়ে বসেছে ।

ঝিলি  আশেপাশে নেই ........!
                       



 মৃণ্ময়ী 

হঠাৎ ই বৃষ্টি নামলো । আমি শহর থেকে কিছু দূরে । আমার কাছে এই অসময়ের বৃষ্টির জন্য রেনকোর্ট নেই । আশেপাশে তাকাই । কিছু দূরে এক বাড়ি দেখতে পারি । আমি সেই বাড়ির দিকে পা বাড়াই ।

" নিঃসংগ নিলয় " লেখা ছোট্ট  ফলকের উপর নজর পড়তেই আমি সচেতন হয়ে যাই । নিসংগতা  ফেমিনাইন বলে আমি মনেকরি । তবে কি এই বাড়িটা কোনো নিঃসংগ  মহিলার ঘর ! একা এক মহিলার বাসায় আমার মতো এক সচেতন পুরুষ কি  কিছু সময়ের জন্য আশ্রয় নেওয়া ঠিক হবে ! ভাবতে ভাবতে কখন যে আমি দরজায় টোকা দিয়ছি বুঝতে পারিনি ।
দরজা খুললেন এক মহিলা । শুভ্র বস্ত্র পরিহিতা , রোগিনী ভ্রমিত রূপকান্তি , উন্মুক্ত কেশা দেবী  ।
মনটা একটু হালকা আবার ভারাক্রান্ত হয়েগেলো । বোধহয় বিধবা ।
_ আসুন ভাই ।  ভেতরে আসুন । খুবই আদর করে ড়াকলেন ।
আমি এক কাঠের চেয়ারে বসি । চা আর কিছু জলখাবার গ্রহণ করি । ফিরে আসার সময় তিনি বলেন - এই বোনের বাড়ি আর কবে আসবেন  ?

ফেরার পথে  আমি ভাবতে থাকি  , এই পৃথিবীর সবাই যখন সম্পর্কহীনতায় মেতে উঠেছে , তখন প্রথম দেখায় আমাকে ভাইর মর্য্যাদা দিয়েছেন  যেই নারী , সে কতটা মহান !

কবে কবে শহরে ফেরার পথে আমি ওনার কাছে গিয়েছি , স্নেহ পেয়েছি , সম্পর্কের নিবিড়তা বুঝেছি। সে বলেন -  যখন যে তোমার কাছে আছে , তার প্রতি সমর্পিত হও । তাকে আপনার কর । সেইটাই তো সম্পর্ক ।

আমাদের কলোনি র মা দুর্গা র মৃণ্ময়ী মূর্তি বানানো হবে । নিষিদ্ধ অঞ্চলের মাটি নিয়ে আসতে আমাকে দায়িত্ব দেওয়া হয় । শহরের কিছু দূরে এক নির্দিষ্ট অঞ্চলকে আমার যাওয়ার কথা । দুর্যোগের ব্যাপার  সেই মহিলার বাড়ির কাছাকাছি আবার বৃষ্টি নামলো । আমি ওনার কাছে আশ্রয় নিলাম ।

মাটি আনার কথা তাই আমি উপোসে ছিলাম । এইটাই তো নিয়ম । আমাকে বারবার খাওয়ার জন্য অনুরোধ করে ও বিফল হয়ে তিনি জিঞ্জাসা করলেন- কি ভাই , আমার ওপর রাগ করেছো ?

আমি কি বলি ! মাটি আনার কথা কিভাবে বলি !
উনি বললেন - তোমাকে আমার দিব্বি ভাই বলো , কি হয়েছে !
আমি বাধ্য হয়ে নিষিদ্ধাঞ্চলে আমার মাটি আনতে যাওয়ার কথা বলি ।
- ওঃ... এই কথা  !
- তিনি ভেতরে চলে যান ।
- ছোট্ট এক মাটির  কলসি তে মাটি ভর্তি করে নিয়ে এসে আমাকে বাড়িয়ে দিয়ে বলেন - নাও ভাই ।

আমি সেই নিঃসংগ নিলয়ের ভেতরের দাঁড়িয়ে পাথর পাল্টে যাচ্ছিলাম । আমার সামনে কোনো মহিলা ছিলেন না । যেমন নিষিদ্ধ মাটি হয়ে সে সেই মাটির কলসি র ভেতরে......!
                     

অনিল কুমার পাটী। জন্ম ৯ই এপ্রিল ১৯৬৯। পেশায় ইংরেজি ভাষা সাহিত্যের অধ্যাপক। বই আকারে প্রকাশিত হয়েছে ১৫টি গল্প সঙ্কলন, ৫টি উপন্যাস, ২টি গদ্য সঙ্কলন ও একটি কাব্যগ্রন্থ। 'সর্বভারতীয় কথা স্টোরি এওয়ার্ড', 'ঝঙ্কার বিষুব গল্প সম্মান', 'কাদম্বিনী সম্মান' সহ অজস্র সম্মানে সম্মানিত হয়েছে তাঁর কলম।