।। মুক্তগদ্য ।।
হামাগুড়ি ও খিস্তি পাঠের প্রায়ান্ধকার
গালাগালিগুলো কাস্তের মতোই ধারালো।
ধান কাটতে গেলে কাস্তে + শরীরের শক্তি বা বল প্রয়োজন। মহাভারতের ধর্মযুদ্ধে ব্যবহৃত বাণের মতোই এগুলোরও ভিন্ন ভিন্ন প্রয়োগ শৈলী আছে। শক্তি ও সামর্থানু্যায়ী এদের সঠিক কাজে লাগানো নিপুণ অস্ত্রবিদ্যার চেয়ে কিছু কম নয়। এযুগের ভারতবর্ষে বহু কুশল যোদ্ধা বর্তমান। তারা কেউ কেউ ক্ষমতায় ও বিরোধী আসনে সচল।
বর্তমান আর্থ-সামাজিক রাজনৈতিক স্যোশাল ও নৈতিক সংকট মূহুর্তে আতঙ্কিত আমাদের দৈনন্দিন জীবন। এটা সহজ ভাবেই মেনে নিয়েছি আমরা।আবার যারা মেনে নিতে পারেননি তাদের অক্ষমতা তাদের জীবনকে বাধার সন্মুক্ষিণ করেছে। একে প্রতিহত করা কতিপয় জনতার কাজ নয়। এর বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধ সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে। কিন্তু কীভাবে সংগঠিত হবে?
কৃষি প্রধান আমাদের দেশ। কাস্তে কৃষকের হাতিয়ার। কাস্তে+হাতুড়ি+তারা = মার্কসবাদ নয়। আবার কাস্তে+হাতুড়ি+তারা = কমিউনিজমও নয়, তাহলে কী?
সহজ ভাবে বলতে গেলে- আমি+তুমি+সে=আমরা হলে আমাদের জীবন = যদি
শিক্ষা+স্বাস্থ+খাদ্য+বাসস্থান হয় তাহলে সেটাকে বাস্তবায়নের প্রয়োজন। কে মেটাবে আমাদের প্রয়োজনগুলো?
এরকম নানান প্রশ্নচিহ্ন এঁকে ফেলা যায়।! কিন্তু কীহবে এসব ভেবে? আজ অধিকাংশ মানুষের সেই মত। 'শোষণ' শব্দটি শ্রেণি সংগ্রামেরই অলঙ্কার এর সঙ্গে 'পোষণ' শব্দটিও জুড়েছে। 'স্বজন-পোষণ' সকলের খুব জানা দুটি শব্দের মেলবন্ধন। এই শব্দ বন্ধনী দুটোই বর্তমান রাজনীতির জোরালো হাতিয়ার।
এখন- আমাদের হাত বদলে অস্ত্র চলে গেছে অন্যের হাতে। কারন- আমাদের হাত মজবুত ছিল না। শিশুর হাতে খেলনার মতোই অবলুপ্ত হয়েছে বয়সের নিরিখ। আমরা বদলে গেছি। আমরা আসলে যেমন ঠিক ভেতর ভেতর তেমন নই। একের অধিক প্যারালাল সরলরেখার মতোই আমাদের অন্তরের সত্ত্বা আবহমানকাল বহমান। নদীর মতোই বহুরৈখিক ছন্দময় জীবন শৈলীতে নিজেকে ভাঙতে ভাঙতে এগিয়ে নিয়ে গেছে সভ্যতার ইতিহাস।
গালিগালাজ=খিস্তি। খিস্তি হলো- এক অর্থে ঠিক পলিসির মতো। বিক্রেতার কাছে কোনো প্রোডাক্ট নেই। শুধু সাজানো গোছানো অক্ষর বিন্যাসের প্রেজেন্টেশন। যিনি ক্রেতা তিনি নিশ্চয়তা কিনলেন। ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়েরই সন্তুষ্টি। পলিসির মতোই খিস্তিরও শ্রেণি বিভাগ আছে। ব্যক্তি বিশেষের তারতম্যে তার প্রয়োগ পাল্টে যায়। কিন্তু পলিসির মতো এটা ঠিক বাজারজাত হয়ে ওঠেনি। এটা যিনি প্রদান করেন তাঁর আত্মার তুষ্টিবিধান হয়। বিপরীতে যাঁর উদ্দেশ্যে পারিত হলো তাঁর সন্মুখে সহনশীলতার এক অভাবনীয় পরীক্ষা। দূর্বল মানুষই যে এগুলোর ব্যবহার করেন ঠিক তেমন নয়। আসলে সব অভ্যাস। অভ্যাস কেউই সহজে বদলে ফেলতে পারেন না। তবুও প্রয়াস নিরলস নিরবিচ্ছিন্ন।
ঠিক তেমনই সংগ্রাম কখনোই থামে না, স্রোতের মতোই নিরন্তর। এখানে- জনগণ=জল, স্রোত=সংগ্রাম। যুগ-সন্ধি, মানে দুটো সময়ের মাঝের অন্তরাল। সেখানেই আমরা দাঁড়িয়ে। এই দোদুল্যমান প্রদীপের শিখায় নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করা, স্বমহিমায় টিকে থাকার আপ্রান সলতের শরীরে ফুয়েল হয়ে জাগরণের বীজটি বহন করতে হবে আমাদের। আমাদের মাতব্বর আমরা নিজেই। এখন আমাদের পজিটিভ অ্যানার্জিগুলো সঞ্চয় করে রাখার সময়। যা আমাদের অজান্তেই সঞ্চিত হচ্ছে। মেহনতি মানুষের অস্ত্রে একদিন তারার আলোয় স্বচ্ছ দেখা যাবে পথ। আমরা আশাবাদী। সংগ্রাম কখনোই ঘুমোতে জানেনা। তাই সংগ্রামী মানুষের কাছে তন্দ্রা তুচ্ছ। প্রতিটি তন্দ্রার মুহূর্তই এক একটি জ্যোনাকির আলো। সব জ্যোনাকি একত্রে মশাল হয়ে জ্বলবে। আমরা তার স্পন্দনে বিগত দিনেও ছিলাম এখনও আছি এবং ভবিষ্যৎ অনুমেয়। সম্ভাবণার দিকে চলতে থাক অন্তত কিছুটা পথ...
।। রম্যরচনা ।।
আজ রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে আছি। চারিদিকে বেশ খুশি খুশি রব। কাল থেকে প্রায় পুরো খুলে দেওয়া হচ্ছে লক। আর “ ওপারে থাকবে তুমি / আমি রইবো এপারে...” নয়। সবাই লক নদী টপকে গাইছে - “ আরে ও জুম্মা, মেরি জানেমান, বাহার নিকাল / আজ জুম্মা হ্যায়, আজকা ওয়াদা হ্যায়...”।
এমন সময় আমাকে চমকে দিয়ে পিছন থেকে কে যেন বলে উঠলো –“ দাদা, একটু হবে?” আমি ঘুরে দেখি ঘন্টাদার পাড়ার বিখ্যাত খৈনী দা। হাসি হাসি মুখে আমার দিকে হাত বাড়িয়ে আছে।
আমি তো অবাক। আমার মতো নিপাট ভদ্রলোক যে কিনা কখনোই কোন জন্মে খৈনী খাওয়া তো দূরের কথা, যারা খায় তাদের সাথেও পারতপক্ষে সোশ্যাল ডিসট্যান্স মেনটেন করে, তার কাছে চাইছে কিনা খৈনী!
বুঝতে পারছি না। করোনা সভ্যতায় সবার কি সাইকোলজিক্যাল ফরম্যাটিং হয়ে গেল! কেমন যেন সব উল্টো উল্টো কথা শুনছি চারিদিকে।
এই কিছুক্ষণ আগে ঘন্টাদার সাথে দেখা হয়েছিল। বললো – “ কি রে! কাল তো হেড অন কলিশন। করোনার সাথে মুখোমুখি মোকাবিলা করার দিন। পাশবিক গুণটা বাড়িয়েছিস তো?”
তখন থেকেই আমি বমকে আছি। বলে কি ঘন্টাদা! পাশবিক গুণ বাড়াবো!? হ্যা মানছি কেরালায় মানুষ নামক প্রাণীটা অন্তঃসত্ত্বা হাতিটাকে যেভাবে মারলো তাকে পাশবিক নৃশংসতা বলা যাবে না। বরং বলা উচিত মানবিক নৃশংসতা। কিন্তু পাশবিক গুণ বাড়ানোটা কি? ধরলাম ঘন্টাদাকে-“ একটু খোলসা করো দাদা।‘
“ দেখ্ করোনা সভ্যতায়, সভ্যতার সমীকরণ বদলে গেছে। এখন বুদ্ধি থাকলেও তুমি সারভাইভ নাও করতে পারো। বাঁচতে চাইলে ইমিউনিটি বাড়াও, যেটা পশুদের আছে। “
এইসব সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতেই দেখি ঘন্টাদার পাড়ার বিখ্যাত পকেটমার চিচিং দা আসছে। গলায় সমধুর গান –“ কাটে নহি কাটতে ইয়ে দিন, ইয়ে রাত / কহেনি থি তুমসে যো দিল কি বাত / লো আজ ম্যায় কহেতা হু...”।
“ কি ব্যাপার চিচিংদা! আজ খুব ফুর্তিতে আছো দেখছি! কার পকেট আবার কাটলে?”
“ কাটিং বলো না, কাটিং বলো না, শিল্পীর মর্যদা দিতে শেখ। এগুলো আনলক শিল্প! এখন আমি পিছনে আনলক করছি না, সামনে আনলক করছি!”
আবার ভরকে গেলাম। এতদিন শুনেছি পকেটমারেরা পিছনে পকেট কাটে। এ আবার সামনে কি করে কাটছে! করোনা মাহাত্ম বুঝতে বেশ সময় লাগবে বুঝতে পারছি। আমার ভ্যাবলা মুখটা দেখে চিচিংদার মনে হয় মায়া হলো। নিজেই বোঝাতে শুরু করলো –
“এখন আনলক ২ চালু হচ্ছে। আর RBI (রিচ বয়েস অব ইন্ডিয়া) কাটছি না। পিএমও থেকে বলে দিয়েছে আত্মনির্ভরশীল হতে। তাই আমিও সুযোগ বুঝে হসপিটালগুলোয় গাইনো সার্জন এর পোস্টে অ্যাপ্লাই করেছিলাম। সাথে মন্ত্রী থেকে ষড়যন্ত্রী সবার পকেট কাটার অভিজ্ঞতা। হাসপাতালের সুপারের পকেট, ব্যাগ সব এমনভাবে কেটে দেখিয়ে দিলাম যে বুঝতেই পারলেন না কখন কাটলাম। তাতেই সিলেক্টেড। আর না নিয়ে করবেই বা কি। ওদের সব ডাক্তার করোনা যুদ্ধে ব্যস্ত। পেট কাটার সময় নেই। প্রথমটা তোর বৌদির উপর দিয়েই এক্সপেরিমেন্ট করবো। লকডাউনে কাজের কাজ ওই একটাই তো হয়েছে।“
ওরে বাবা বলে কি। আমার মাথা ঘুরছে। প্রায় পড়ে যাচ্ছিলাম। কাঠিদা এসে ধরলো। তারপর বললো-
“ কি হলো তোমার! মাথা ঘুরছে? ওই চিচিং ফাঁক টা ম্যাজিক দেখাচ্ছিল না কি? “
“ ম্যাজিকই বটে।“ আমি কোনোক্রমে বললাম।
“ আরে ও কি ম্যাজিক দেখাবে। ম্যাজিক তো দেখাচ্ছি আমি। এখন সবার সামনে লোককে বাঁশ আর কাঠি দুটোই আমি দিচ্ছি। “
আমি আবার খাবি খেলাম। আমাকে মনে হয় করোনাতেই ধরেছে। না হলে সব উল্টো উল্টো শুনছি কি করে! কাঠিদা এতদিন সবার পিছনে কাঠি দিয়ে এসেছে। এখন বলছে সামনেই বাঁশ আর কাঠি দুটোই দিচ্ছে! এ কি করে সম্ভব। আমার কৌতুহল করোনাক্রান্ত হওয়ার আগেই উদ্ধার করলো কাঠিদা-
“ আরে বাবা, পরিযায়ী শ্রমিকগুলো না খেয়ে থাকবে আর আমরা বাঁশ কাঠি চালের ভাত খাবো, তাই আবার হয় না কি। তাই আমিও ওদের ফ্রি তে বাঁশ কাঠি সাপ্লাই করছি।“
যাক্ এমন একটা সোজা কথা শুনে শেষ পর্যন্ত ধাতস্থ হলাম। হাসি হাসি মুখে এবার এক পা এগোতেই আবার খৈনী দা বলল – “ দাদা, একটু হবে?”
যাঃ কেলো! সেই খৈনীদার সমস্যায় তো সমাধান করা হয় নি। যা ঝড় গেলো এতক্ষণ। সব ভুলে গেছিলাম। আবার শুরু হলো।
“ কি ব্যাপার বলুন তো। আপনি আমার কাছে খৈনী চাইছেন!?” রেগে গিয়ে বললাম।
“ না না, খৈনী নয়। একটু স্যানিটাইজার কয়েক ড্রপ হবে? খৈনী ডলার আগে হাতটা একটু স্যানিটাইজ করে নিতাম।“