অনুবাদ

।। কবিতা ।।


চার্লস বুকোস্কির কবিতা
অনুবাদ : মলয় রায়চৌধুরী



প্রেম ও খ্যাতি ও মৃত্যু

এটা আমার জানালার বাইরে বসে থাকে
বাজারে যাচ্ছে এমন এক বুড়ির মতন ;
এটা বসে থাকে আর আমার দিকে লক্ষ রাখে,
ভয়ে গলদঘর্ম হয়
তারের আর কুয়াশার আর কুকুরের ডাকের ভেতর দিয়ে

যখন হঠাৎই
আমি দৃশ্যটা খবরের কাগজ দিয়ে বন্ধ করে দিই
মাছি মারার মতন করে
আর তুমি শুনতে পাবে কাতরানির চিৎকার
মামুলি শহরের ওপর দিয়ে,
আর তারপর সেটা চলে যায় ।
একটা কবিতাকে শেষ করার উপায় ইসাবে
এরকমভাবে
হঠাৎই একেবারে
চুপ মেরে যাওয়া

আর চড়ুইপাখিটা

জীবন দিতে হলে তোমাকে জীবন নিতে হবে
আর যেমন-যেমন আমাদের শোক ফালতু হয় আর ফাঁকা
লক্ষকোটি রক্তাক্ত সমুদ্রের ওপরে
আমি ভেতরের দিকে ভেঙে-পড়া মাছের গম্ভীর ঝাঁক পাশ কাটাই

শাদা-পা, শাদা-পেট, পচন্ত প্রাণীদের
দীর্ঘকাল মৃত আর চারিপাশের দৃশ্যের সঙ্গে দাঙ্গার সঙ্গে যুঝে চলেছে ।

প্রিয় খোকা, আমি তোমার সঙ্গে তা-ই করেছি যা চড়ুইপাখি
তোমার সঙ্গে করেছিল ; আমি তো বুড়ো যখন কিনা এটা বাজারচালু
যুবক হয়ে ওঠা ; আমি কাঁদি যখন কিনা হাসা হলো চলন ।

আমি তোমাকে ঘেন্না করতুম যখন কম সাহসেই
ভালোবাসা যেতো ।

আমার ৪৩তম জন্মদিনের জন্য কবিতা

একাই শেষ হয়ে যাওয়া
একটা ঘরের কবরে
বিনা সিগারেটে
কিংবা মদে--
ঠিক বিজলিবাল্বের মতন

আর ফোলা পেট নিয়ে,
ধূসর চুল,
আর সকালবেলায়
ফাঁকা ঘের পাবার জন্য
বেশ আহ্লাদিত
ওরা সবাই বাইরে
টাকা রোজগারের ধান্দায় :
জজসাহেবেরা, ছুতোরেরা,
কলের মিস্ত্রিরা, ডাক্তাররা,
খবরের কাগজের লোকেরা, ডাক্তাররা,
নাপিতেরা, মোটরগাড়ি যারা ধোয় তারা,
দাঁতের ডাক্তাররা, ফুলবিক্রেতারা,
তরুণীবেয়ারারা, রাঁধিয়েরা,
ট্যাক্সিচালকেরা

আর তুমি পালটি খাও
তোমার বাঁদিকে

রোদের তাপ পাবার জন্য

পিঠের দিকে
আর তোমার
চাউনির বাইরে ।

অন্ধকারকে যুদ্ধে আহ্বান

চোখে গুলি মারা
মগজে গুলি মারা
পোঁদে গুলি মারা
নাচে ফুলের মতন গুলি মারা

অদ্ভুত কেমন করে মৃত্যু বেমালুম জিতে যায়
অদ্ভুত যে জীবনের মূর্খ আদরাকে কতো গুরুত্ব দেয়া হয়

অদ্ভুত যে হাসাহাসিকে কেমন করে চুবিয়ে দেয়া হয়

অদ্ভুত যে বদমেজাজ কেমন একটা ধ্রুবক

ওদের যুদ্ধের বিরুদ্ধে আমাকে তাড়াতাড়ি যুদ্ধ ঘোষণা করতে হবে
আমাকে আমার শেষ জমির টুকরো পর্যন্ত দখলে রাখতে হবে
আমাকে আমার ছোট্ট পরিসরটুকু রক্ষা করতে হবে যা আমি গড়েছি যা আমার জীবন

আমার জীবন ওদের মৃত্যু নয়
আমার মৃত্যু ওদের মৃত্যু নয়



হেনরি চার্লস বুকোস্কি (আগস্ট ১৬, ১৯২০ -মার্চ ৯, ১৯৯৪)
জার্মান-আমেরিকান কবি, ঔপ্যনাসিক এবং ছোটো গল্পকার। হাজারের বেশি কবিতা, শতাধিক ছোটোগল্প, ৬ টি উপন্যাস লিখেছেন। প্রকাশিত গ্রন্থ সংখ্যা ৬০।
আমেরিকান লেখকদের নতুন প্রজন্মের কথাসাহিত্য ‘ডার্টি রিয়েলিজম’ আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। যেখানে একজন অবিবাহিত মা, একাকী স্বামী, পকেটমার, মাদকাসক্ত ব্যক্তি, গাড়ি চোরকে কেন্দ্র করে সমাজের নিয়মের আবদ্ধতা থেকে প্রিয় শহর লসএঞ্জেলসের মানুষকে মুক্তি দিয়েছেন অস্বাভাবিক বা অবৈধ উপায়ে। কখনও বিদ্রূপাত্মক, কখনও কৌতুকের প্রেক্ষিতে কিন্তু দৃঢ় ভাবে সহানুভূতিশীল শেখনীতে।
উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলি হল-
‘Notes  of a Dirty Old Man’, ‘Post Office’, ‘Burning in Water, Drowning in Flame: Selected Poems’, ‘Hot Water Music’, ‘Ham on Rye’, ‘Factotum’ ইত্যাদি।
১৯৮৬ সালে টাইম ম্যাগাজিন তাঁকে “Laureate of American Lowlife” বলে অভিহিত করে।





।। গল্প ।।


নল

মূল ওড়িআ গল্প :  অমিয়‌  বেজ
অনুবাদ : প্রদীপ  কুমার রায়


উনুনে ফুঁ দেওয়ার নল ।  ভাঙ্গা সাইকেল ফ্রেমের ধাতব অবশিষ্টাংশ । সবাইদের বাড়িতে তখন এই অমূল্য জিনিস টা ছিলনা ।সবার কাছে ভাঙ্গা সাইকেলের ভাগ্য কোথায় ছিল  ? মা বলে এই লোহার নল টা সে তার বাপের বাড়ি থেকে এনেছিল । দিদাদের বাড়ি আমাদের চেয়ে সক্ষম ছিলো ।

যাদের বাড়িতে নল ছিলনা , তারা বাতাসকে অন্তনাড়ির থেকে মুখে টেনে  , ছাড়ছিল উনুনের মুখে । ছাই আর ধোঁয়ায়  ভরে যাচ্ছিলো তাদের মুখ । চারপাশে বিছিয়ে পড়ছিল আমাদের স্কুলের বিঞ্জান বইর অম্লজান । অম্লজান হচ্ছে দাহক । তখনকার মেয়েছেলেরা পুড়ে যাচ্ছিলো উনুনের মাথায় ।আর কিছু আগুন এবং ধোঁয়ার ধাপে ।

আমাদের কিন্তু একটা নল ছিল ।

বাবার হাতে সেইদিন আর কিছু পড়েনি , চোখের সামনে ছিলো উনুনের মাথায় রাখা লোহার সেই নল ।                                                                        নির্জীব একটা বস্তু । মানুষের ছোঁয়ায় জীবন লাভ করে ।

কোন কথায় রেগে বাবা মারছিল মা কে ভীষণ। আমরা সাত ভাইবোন সববারের মতো অবাক ।
আমাদের জানা ছিলো , মায়েরা জীবনকালের ভেতরে কোনো দোষ করেনা ।অথচ প্রত্যেকবার বাবারা মায়েদের দোষ খুঁজতে খুঁজতে জীবন কাটিয়ে দেয় ।
আমরা সাত ভাইবোন আর আগের থেকে মায়ের পেটের ভেতরে মারা যাওয়া আরো তিনজন , মায়ের কোমর কে দুর্বল করে ফেলেছিলাম ।এখন এই লোহার নল !
বাবা ক্লান্ত হয়ে ,নলটাকে ছুড়ে ফেলেছিল উনুনের কাছে ।
তবুও সেইদিন মা  হামাগুড়ি দিতে দিতে আমাদের জন্য এবং এই কিছু সময় আগে তাকে গরুর মত পিটিয়ে থাকা বাবার জন্য রান্না করেছিলো । রান্না করার সময় তাকে আবার সাহায্য করেছিলো সেই লোহার নল ।

মা কাঁদছিল খুবই কষ্টে , আমাদের লুকিয়ে । তখন আমরা পরস্পরের দিকে তাকানোর ছাড়া আর কিছু করতে পারছিলাম না ।
অথচ , সেইদিন ও মায়ের হাতের রান্না সবদিনের মতো খুবই ভালো লেগেছিল ।
এখন আমাদের গ্যাস , ইণ্ড়কসান , ষ্টোভ্ সবকিছু আছে । দিদি আর বোনেরা এখন উনুনের কথা ভুলেই গেছে ।
অনেক বছর পরে , ষ্টোর্ রুম পরিস্কার করতে গিয়ে আজ আমি সেই লোহার নল টা পাই । মায়ের হাতের ছোঁয়ায় , মুখের প্রখর বাতাসে, নলটা পাল্টে গেছিল মসৃণ আর চিকন । নলটার অস্থিত্ব তবুও হারিয়ে যায়নি ।
বাপের বাড়ির জিনিস বলে মা হয়তো যত্ন করে রেখেছে ।
মা বেঁচে আছে তার ভাঙ্গা কোমর নিয়ে । তার জন্য আমরা চার ভাই  মায়ের সুখ এবং সুবিধামত সব যত্ন করি । মায়ের বিছানার সামনে দেওয়ালে রয়েছেন বাবা - সগর্বে । ফটোর ভেতর  থেকে দেখছেন মা র দোষ ।
মা কিন্তু অপলক তাকিয়ে থাকে বাবাকে ।এখন তার একই জেদ , সে বাবার কাছে যাবে।




অমিয় বেজ । জন্ম- ২৭শে জুন ১৯৭৭। প্রকাশিত গল্প সঙ্কলনঃ ‘কাঠ’, ‘চিহ্ন’, ‘ছাই’ । পুরস্কারঃ ‘কলিঙ্গ লিটেরারী যুব গাল্পিক পুরস্কার’,‘টাইম পাস বেষ্ট সেলার পুরস্কার’,‘স্টোরি মিরর বেষ্ট সেলার পুরস্কার’, ‘কটক লিটরারী বেষ্ট সেলার পুরস্কার’ ।