।। ।। ভ্রমণ ।।


ঋষিকেশ দর্শনের নতুন ঠিকানা বিটলস স্মৃতির চৌরাশি কুঠিয়া
 শৌভিক রায় 

ইতিহাস চিরকাল এমনটিই করে বোধহয়। তাই তাঁদের ভারতে আসবার অর্ধ-শতক পরে পর্যটন মানচিত্রে আবার নতুন করে জায়গা করে নিয়েছে রাজাজী টাইগার রিজার্ভের ভেতর থাকা মহেশ যোগীর যোগসাধনা কেন্দ্র চৌরাশি কুঠিয়া বা বিটলস আশ্রম। 

১৯৬১ সালে মহেশ যোগী তদানীন্তন উত্তরপ্রদেশ সরকারের বনদপ্তরের কাছ থেকে ১৫ একর জমি লিজ নিয়ে এই আশ্রমটি তৈরী করলেও, ১৯৬৮ সালে মহেশ যোগীর 'ট্রান্সেন্ডেন্টাল মেডিটেশন`দর্শনে আকৃষ্ট হয়ে বিটলসের 'ফ্যাবুলাস ফোর'-এর এখানে আগমন হয় এবং ঋষিকেশ আন্তর্জাতিক প্রসিদ্ধি পায়। এখানে বসে তাঁরা রচনা করেছিলেন মোট আটচল্লিশটি গান। তাঁদের আশ্রম জীবন বেশিদিন না হলেও, মূলত  তাঁদের জন্যই ঋষিকেশে আজও বিদেশিদের ঢল নামে। ১৯৮১ সালে লিজ আর না বাড়িয়ে মহেশ যোগী আশ্রম ত্যাগ করেন। ধীরে ধীরে হিমালয়ের গহন অরণ্য ঢেকে নেয় আশ্রমটিকে। ২০১৫ সালে রাজাজী টাইগার রিজার্ভের উদ্যোগে আবার খুলে দেওয়া হয় চৌরাশি কুঠিয়া, যা লোকমুখে বিটলস আশ্রম নামে পরিচিত। 

রহস্যময় আশ্রমটির অমোঘ টান উপেক্ষা করতে না পেরে সম্প্রতি পৌঁছে গেছিলাম ঋষিকেশে। লছমনঝোলা, রামঝোলা, কৈলাসানন্দ মিশন আশ্রম, নীলকণ্ঠ মহাদেব বা চটিওয়ালার ঋষিকেশ দর্শন অসম্পূর্ণ থেকে যেত চৌরাশি কুঠিয়া না দেখলে। স্বর্গাশ্রম বা রামঝোলা থেকে ট্রেকার ভাড়া করে যেমন অরণ্যের মাঝ দিয়েও পৌঁছানো যায় কিমি খানেক দূরের আশ্রমে, তেমনি গঙ্গার তীর ধরে পায়ে হেঁটেও যাওয়া যায়।  

মাথাপিছু ১৫০টাকার প্রবেশমূল্যে চৌরাশি কুঠিয়ার  ভেতর প্রবেশ মাত্রেই মন প্রশান্ত হয়ে উঠল। হিমালয়ের নির্জনে কানে ভেসে আসল পাহাড়ের নিচ দিয়ে বয়ে চলা গঙ্গার জল-সংগীত। খানিকটা চড়াই উঠে আরণ্যক পরিবেশে প্রথমেই নজরে আসে গুহার আকারে সাজানো অজস্র 'মেডিটেশন হাট' বা একক ধ্যানের কুঠুরিগুলি। পাথরে নির্মিত ভাঙাচোরা কুঠুরিগুলি দেখে সহজেই বোঝা যায় যে, ধ্যান ও যোগ-সাধনার জন্য তৈরী করা হয়েছিল সেগুলি। ঘোরানো সিঁড়ি দিয়ে কুঠুরির ছাদেও ওঠা যায়। চারদিকের শান্ত পরিবেশে শোনা যায় বিভিন্ন পাখির ডাক আর আগের তুলনায় একটু ক্ষীণ হলেও গঙ্গার বয়ে চলার অবিরাম শব্দে পাওয়া যায় প্রাণের স্পন্দন। কুঠুরিগুলি পেছনে রেখে একটু এগোলেই বাঁ-হাতে রয়েছে পোস্ট অফিসটি, যেখান থেকে বিটলসের সদস্যরা সারা বিশ্বে ছড়িয়ে থাকা তাদের বন্ধুদের চিঠি লিখতেন। শঙ্করাচার্যনগরের সিল দেওয়া সেই চিঠির অনেকগুলি নিলামে উঠেছে বেশ কয়েকবার। পোস্ট অফিসের উল্টোদিকে উন্মুক্ত মাঠের একধারে রাজাজী টাইগার রিজার্ভ ও মহর্ষি ফাউন্ডেশন তৈরী করেছে ফোটো গ্যালারি। এই কাজে তাদের সাহায্য করেছেন দুবার এম্মি পুরস্কার বিজেতা ভুবনবিখ্যাত চিত্রনির্মাতা পল সালজমান। গ্যালারিটি বিটলস-সহ আরও অনেক বিখ্যাত ব্যক্তিত্বের দুষ্প্রাপ্য ছবিতে সমৃদ্ধ। তাছাড়াও রয়েছে রাজাজী টাইগার রিজার্ভের বিভিন্ন জীবজন্তু ও পাখিদের অসাধারণ বহু ছবি। ফোটো গ্যালারি, ক্যাফেটেরিয়া থেকে সামনের দিকে এগোলে পথের দু`ধারে রয়েছে আশ্রমের রান্নাঘর, প্রেস, হল ও মহর্ষির নিজের ঘর। সবগুলিই ভাঙাচোরা। বোঝাই যায় যে, সময়ের গ্রাসে তাদের অবস্থা অত্যন্ত খারাপ। কিন্তু প্রতিটি  ঘর বিভিন্ন সময় অসামান্য দেওয়াল-ছবি ও গ্রাফিটিতে সাজিয়ে দিয়েছেন আশ্রমে আগত বিভিন্ন শিল্পীরা। এমনিতে দেওয়ালে ছবি বা গ্রাফিটি আঁকা নিষিদ্ধ হলেও, চৌরাশি কুঠিতে আসা শিল্পীদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা রয়েছে তাদের প্রতিভা বিকাশের জন্য। পরিত্যক্ত এই ঘরগুলির দেওয়াল-ছবি ও গ্রাফিটিতে শুধু বিটলসরা নন, আছেন রবিশঙ্করও। এবাদেও ভারতীয় রমণী, সাধু, চক্র ইত্যাদির ছবি ও অজস্র স্লোগান-ধর্মী লেখা দেখে স্তব্ধ হতে হয়। আশ্রমের মাঝের আনন্দ ও সিদ্ধি ভবনটি ১৯৭৬ সালে তৈরী হয়েছিল। সুন্দর স্থাপত্যের এই ভবনটির ছাদেও ওঠা যায়। এখানেও রয়েছে সুন্দর কিছু ছবি ও গ্রাফিটি। আনন্দ ও সিদ্ধি ভবনের পাশে যোগ মন্দির। আর আশ্রমের একদম শেষে রয়েছে মহর্ষি ধ্যান বিদ্যাপীঠ। ষাটের দশকের প্রথম দিকে সালে নির্মিত এই কমপ্লেক্সটি সতপুরী নামেও পরিচিত। এখানেই থেকে গেছেন বিটলসরা। বিখ্যাত ব্যক্তিদের তালিকায় শুধু তাঁরাই নন, রয়েছেন  ডোনোভান, মাইক লাভ ও ফারো বোনেরা। আজকের খণ্ডহর ও চারদিকের প্রবল নিস্তব্ধতা দেখলে অবশ্য বিশ্বাস করা কঠিন যে, এখানেই ড্রাম বাজিয়ে ঝড় তুলতেন রিংগো স্টার বা সুরেলা গলায় গাইতেন লেনন। এই অঞ্চলটি আশ্রমের একদম শেষপ্রান্তে। পাহাড়ের খানিকটা ওপরে হওয়ায় বন্যপ্রাণীরা রাতেরবেলায় অনেকসময় এখানে চলেও আসে।

ফিরতি পথে দেখি একদল তরুণ গিটার হাতে বসে রয়েছে। কণ্ঠে তাদের লেননের 'ইমাজিন`। ভাবতে ভাল লাগে যে, এই তরুণদের জন্যই বেঁচে থাকবে বিটলস আর তাঁদের ভারত-সংযোগের একমাত্র চিহ্ন চৌরাশি কুঠি। 
আসলে কেউ কেউ স্বপ্ন দেখেন, আর পরবর্তী প্রজন্ম সেই স্বপ্ন বাঁচিয়ে রাখে।  

ছবি- লেখক ও ঋতভাষ রায়