।। গল্প ।।



শুভায়ন বসু
পাজি ট্যাক্সিওয়ালা

ধর্মতলা যাব বলে ট্যাক্সিতে চেপেছিলুম সিঁথির মোড় থেকে। কি কুক্ষণেই না সেদিন, সেই ট্যাক্সিওয়ালাটা আমার ডাকে সাড়া দিয়েছিল, কে জানে ! ট্যাক্সিতে ওঠার পরেই শুরু হল সেই অবাঙালী ট্যাক্সিওয়ালার উৎপাত। প্রথমেই আমাকে দু’তিনটে ওষুধের স্ট্রিপ ধরিয়ে দিয়ে বলল, ‘দেখিয়ে তো, ইসব কিসকা দাওয়াই হে ? দর্দ কম হোবে?’ আমি দেখেটেখে কিছুই বুঝতে পারলুম না ।বললুম ‘কোথায় ব্যথা?’ সে বলল ‘পুরা বডিমে ।বহত চোট লগা হে দো দিন পহলে।‘ আমি বললুম ‘কি করে লাগল?পড়ে  গেছলেন বুঝি?’সে নির্বিকার ভাবে বলল ‘নেহি নেহি, হেভি মারপিট হুয়াথা এক আদমিকা সাথ ।‘ শুনে দমে গেলুম,বাপরে কি ডানপিটে ছেলে। না ঘাবড়ে  বললুম ‘ওষুধগুলো কে দিয়েছে?’ সে বলল ‘একঠো দাওয়াইকা দুকান।ঠিক দিয়া হে,না?’ আমি আর বেশি কথা বাড়াতে চাইছিলুম না। বললুম ‘হ্যাঁ,ঠিকই দিয়েছে নিশ্চয়ই।আমার ঠিক জানা নেই।‘ একটু পরে বুঝেছিলুম, মারপিট করাটা ঐ ট্যাক্সিওয়ালাটার একটা সহজাত প্রবৃত্তি ছিল। যাইহোক ওষুধগুলো ফেরত দিয়ে, আর বেশি সহমর্মীতা না দেখিয়ে, নিজের কাজে মন দিলুম। সেও স্ট্রিপ থেকে একটা ওষুধ ছিঁড়ে মুখে দিয়ে,জলের বোতল থেকে জল খেতে লাগল ট্যাক্সি চালাতে চালাতেই,  বেশ কায়দা টায়দা করে।নিজেই বিড়বিড় করে বলতে লাগল ‘ইসসে আচ্ছা হোতা,দো বোতল দারু পি লেনেসে। শালা, দর্দ ওর্দ সব গায়েব হো যাতা।‘ আমি তার কথায় বিশেষ কান দিলুম না,বেশ টেনশন হচ্ছিল,কার পাল্লায় পড়লুম রে বাবা।ট্যাক্সিটা স্বাভাবিকের থেকে বেশ জোরেই চলছিল।আমি একটু ভয়ও পাচ্ছিলুম,সত্যি সত্যি ব্যাটা দারু খেয়েই ট্যাক্সি চালাচ্ছে না তো! বোতল থেকে কি খেল,কে জানে? যা হোক, টালা ব্রিজের ওপর জ্যামে দাঁড়াতে, পাশের আর এক দেশোয়ালী ট্যাক্সিওয়ালা তাকে সাবধান করে বলল ‘ক্যা ভাইয়া, ইতনা হড়বড়ি কিউ? জলদি হে ক্যা ?’ কথাটা সে ঠিকই বলেছিল । কিন্তু আমার ট্যাক্সিওয়ালা সেসব বুঝলে তো! সে উল্টে তাকেই ধমক দিয়ে বলল ‘আপনা কামধান্দা দেখো,হাম ঠিকহি চলা রেহে হে।‘ এরপর আসল খেলা শুরু হল। সেন্ট্রাল এভিনিউতে উঠে আমার ট্যাক্সিটা আর একটা প্রাইভেট গাড়িকে ওভারটেক করতে গিয়ে তার সঙ্গে একটু ঘষা লাগিয়ে ফেলল। আর পালাবে কোথায়, ওই গাড়িটাও একে তাড়া করে আসতে লাগল,সঙ্গে অশ্রাব্য গালিগালাজ।ভয়ের চোটে এও ঊর্ধ্বশ্বাসে পালাতে শুরু করল, হলিউড সিনেমার কার চেসিং কোথায় লাগে।আমি ওদিকে ইষ্টনাম জপ করছি। কিন্তু এটা কলকাতা শহর, পালাবার পথ নেই! একটু পরেই একটা ক্রসিংয়ে দাঁড়াতেই হল। ব্যাস, আর যায় কোথায়।ওই প্রাইভেট গাড়িতে যারা ছিল, তারাও বেশ হাট্টা কাট্টা টাইপের ,ছোড়নেবালা নয়,এরই মত অবাঙালী।দু’জন সঙ্গে সঙ্গে সেই গাড়িটা থেকে নেমে ছুটে এসে,ট্যাক্সির দরজা খুলে একে বের করার জন্য টানাহেঁচড়া শুরু করল।বলছিল ‘চল,দেখেগা শালা,তু কেয়া কিয়া হ্যায়।কিতনা লোকসান হো গয়ি।‘ সঙ্গে উভয়ের গালিগালাজ,কেউ কাউকে ছেড়ে দেবার পাত্র নয়। শেষে দরজা খুলে টেনে হিঁচড়ে ট্যাক্সিওয়ালাকে নামাতে যেতেই,এও পায়ের কাছে আগে থাকতে  লুকোনো একটা  রেঞ্চ বের করে, ওদের সঙ্গে লড়তে লাগল।আমি নীরব দর্শক। কিন্তু ওরা দু’জন, আর এ একা ,পারবে কেন?’মার শালেকো’ বলে ওরা টানতে টানতে একে রাস্তার ডিভাইডারের কাছে নিয়ে গিয়ে পেটাতে শুরু করল। সে এক ভয়ঙ্কর দৃশ্য, আমার ট্যাক্সিওয়ালা গাড়ি ছেড়ে রাস্তায় পড়ে মার খাচ্ছে আর আমি ট্যাক্সির পিছনে কিংকর্তব্যবিমূঢ় বসে আছি। রাস্তায় জ্যাম, সব গাড়ি দাঁড়িয়ে পড়েছে।দেখতে দেখতে লোক জড়ো হতে শুরু করেছে। শুনতে পেলুম কে যেন ‘পুলিশ পুলিশ’ বলে ডাকছে। জানিনা পুলিশ এসে সেই ঝামেলা মিটমাট হবে কিনা ,কিম্বা হলেও কখন হবে।সেসব জানবার আমার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে ছিল না।আমি শুধু এই ঝামেলা থেকে যেভাবে হোক পরিত্রাণ পেতে চাইছিলুম। এই অবস্থায় বোকার মত ট্যাক্সিতে বসে থাকার কোন মানে হয় না। একে তো এই ট্যাক্সিতে ধর্মতলা পৌছোনোর বারোটা বাজল, এই ঝামেলা সহজে মেটার নয়। ওদিকে ধর্মতলা থেকে দুর্গাপুরের বাস ধরার দেরী হয়ে যাচ্ছে। সত্তর টাকা মতো ভাড়া উঠেছিল। সে যাকগে,ঠিক করলুম কেটে পড়ি।যদিও ভাড়ার টাকাটা মেরে দেবার মোটেও ইচ্ছে ছিল না,কিন্তু আর কিছু করারও ছিল না,বিশেষত যাকে ভাড়া দেবার কথা, সে তখন রাস্তায় চিৎপাত হয়ে শুয়ে মার খেতে ব্যাস্ত। অযথা ঝামেলায় কে ফাঁসতে চায়? দেখলুম, এই সুযোগ, সোজা রাস্তার দিকের দরজাটা খুলে ,হাতের ব্যাগটা নিয়ে নেমে পড়লুম।ধাঁ করে দু’তিনটে গাড়ির ফাঁক দিয়ে গলে বেরিয়ে, সোজা ফুটপাতে উঠে ভিড়ে মিশে গেলুম। হাঁটতে-হাঁটতে পেছন ফিরে বারবার দেখছিলুম, ঝামেলাটা কতদূর গড়াচ্ছে বা আদৌ  থামার দিকে যাচ্ছে কিনা। ততক্ষণে রাস্তায় ভিড় জমে গেছে,কিছু বোঝা গেল না। অন্য একটা  যা হোক বাস ধরে তড়িঘড়ি এলাকা ছাড়লুম। সেই ট্যাক্সিওয়ালাটার কি  হল আর জানা হলনা ।মনে মনে বললুম,বেশ হয়েছে,যেমন কর্ম তেমনি ফল।মার খাওয়া ছাড়াও ওর সত্তর টাকা লোকসানটাকে ধরেই বললুম।
এই ঘটনার বছর খানেক পরের কথা। ততদিনে সেই ট্যাক্সিওয়ালাটার মুখটা ভুলেই মেরে দিয়েছি, মনে রাখা সম্ভবও নয়।খালি ভয় ছিল,কলকাতার রাস্তাঘাটে কোনদিন ট্যাক্সি ধরতে গিয়ে আবার যদি সে বা সেরকম কোন ব্যাটার উদয় হয়। যাহোক সেদিন কলেজ স্ট্রিটের মোড়ে একটা ট্যাক্সি ধরতে যাব,ড্রাইভারের উল্টোদিকের জানলায় মুখ বাড়িয়ে ‘দাদা ,যাবেন?’ জিজ্ঞেস করতেই সে বলল ,’কোথায় যাবেন?’ আমি ‘টবিন রোড’ বলতে গিয়ে হঠাৎ চোখ পড়ল তার সিটের পাশে ক’টা ওষুধের স্ট্রিপ রাখা। চট করে পুরোনো ঘটনাটা বিদ্যুৎচমকের মত মনে পড়ে গেল। তার মুখটা অবশ্য মেলাতে পারলুম না, না পারারই কথা। হতে পারে সে নয়।তবু ভুত দেখার মত ঘাবড়ে গিয়ে,ছিটকে তিনহাত পিছিয়ে গেলুম। ‘যাবেন না?’ সে পরিষ্কার বাংলায় জিজ্ঞেস করল। কিন্তু তখন সেসব বিশ্বাস বা ভরসা করার মত মনের অবস্থা আর নেই। ‘নাঃ, বাসেই যাব’ বলে অ্যাবাউট টার্ন নিয়ে মানে মানে কেটে পড়লুম।ট্যাক্সিটা চলে গেল।গদাইলস্করী চালে একটা ভিড় বাসকে আসতে দেখে আমার মুখে হাসি ফুটে উঠল।




ঋভু চট্টোপাধ্যায়
রঙের রাস্তা 

গোলমালটা শুনেই পুটে বাইরে বেরিয়ে এসেই দেখে, দরজার কাছে বিল্টু বোস, সঙ্গে আরো কয়েকজন।বিল্টু বোস মন দিয়ে কাউকে কিছু একটা বোঝাচ্ছে, তবে আঙুলটা পুটেদের বাড়ির দিকে।পুটের কিছু সময় চুপ করে দাঁড়িয়ে এর ওর মুখের দিকে তাকিয়ে নেয়।বিল্টুর পাশে কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা অনাথদা, পুটেকে কিছুসময় দেখে বেশ জোর গলাতেই তাকে বলে,‘তুর পশ্চিমদিকের ঘরটর চালট ভাঙতি হবেক রে, রাস্তা বেঁকবক নাই।’
-বেঁকবেক নাইত ব্যাঁকাও গে।আমার ঘরটর দিকেই লজর?
-শুনো পুটেদা, ইখানে তুর আমার কথা লয়, কথাট হল গিয়ে গেরামের।রাস্তা বাড়ানুর সময় যদি আমার ঘরট পড়ত, ভাঙি দিতম।
-বাজে বকিস না বিল্টে, তুদের ঐ কমলার ঘরের সিঁড়িট রাস্তাতে পড়লেক, ভাঙলি?রাস্তাট উল্টাদিকে ঘুরায় দিলি।
-উটো বলনা, সিঁড়িট ভাঙলে উয়ারা ঢুকতো কুথাকে?
-বা’রে আমার যে ঘরের চাল ভাঙছিস, বউ, বিটি লিয়ে  উঠব কুথাকে সিটো ভাবিছিস?
-সিদ্ধান্তট আমার লয় পুটেদা, পঞ্চায়েতের, মাইনলে মাইনবে, নইলে পালায় যাও।
-পালায় যাও!কি বললি, এই গেরাম তুর একার, তুর বাপের?ইটো আমারও বটে সাতপুরুষের বাস।
চারদিকের হাওয়া আরো গরম হবার আগেই ঘরের ভিতর থেকে পুটের বউ বাইরে বেরিয়ে এসে পুটেকে ধরে ঘরের ভিতর নিয়ে যায়।‘চিত্কার কোরো না, এক্ষুণি তুমার মাথা বাজবেক, যদি ঘর ভাঙি দেয় গ্রাম থেকে বেরয় যাব।’
কিছু সময়ের মধ্যে বাইরেটাও ফাঁকা হয়ে যায়।রাস্তা মাপার লেবার দুজনও হাপিস।ঘরের ভিতর থেকে পুটে, পুটের বউ দুজনার গলা বাইরের রাস্তা পর্যন্ত এসে পৌঁছালেও শোনার মত আর কেউ রইল না।আস্তে আস্তে গলা থেমে গেল পুটেদের দুজনেরও।
রাস্তা নিয়ে এই ঝামেলাটা চলছে প্রায় মাস সাত আট ধরেই।মাস আট আগে এক বিকালে বিল্টে বোস আর কয়েকজন পুটেকে ডেকে বলে,‘এত বছর তো ক্ষমতায় ছিলে, গাঁয়ের লগে তো একটা ইঁটও ঠিক করলে নাই, আমরা কিন্তু রাস্তাট করছি।প্রধানের সাথে কথা হনছে, টেণ্ডার পাশ হবেক বলে।’
পুটে কিছু সময় দাঁড়িয়ে থেকে বলে,‘ভালো কথা, আমরা পারি নাই তুরা পারছিস, কর।রাস্তা বানা, লাইট লাগা।’
-পারি নাই বল না, বল করি নাই।
-ঠিক আছে তাই হোক।
পুটে সেদিন আর কথা বাড়ায় নি।দিন তার আগের মত নেই।আগের মত সকাল থেকে নিজের গ্রাম বা আশেপাশের গ্রাম থেকে কেউ আসে না।বলে না,‘পুটে দা, একটু দু’কলম লিখি দাও, বিটিটকে হাসপাতালে ভরতি করি, জ্বরে আর ভালছে নাই।’
শুধু জ্বর নয় মেয়ের বিয়ে, শ্রাদ্ধর টাকা চাল গাঁয়ের মন্দির তৈরি সবেই পুটের বাড়িতে লোকজন এসে হাজির হত।গাঁয়ের লোকের পঞ্চায়েতের সার্টিফিকেট দেবার কাজও করত পুটে।প্রথম দিকে নিজেই সার্টিফিকেট এনে দিত, পরে সব সার্টিফিকেট নিজের কাছেই রাখতে আরম্ভ করল।টাকা নিত, মুখের সামনে বলত, ‘মাগনায় দিব, ছাপাতে খরচ নাই?’অবশ্য সবাই কে দিতও না। বিরোধী বাড়ি তো এক্কেবারেই না, খুব ধরলে দ্বিগুন টাকা।
কন্ট্রোলের মুক্তি প্রতি হপ্তাতে পঞ্চাশ কিলো চাল আর পঁচিশ কিলো আটা ঘরে দিয়ে যেত।পুটে খুশি হলেও মাঝে মাঝে বলে উঠত,‘বা’রে বেশ করলি, ভালো চালের বস্তাগুলান বাজারে ঝেরে এই পচা গুলান আমাকে দিছিস।’মুক্তি আমতা আমতা করে বলে উঠত,‘কি যে বল,পুটেদা তুমি হলে কিনা জেলা কমিটির লোক, গাঁয়ের সব কিছু তো তুমিই দেখো।তুমাকে মিছা বলইব?বিল্টু বোসদের বাড়ির থেকেও লোক আসত।কাকা জ্যাঠার ছেলেরা, বিল্টু বোস  নিজেও কয়েকবার এসেছে।তবে সার্টিফিকেট নিতে নয়।একবার গ্রামের রায়দের মরাইএ আগুন লাগাল।কারা নাকি সে সময় বিল্টুকে ঐ জায়গায় দেখে, ব্যাস আর যাই কুথা।পুলিশে রিপোর্ট হল।রাতে পুলিশ এল, বিল্টু সারাটা রাত লুকিয়ে থাকল ধানক্ষেতে।পরেরদিন ভোর হতেই পুটের বাড়ি,‘দাদা বাঁচাও।আমি ছিলম নাই গো, মিছা বলছি নাই।’
পুটে সব শোনে।ঠিক আছে,‘তুর বউ,ছিলা সব এখন কুথাকে?’
-কুথাকে যাবেক কালরেতের থেকে দু’চোখের পাতা এক করি নাই।
-বৌমাদের বাপের বাড়ি পাঠায় দে, আর তুই আমার ঘরকে থাক।ইখান থেইকে রাস্ট্রপতিও ধরতে লারবেক। 
বিল্টু বোস অবশ্য থাকেনি।পুটেদাকে বলে দিন পনেরো শ্বশুরবাড়ি পালায়।গ্রাম ঠাণ্ডা হয়, বিল্টু বোস গাঁয়ে ফেরে।কয়েকমাস বাদে বিল্টুর দলের একজন পাশের গ্রামে পুটেদের দলের একজনের খুনের মামলায় ধরা পড়ে,  বিল্টে বোসেরও নাম জড়ায়।এবার অবশ্য বিল্টে বোস পুটের বাড়ি এলে পুটে বলে,‘ভাই সবই বুঝলম, কিন্তু দিনের আলোতে তুই এইরম ভাবে  ঘরকে এলে লোকজন দেখি ফেলবেক।পরিস্থিতি তো ভাল লয়, কে কুথা থেকে খবর জানায় দিবেক আমি তুর সাথে পিরিত মানাচ্ছি।’শেষের কথা গুলো বিল্টু বোসের গায়ে লাগে।রেগে ওঠে,‘বটে বটে আমারও দিন আসবেক, তুমাদের দিনও এবার যাবেক।’
দিন যে এত তাড়াতাড়ি বদলে যাবে সেটা পুটে এক্কেবারের জন্যে ভাবেনি।বড় বড় নেতাদের কথা মেনে আশেপাশের সব গ্রামে আগের বছরগুলোর মতই প্রচার চালানো, মিছিল মিটিং সবই চলল।কাজের কাজ কিছু হল না।সব দিক থেকে ঢেউ এর মত হারের খবর আসতেই পুটেরা যে যার হুতরোর মধ্যে ঢুকতে আরম্ভ করে দিল।কোন দিন ভাবেনি তাদের দলেরও এমনি ভাবে বির্পযয় হবে।কয়েকজনকে চাকরির জন্য চিঠি লিখে জেলার নেতাদের কাছে পাঠালেও কোন দিন নিজের চাকরির প্রয়োজনের কথা ভুলেও ভাবেনি।অবশ্য বউ ছেলেমেয়েদের কোন দিন অভাব রাখেনি।বরং গ্রামের বাকি সবার থেকে ভালোই রেখেছে।জমিজমা কিছু আছে সেটা তবে কোন রকমে চলে যাবার মত।গাঁয়ে বিল্টু বোসদের লাফাঝাঁপা বড়বার সঙ্গে পুটেকেও সরে থাকত হয়।গুটিয়ে যেতে হয়।গাঁয়ে তখন প্রথম প্রথম বিল্টুদের দল ক্ষমতায় এসেছে, হাঁটা চলার মধ্যে একটা জোর জোর ভাব।এই বুঝি সব ভেঙে আবার নতুন করে হবে।প্রায়ই  মিছিল বের করে।পুটের বাড়ির কাছ দিয়ে বেরোনোর সময় সবার গলার জোর বেড়ে যায়। পুটেও মিছিলের চেষ্টা করে। কেউ বেরোতে খোঁজে না।পুটে তাদের ঘরে ঘরে গিয়ে বলে,‘হ্যাঁরে আমাদের লগে জমি জিরেত হল, তুদের কাউর চাকরি হল আর তুরাই যাবি নাই?বেরুবি নাই?’
-কিছু করবার নাই কাকা।বিল্টুদা বলি দিছে গেরামে অন্য পতাকা দেখলেই শেষ করি দিবেক।তুমিও ছাড়, শুননাই উধারের গেরামের আমাদের আর কেউ নাই।সব ইদিকে।’ কথাগুলো মন্দ নয়।সত্যি গ্রামে আর লোক নাই।দু’এক জন যারা আছে সব পুটের মতন, এক ধরণের মজবুরি।বাড়িতে এসে বউএর সাথে কথা বলে, আলোচনা করে, জিজ্ঞেস করে,‘কি করব?’বউ উত্তর দেয় না।বলে,‘আমি কি জানি?তুমি ভাব, বুঝ।বিটি বড় হচে, গাঁয়েও থাকতে হবেক।’
পুটে জেলা কমিটির অফিসে যায়, বসে থেকে বোঝার চেষ্টা করে লোকজন কত কি আসছে। না এক্কেবারে নাই।হলঘরের পিছন দিকের চেয়ারে মোটা ধুলো।টেবিলটাও ভালো করে পরিষ্কার করা নেই।কয়েকজন পুটের মত লোক আসে।জেলার নেতাদের সামনে চেল্লায়, মার খাওয়ার কথা বলে অত্যাচারের কথা বলে।দাগ দেখায় জেলার নেতারা পাথরের মত বসে থাকে।গায়ে ধুলো লাগে, শরীর তাদেরও অসাড়।গ্রামে ফিরে ভালো লাগেনা কিছুই, বিল্টে বোসদের টিটকারি শুনতে হয়।গায়ে জ্বালা করে কিছুই করার থাকে না, করা যায়ও না।কলে জল নিতে গেলে একটার বেশি দুটো বালতি নিলে কথা শোনায়।মেয়েকে কথা শোনায়।পুটেদের বাড়ির দেওয়ালে, দরজায় বিল্টে বোসরা তাদের দলের চিহ্ন আঁকে, লেখে।রাতে ভয় আরো বেশি, সন্ধে থেকে খিড়কির, সদরের দরজা বন্ধ করে দেয়।কেউ ডাকলেও খোলেনা, বলে সকালে এস।ঘরের জমানো টাকা ফুরায়, চাল বাড়ন্ত হয়।মেয়ের স্কুলের খরচে টান পড়ে।মাঠে ধান কাটার লোক নেই, কাটার পর বয়ে নিয়ে আসার গাড়ি নেই, বউ মেয়ের সাথে বয়তে হয়।বউ বলে,‘রাখো তোমার পাটি, আগে তো পেট, প্রাণ।’পুটে নিজের দলের অফিসে যাওয়া ছাড়ে।বিল্টের দলের  মিছিলে পা মেলায়।
মাস কয়েকের শান্তি।সন্ধে বেলায় বেড়াতে পারে, কাজ করতে পারে।একশ দিনের কাজও পায়। তারপর আবার গাঁয়ের রাস্তা বাগাবার মিটিং হয়।সবার সাথে পুটেও যায়।এক মিটিংএ পুটের ঘরের চাল ভাঙবার কথা বলে।সেদিন পুটে রেগে যায়।বিল্টু বোসদের কাছে গিয়ে বলে, ‘আমি তো আর...............!’ 
-কি করব দাদা, ইখানে আমি তুমি লয়, কথা হল প্রয়োজনের। 
তারপরেই মিছিলে যাওয়া বন্ধ করে।শহরের একটা দোকানে খাতা লেখার কাজ জোটায় সকালে বেরোয় সন্ধেতে ফেরে।বাড়ির সবাইকে বলে যায়,‘কেউরির কথাকে রা কেডো না।’
রা কি মানুষে কাড়ে, রা কাডে হাওয়া বাতাস, গাছের পাতা মেঘ জল, রাস্তাও।এক সন্ধেতে  বিল্টে বোসের পার্টি অফিসে পুটের ডাক পড়ে।পুটে যেতেই বিল্টে বোস বলে,‘কি দাদা, আমাদের আর ভালো লাগছে নাই নাকি?’ 
হাসার চেষ্টা করে পুটে।‘না ঠিক তা লয়, আসলে কাজে বেরয় যেছি তো তাই।’
-বেশ শুনো, তোমার বাড়ির রাস্তার দিকের ঘরের চালট ভেঙি দাও।রাস্তা ঘুরানোর সময় অসুবিধা হবেক।
-ঘর ভাঙি দিব!থাকব কুথাকে?
-সেট কি করব, তুমার লগে তো গাঁয়ের সবার অসুবিধা তো মানা যাবেক নাই।
পুটে বিল্টে বোসদের অনেক ভাবে বোঝানোর চেষ্টা করে।নিজে এমনকি বিল্টে বোসদের জেলা অফিসে গিয়েও সব কিছু বোঝানের চেষ্টা করে।কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয় না।এর মধ্যে গ্রামে পাথর পড়তে আরম্ভ করে।পুকুরে কাঠের গুড়ি ফেলে বাঁধা হয়।রাস্তার ফাটাফুটি মেরামত করতে পাথর ফেলা হয়।এর মাঝে বেশ কয়েকবার পুটের ঘরের চারদিকটা মাপাও হয়।
পুটে তখন পাগলের মত ছুটছে।পঞ্চায়েতের প্রধান, বিডিও অফিস, জেলা অফিস থেকে আরম্ভ করে নিজের আগের পার্টি অফিস বাদ যায় না কিছুই।কাজ হয় না।সবার মুখে একটাই কথা,‘দেখছি কি করা যায় অথবা আমাদের তো হাত পা বাঁধা।’অথবা গ্রামের সবার যা সিদ্ধান্ত আমাদের সবার তাই সিদ্ধান্ত।
বোল্ডারে রোলার চলে, ধাস দিয়ে রাস্তা প্লেন করা হয়। গ্রামের চারদিকে কান পাতলে একটাই কথা,‘বিল্টু বোস কাজ করলেক।এতদিন কার ফেলে রাখা রাস্তা করি তো দিলেক।ইবার গাঁট গুইনবেক।’ কয়েকদিন পরে পুটের দরজাতে ঘর ভাঙার সরকারি নোটিশ ঝোলে।গাঁয়ের লোকজন আর পুটের সাথে কথা বলে না।এক অদ্ভুত গ্রহ গাঁ’টকে কেমন যেন বদলে দেয়।পুটে কাজে যায় কিন্তু ভয়ে ভয়ে থাকে।এই বুঝি ঘর ভেঙে দেয়, এই বুঝি বউ মেয়ে চাপা পড়ে যায়।পুটে পঞ্চায়েতের এক সরকারি অফিসারের সাথে দেখে করে সব কথা বলে।ভদ্রলোক  মন দিয়ে শুনে পরের দিন বাড়ির দলিল নিয়ে আবার অফিসে আসতে বলেন।রাতের অন্ধকারে একটা ছোট আলো জ্বলে ওঠে।পুটে তার পরের দিন আবার যায়।আফিসার দাগ নম্বর, খতিয়ান নম্বর দেখে চমকে ওঠেন,‘একি এখানে তো রাস্তার ধারের এই জায়গাটা হাঁসের ঘর হিসাবে দেখানো রয়েছে।রাস্তার ধারে বসত বাড়ি তো নেই।’
-তাহলে!পুটের চোখ মুখ জ্বল জ্বল করে ওঠে।
-আপনি নিশ্চিন্তে বাড়ি যান।আপনার ঘর ভাঙা হবে না। 
গাঁয়ে ফিরে দরজার কাছ থেকেই পুটে চিত্কার করে ওঠে,‘আমার বসত বাটিকে গোয়াল দেখাবে, ঘর ভাঙার ধান্দা।তুরা শুন  আমি কোর্টে যাব, দেখাচ্ছি মজা তুদের’
-আশেপাশের কেউ কোন কথা বলো না।কোন প্রশ্ন করে না।কোন উত্তর নেই।
দুদিন পরেই সকালের দিকে পুটে কাজে বেরুনোর সময় দরজায় টোকা পড়ে।পুটে দরজা খুলতেই দেখে বাইরে বিল্টে বোস, তারপাশে পঞ্চায়েতের সেই অফিসার।তিনি পুটেকে দেখে একটু আমতা আমতা করে পুটের হাতে আরেকটা কাগজ গুঁজে বলে উঠলেন,‘এই দিকের ঘরটা সাতদিনের মধ্যে ফাঁকা করে দেবেন।ওটা ভাঁঙা পড়বে।’
পুটে অবাক হয়ে যায়।তাহলে সেদিন যে বুললেন,‘ইদিকের ঘরট গোয়াল বটে?’
অফিসার কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলেন কিন্তু তখন বিল্টে বোসের ডান হাত অফিসারের বাঁ হাতে টান দেয়।                   



পার্থজিৎ ভক্ত
খদ্দের 

এই হোটেলটায় মাঝে মধ‍্যে ঢুঁ মারতে হয় আমাকে। আরতি বাপের বাড়ী গেলে অথবা যেদিন সকালে বাজার থেকে ফিরে খালি ফ্রিজ কিংবা সবজির ঝুড়িটা ভর্তি করা য়ায় মাত্র,রান্নার সময় থাকে না,সেই সেই দিনে আসি এখানে। পাইস হোটেলের একটা সুবিধা আছে – আমি এক আধ দিনের খদ্দের না রোজকার – এ নিয়ে হোটেলের মালিকের অত হেলদোল থাকে না। তবে কর্মচারীদের কেউ কেউ মনে রেখে একটু আধটু খাতির যত্ন করে। এই হোটেলের আরেকটা বৈশিষ্ট‍্য-ডাল,মাছের ঝোল,মাংসের ঝোল-এগুলোকে আলাদা করে চেনা যায়। ঐ জন‍্য অন‍্য হোটেলের তুলনায় এখানে খদ্দেরের সংখ‍্যা একটু বেশিই হয়।
অফিস ব‍্যাগ হাতে যে ভদ্রলোক এইমাত্র এসে আমার ঠিক পাশের টেবিলটায় বসলেন,হোটেলের ছেলেগুলো তাকে রায়দা বলেই ডাকে। রোজকার খদ্দের এখানকার,আমার মতো মরশুমি ফুল নন। এক টেবিলে না হলেও পাশাপাশি টেবিলে অনেকদিন বসেছি। তাই আলাপ না থাকলেও মুখ চেনা। বেশ পরিপাটি করে হাত ধুয়ে এসে বসেই বিভিন্ন মাছের পদ রান্না হয়েছে কিনা,মুরগীর মাংস,খাসির মাংসের প্লেট কত করে যাচ্ছে –জিজ্ঞেস  করেন – কিন্তু শেষমেশ কখনও সেসব অর্ডার করেন না। সবজি ভাত, অর্থাৎ নিরামিশ খেয়ে উঠে যান। মুখে লেগে থাকে একটা খুশি খুশি ভাব। খাবেন না তবু জানতে চাওয়া কেন কে জানে। আর এই হোটেলের ছেলেগুলোও কখনও বিরক্তি না দেখিয়ে ওঁর সব প্রশ্নের উত্তরও দেয় দেখেছি। হতে পারে,রোজকার খদ্দের তো তাই হয়তো ওদের বিরক্তি প্রকাশ করা মানা। 
আমি বরাবরের পেটরোগা মানুষ-মাছ-ভাত ছাড়া অন‍্য কিছু অর্ডার দিই না কখনও। নিম বেগুন দিয়ে মাখা ভাত শেষ করে ডালের বাটিটা তুলতে যাব – চোখ পড়ে যায় মানুষটার প্লেটের দিকে। থালার চারপাশ ঘিরে আজ মাছের ঝোল,ডিমের কারি এবং চিকেনের তিন তিনটে ছোট ছোট বাটি। আই বাপস্‌-এত তো রীতিমত সেলিব্রেশান। একা একা জন্মদিন অথবা বিবাহবার্ষিকী – লাইনের স্পাইস হোটেলে! ঈশারায় একটা ছেলেকে ডাকি, কী ব‍্যাপার জানে কিনা। মাথা নাড়ে ছেলেটা – জানে না। আবার লক্ষ‍্য করি মানুষটাকে। আশ্চর্য! এত ভাল ভাল খাবার সামনে নিয়ে ভাতের থালায় হাত রেখে আঙুল নাড়ছেন কিন্তু খাচ্ছেন না কিছুই। গরম লাগছে হাতে? কপাল ভাল বলতে হবে, একেবারে ফ্রেশ নামানো ভাতটা পেয়েছে। অবশ‍্য এই হোটেলে কখনও বাসি পচা কিংবা ভাগাড় কান্ডের অভিযোগ পাওয়া যায় নি। রাত ন-টার পর শুধু রুটি আর ডিম তড়কা ছাড়া কিছুই মেলে না-তাও বড়জোর রাত সাড়ে দশটা পর্যন্ত – সবই গরম,সামনে তৈরী। কিন্তু থালা থেকে তো ধোঁয়া উঠছে না। তবে? হঠাৎ কোন খারাপ খবর পেয়েছেন? আত্মীয় স্বজন কেউ চলে গেছেন হঠাৎ, এরকম একটা আনন্দের দিনে? মনটা খারাপ হয়ে যায়। লক্ষ‍্য করি ভদ্রলোক যথারীতি ভাতের মধ‍্যে আঙুল নাড়ছেন কিন্তু ডাল বা ঝোল – কিছু দিয়ে মাখছেন না। হঠাৎ চোখ যায় ভদ্রলোকের নীচু করে রাখা চোখের দিকে – ঘন বর্ষার জল টলটল করছে দুচোখে। যা ভেবেছি তাই,নিশ্চই কিছু খারাপ খবর পেয়েছেন। ধুস্‌,এসব কেন যে মানুষ মানে এখনও?আরে বাবা যে লোকটা চলে গেছে, দুবেলা গেদে হবিষ‍্যি সাঁটালে সে কি ফিরে আসবে? তবে?আর বলিহারী যাই কান্ডজ্ঞান বাড়ীর লোকগুলোর,রোজ মানুষটা এই সময় খেতে বসে – খবর দেওয়ার আর সময় পেলে না? অবশ‍্য বাড়ীতে লোক থাকলে রেগুলার কেউ হোটেলে খায়? – তাও নিরামিশ? কিন্তু আজকে নিশ্চয়ই কিছু একটা স্পেশাল ব‍্যাপার – একেবারে মাছ-মিষ্টি অ‍্যান্ড মোর্‌ । কিন্তু চোখ ভরা জল,ভাত তেমন গরম নয়,সামনে এত কিছু – মনে হচ্ছিল টেবিলে বসেই বলি – ও দাদা,ব‍্যাপার কী? কিন্তু অসভ‍্যতা হয়ে যাবে বুঝে থেমে যাই। বেশিক্ষণ অবশ‍্য অপেক্ষা করতে হয় না। খাদ‍্যমেলায় গিয়ে রসগোল্লা-পান্তুয়া খাওয়ার প্রতিযোগিতা দেখেছি। থামস্‌ আপ কিংবা কোকাকোলা এক ঢোঁকে নিঃশেষ করা দেখেছি। কিন্তু কোন লাইনের স্পাইস হোটেলে বসে মাছ,ডিম,মাংস একসঙ্গে অর্ডার করতেও দেখিনি – খেতেও দেখিনি। হঠাৎ শুরু করলেন ভদ্রলোক। ঠিক যেন গার্ডের বাঁশি শোনার পর প্ল‍্যাটফর্মে পিছিয়ে থাকা মানুষ যেভাবে দৌড় শুরু করে। কখনও মাছ,কখনও ডিম,কখনও মাংস – কখনও পারলে যেন সব একসঙ্গে। গা ঘিন ঘিন করে ওঠে আমার। আমি খাওয়া থামিয়ে দেখতে থাকি। অন‍্য খদ্দেররাও প্রায় সবাই একই অবস্থায় অবিশ্বাসে। আমার হাত তখনও ছুঁয়ে আছে মাছের ঝোলের বাটি। তেড়ে ঝাল দিয়েছে নাকি সব রান্নায়? তাই কি চোখ ভরা জল?কিন্তু সে তো খাওয়া শুরুর আগে থেকেই। তবে?
এক সময় শেষ হয় মানুষটার খাওয়া। আমি মাছের বাটিটা টেনে নিয়ে শুরু করতে যাব,ভদ্রলোক আমার পাশ দিয়ে হেঁটে বেসিনে মুখ ধুতে গেলেন। দুচোখ তখনও জলে ভরা। দাম মেটানোর সময় হোটেলের ক‍্যাশে বসা মালিক বেশ যত্ন করে জিজ্ঞেস করলেন – মৌরী নেবেন? বুঝলাম,আজ বেশি মাল্লু খসানো গেছে তো,তাই কচি পিরিত জমাচ্ছে মালিক।
– মৌরী! দেবেন? দিন একটু।
চলি।
আসুন।
আমি কোনরকমে খাওয়া শেষ করে ক‍্যাশে গিয়ে মালিককে জিজ্ঞেস – কী ব‍্যাপার বলুন তো,আজ একসঙ্গে এত কিছু অর্ডার দিলেন আবার চোখ ভর্তি জল।
মালিকের গলাতেও যেন হতাশার সুর বাজে।
গতকাল রাতে ওনার ফ‍্যাক্‌ট্রিটা বন্ধ হয়ে গেছে। আর আসবেন না।



বৈদূর্য্য সরকার
উত্তরাধিকার

 জঙ্গলের ভিতর নদীর ধারে সন্ধেবেলা বসে আছি । ও পাড়ে কুয়াশার চাদরে মোড়া অমাবস্যার জঙ্গল । কানে আসছে নদীর জলের আওয়াজ । অন্ধকারে ছুটে বেড়াচ্ছে লালচে কিছু বিন্দু...  
পড়ে বিশেষ কোনও প্রতিক্রিয়া হল না সুদীপের। দাদুর ওই বাউণ্ডুলে জীবনটা ওরা কেউই দেখেনি । শুনেছিল,  ঘর ছেড়ে নর্থ ইস্টের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ব্যবসা করে বিপুল লাভ করেছিলেন । সেই টাকাতেই পরে কলকাতায় জাঁকিয়ে বসেন । সোর্সটা যে ঠিক কী ছিল, জানতো না বাড়ির কেউ। একটু বেশী বয়সে থিতু হয়ে দাদু বিয়ে করেছিলেন ।     
১৯৭১-র ডায়েরি খুলে পড়তে শুরু করা একটা আকস্মিক ঘটনার পর থেকে । মিডিয়ায় কাজের সুবাদে প্রায়শই ওকে দেশের বিভিন্ন জায়গায় ট্রাভেল করতে হয় ।  বাংলাদেশ ও মিয়ানমার সীমান্তঘেঁষা মিজোরামে এবার যেতে হয়েছিল। লোকজনের বিশ্বাস পঞ্চাশ বছর অন্তর সেখানে দুর্ভিক্ষ দেখা দেয় । বাঁশগাছে ফুল দেখা দিলে । 
প্রাথমিকভাবে যেটা জানা যায় – বাঁশের ফুল খেয়ে ইঁদুরের দল মারাত্মক উত্তেজিত হয়ে বংশবিস্তার করতে থাকে বিপুল হারে । সেই ইঁদুর বাহিনী আছড়ে পড়ে জমিতে গুদামে ঘরবাড়িতে । ফসলের ক্ষতি, মরা ইঁদুরের পচা দেহ থেকে দূষণ এবং মহামারী । 
সার্ভে করতে গিয়ে হঠাৎ এক বুড়োর মুখে সুদীপ ওর দাদুর নাম শুনে চমকে উঠেছিল। ছোট থেকেই শুনে আসছে – ওর সাথে দাদুর যৌবনের চেহারার আশ্চর্য মিল । কিন্তু সেটা যে বিদেশে এসে এর’ম পরিস্থিতিতে ফেলতে পারে কোনওদিন ভাবেনি সুদীপ। আশ্চর্যের যেটা, ওখানকার প্রাচীন লোকের স্মৃতিতে এখনও দাদু রয়ে গেছেন । লোকটা বলেছিল, আপনার দাদু আমাদের বাঁচিয়েছিলেন । কিন্তু কীভাবে সেটাই কেউ মনে করতে পারছে না । বাঁশের ফুল দেখে যদিও লোকেরা বুঝতে পারছে, অচিরেই ঘনিয়ে আসছে মাওতাম । অভূতপূর্ব দুর্ভিক্ষ ।

দাদুর স্মৃতির কারণেই হয়তো বুড়ো লোকটা সুদীপকে ওদের উদ্ধারকর্তা  ভেবে বসেছিল বলেই, বাড়ি ফিরে চিলেকোঠার ঘরে স্তুপাকারে পড়ে থাকা দাদুর নানারকম জিনিসপত্র ঘেঁটে ডায়েরিটা পড়তে শুরু করেছে সুদীপ।  ডায়েরিটায় গল্পের অনেক উপাদান আছে । দাদুর একাকীত্ব, ওখানকার লোকেদের পোকামাকড় খাওয়া কিংবা ব্যবসা সংক্রান্ত কথাবার্তা পাওয়া গেলেও সুদীপ আসল জিনিসটা খুঁজে পাচ্ছিল না ।  
মাঝে কিছুদিনের পাতা ফাঁকা । তারপর চৈত্র মাসে একজায়গায় দাদু লিখছেন – অঞ্চলের রাজার থেকে পাওয়া উপঢৌকনের কথা । এমনকি সাধারণ মানুষরাও কৃতজ্ঞতা জানিয়ে প্রায় পাঁচ হাজার টাকা তার হাতে তুলে দিয়েছে। তখনকার হিসেবে ওই টাকা কম নয় । ডায়েরিটা শেষ হচ্ছে – প্রচুর টাকাকড়ি নিয়ে উনি ফিরে এসেছেন কলকাতায়... । 
বোকার মতো বসে রইল সুদীপ । বুঝতে পারলো না কিছু । তাহলে উপায়টা কী ! সে কল্পনা করল – তবে কি হ্যামলিনের বাঁশিওয়ালার মতো গল্প !
হঠাৎ ডায়েরির মলাটের ভেতরটায় চোখ পড়ল সুদীপের । দাদু লাল কালিতে লিখে গেছেন, পঞ্চাশ বছর পরে বাঁশে ফুল ধরলে... না লেখা পাতাগুলোর খোঁজ যে করবে তাকে শিবনামের উত্তরাধিকার দিলাম ! 
সত্যিই কিছু কি জানতেন দাদু ? এই যোগাযোগটাই তো কাকতালীয় ! কিন্তু উপায়টা – সেতো কিছুই বোঝা গেল না । ‘শিবনামের উত্তরাধিকার’-র মানে কী  ! 
রাতে সুদীপ স্বপ্ন দেখলো - কলোনি ছেড়ে ইঁদুরের দল উঠে এসেছে । তাদের টানেলের মুখ পঞ্চাশ বছর আগে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল, সেগুলো কালক্রমে উন্মুক্ত হয়ে গেছে ।

সেদিন শিবরাত্রি । সকাল থেকে কাছের শিব মন্দিরে বেশ ভিড় । রাস্তাতেও নানারকম অস্থায়ী দোকান বসেছে । তাদের পশরা দেখেই সুদীপের মাথায় ঝিলিক দিয়ে গেল উপায়টা । বাংলার পথঘাটে হয়ে থাকা শিবের প্রিয় ধুতরা ফুলই হবে অস্ত্র । বিদেশ ঘোরা কিন্তু মনেপ্রাণে বাঙালি তার দাদু তাকে দিয়ে গেছেন ‘শিবনামের উত্তরাধিকার’ ! 
ওখানকার জঙ্গলেও সে ধুতরা দেখেছে অনেক । গ্রামের লোকেদের সবাইকে নিয়ে গোটা জঙ্গলে সেই ধুতরা ছড়াতে হবে । বিষে নিশ্চিত থমকাবে ইঁদুরের বাড়বাড়ন্ত । 

টিকিটের খোঁজ শুরু করলো সুদীপ ।