বিদায় মুহূর্ত
রাণা চ্যাটার্জী
বিদায় মুহূর্ত বা অন্তিম তিথি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসাবে চিহ্নিত হয় আমাদের দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহার্য দ্রব্য সামগ্রীর।উৎপাদিত জিনিসের যেমন একটা অন্তিম তিথি থাকে,তেমন থাকে প্রস্তুতির তারিখও। এই সেদিন রান্নার মধ্যম লগ্নে গৃহিনী বার্তা দিলেন, হলুদ শেষ,কি আর করা যাবে!সংসার নামক ভারসাম্যকারী নৌকায় চেপেছি যখন,অবশ্য আমি ,আড়ালে বলি" সং আর সার" সং সেজে থাকা,যার সার বলে কিছুই নেই!
কতবার বলি,শেষ হবার আগে একটু বলবে,কুকের তো সে সব খেয়াল থাকেনা।সপ্তমে মেজাজ নিয়ে ঝড়ের গতিতে আসে কখন পরের বাড়ি পৌঁছাবে ভাবনায়। যাই হোক ব্যস্ত জীবনে সব কেটে,বেঁটে, রেডি রাখলে উনি খুন্তি নাড়তে এলেও বেশ উপকারী । সাত সকালে স্কুল,
অফিসের রান্না পেয়ে সত্যিই আপ্লুত হই আমরা।
অগত্যা কি করি,পড়ি কি মরি করে আনতে গেলাম হলুদ প্যাকেট।এনে দেখি কুক ভ্যানিস,
হলুদ ছাড়াই অমন রং বিহীন তরকারি করে চলে গেছে অন্য বাড়ির হেঁসেলে। ততক্ষনে হলুদ প্যাকেট টা হাতে পড়ে তো আমার নয় বছরের মেয়ে, মা কে কমপ্লেন করা শুরু করে দিয়েছে,"মা দেখো ,বাবা ডেট পেরুনো হলুদ প্যাকেট এনেছে!" কি কপাল রে বাবা,হন্ত দন্ত হয়ে গেলাম,খুশি হবে কোথায়,সেই এত বড়ো ভুল করে ফেললাম ব্যবহারের অন্তিম তারিখ না দেখে!
দোষটা তো অবশ্যই আমারই ,ব্র্যান্ডের কোম্পানীর লোগো দেখার পর বিশ্বাসটা এমন জায়গায় চলে যায়,তাড়াহুড়ো করে এক্সপায়ারী তারিখ দেখা হয় না। এটা কিন্তু কেবল আমি না আমাদের মধ্যে অনেকেই করি।তবে সচেতন ক্রেতা তো অবশ্যই আছে বরং বাড়ছে ধীরে হলেও আমাদের মধ্যে।
আর আমার মতো ভুল করা খদ্দেরকে পুঁজি করে,আমাদের ভরসাকে ,কাজে লাগিয়ে অসাধু ব্যবসায়ীরা,ক্রেতাদের মাথা চিবিয়ে খাচ্ছেন। কিছু ভাল প্যাকেটের ভিড়ে মিলিয়ে মিশিয়ে রাখা বাতিল প্যাকেটের উঁকি ঝুঁকি।আরে তাতে কি! বিক্রেতাদের পকেট উপছে হবে লক্ষী লাভ। মফস্বল শহরের আনাড়ি ক্রেতাদের মধ্যে বুক ফুলিয়ে ঠিক বিক্রি হয়ে যাবে! কেবল মশলা নয়,কত রকমের ওষুধ লাট কে লাট চালান করে দেওয়ার ব্যবসা ফাঁদ চলছে রমরমিয়ে।
কিছু মাস আগে ভাগাড় কান্ড আমাদের চোখে আঙুল তুলে দেখিয়েছে নষ্ট,পচে যাওয়া মাংস কিভাবে মানুষের চোখে ধুলো দিয়ে বিক্রি হয়।তবু কি হয়েছি সচেতন হয়েছি আমরা?বড় বড় নামকরা রেস্টুরেন্ট রীতিমতো জাঁকিয়ে দীর্ঘদিন মানুষের পকেট কেটেছে আর মাত্রাতিরিক্ত লোভ যে মানুষ কে কোথায় নিয়ে যায় তার বর্ণনা,তথ্য পেয়ে ভিরমি খেয়েছি নেট দুনিয়া ও পেপারের দৌলতে।
ট্রেনে যে জল কিনি আমরা, খবরে দেখছিলাম,
সাধারণ মানের জলকে নতুন খালি হওয়া কুড়ানো বোতলে ,ভরে নতুনের মতো দিব্যি প্যাকেট করে,কুড়ি টাকা দামের লেভেল সাঁটিয়ে বিক্রি চলে রমরমিয়ে ! তাই ট্রেন, গন্তব্যে পৌঁছাতেই ,ফাঁকা জলের বোতল সংগ্রহ করার তাড়াহুড়ো লেগে যায় ওই স্টেশনে রাত কাটানো অনাথ ,ছোট ,বড়, মাঝারি বাচ্ছা গুলোর মধ্যে। বড় চেনা এ দৃশ্য। অগত্যা, কিছু করার তো নেই আমাদের। তৃষ্ণার ছাতি ফাটা পরিস্থিতিতে ধন্য হই এক বুঁদ ঠান্ডা জল পেয়ে জলের বোতল কিনে।
জিনিসের তাও একটা অন্তিম তারিখ আছে,যেটা দেখে আমরা বুঝতে পারি,কতদিন পর্যন্ত দ্রব্যটি ভালো থাকবে। কিন্তু আমাদের! এই আছি,এই বুঝি ফুড়ুৎ হওয়া ! ডেট অফ বার্থ জানি কিন্তু কবে আমার ফুরানোর দিন তা তো জানি না!শেষ তিন মাস ধরে মনের কোণে ভয় পুষে মারণ রোগের জীবাণু থেকে মুক্তি পেতে কত কি সাবধানতা অবলম্বন এর একটাই উদ্দেশ্য এই বুঝি প্রাণ পাখি আক্রান্ত হলেই সর্বনাস।নিজেকে যে বড্ড ভালোবাসি আমরা।এরই মাঝে যখন সারাবিশ্ব মৃত্যু মিছিলে আতঙ্কিত মরার ওপর ফাঁড়ার ঘায়ের মতো সর্বশক্তি নিয়ে সুপার সাইক্লোন আম্পান। অর্থাৎ আমাদের ধরা ভূমিতে আসার দিনক্ষন মোটামুটি ঠিক থাকলেও বিদায় নেবার অন্তিম ক্ষণ কেউই সেভাবে জানি না।কিছু ক্ষেত্রে আন্দাজ করতে পারি মাত্র তাও এমন মারণ বীজানু বা প্রাকৃতিক দুর্যোগে বড্ড অসহায় আমরা।সৃষ্টি কর্তার কারখানায় হয়তো আমাদের "অন্তিম তারিখ" সযত্নে রাখা আছে কিন্তু আমরা নিজেরা জানি না।এই ব্যস্ততার দিন যাপনে,কখন যে হঠাৎ নিজ নিজ "অন্তিম তারিখ" টা আমাদের ডাক দেবে সেটা নিজেরাও জানি না,ভাবলে বরং উদাস হই।
জামাই-ষষ্ঠী! বাঙ্গালীর এক সনাতন আচার অনুষ্ঠান
সুস্মিতা মিশ্র
কথায় আছে বাঙ্গালীর বারো মাসে তেরো পার্বণ। তেরো না হলেও যাজ্ঞবল্ক্য স্মৃতি পুরাণ মতে ষষ্ঠী পূজো কিন্তু বছরের প্রতি মাসের জন্য বারো ধরণের ছিল। যদিও কালের সঙ্গে বেশীর ভাগেরই স্বাতন্ত্রতা হারিয়ে গিয়েছে। গ্রাম বাংলায় রয়ে গেছে ছয়টি ষষ্ঠীর অনুষ্ঠান। সেগুলি হলো, অরণ্য, লোটন, গেতু, শীতল, অশোক ও নীল। তবে এদের মধ্যে জ্যৈষ্ঠ মাসের ৬ তারিখে অরণ্য ষষ্ঠীর প্রচলন সবচেয়ে বেশী। এই অরণ্য ষষ্ঠীই হলো বাংলার জামাই-ষষ্ঠী। বর্তমানেও এটি বাঙ্গালীর ঘরে ঘরে প্রতি বছর ধুম ধাম করে উদযাপন করা হয়। আম এই পূজোর প্রধান উপকরন বলে বাংলার অনেক স্থানে এর আরেক নাম আমষষ্ঠী, বিশেষত পূর্ব-বাংলার পাবনা ও বগুরা জেলায়।
সাধারনত আমরা দেখি অতিপ্রাকৃত শক্তিগুলি সর্বদা মানুষের জীবনের প্রতিটি পর্যায়কে প্রভাবিত এবং নিয়ন্ত্রণ করে চলেছে। তাই, সভ্যতার শুরু থেকেই তাদের তুষ্ট করার জন্য মানুষ বিভিন্ন দেবদেবীদের পূজো, আচার, ব্রত ইত্যাদির আশ্রয় নিয়েছে। নির্দিষ্ট ধর্মীয় বিশ্বাস অনুযায়ী সেগুলিকে তারা পালন করে যাচ্ছে। সেই সমস্ত প্রতিটি ধর্মীয় উত্সবের পেছনে আবার কাজ করছে কিছু না কিছু সামাজিক-ধর্মীয় প্রেক্ষাপট।
ঠিক এই কারণেই কুসংস্কারচ্ছন্ন বাংলার প্রাচীন সমাজে শিশুমৃত্যুর হার থেকে রক্ষা পেতে অজ্ঞ এবং অসহায় সমাজ যে সব দেবতাদের শরণাপন্ন হয়েছিল, ষষ্ঠী তাদেরই অন্যতম। এই দেবীর পূজো কতটা প্রাচীন বা ঠিক কোন সময় থেকে এর প্রচলন, তা সঠিক ভাবে জানা যায় না। কারণ, প্রাচীন কোন হিন্দুধর্মগ্রন্থে বা বেদ-এ ষষ্ঠীর কোন নামোল্লেখ নেই। যদিও পঞ্চম শতাব্দীতে লিখিত বায়ু পুরাণে ৪৯ টি দেবদেবীর তালিকায় ষষ্ঠীকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, ‘কিছু কামনা করে যে অনুষ্ঠান সমাজে চলে তাকেই বলা হয় ব্রত’। তিনি ব্রত গুলিকে দুই ভাগে ভাগ করেছেন-১) শাস্ত্রীয় ব্রত, যা হিন্দু ধর্মের সংগে এদেশে প্রচার পেয়েছে, আর ২) মেয়েলী ব্রত, যার অনুষ্ঠানগুলিকে পুরাণের আদিপর্ব বলে মনে হলেও এর মধ্যে হিন্দু-পূর্ব ও হিন্দু ধর্মের সমন্বয়ের ইতিহাস খুঁজে পাওয়া যায়। যদিও বৈদিক অনুষ্ঠানের গভীরতার কোন চিহ্ন তার মধ্যে অমিল। ষষ্ঠী পূজা মূলত এমনই একটি নারীদের ব্রত অনুষ্ঠান। মনে করা হয়, মনসা ও মঙ্গল চন্ডীর মতো এই দেবীকেও সমাজে প্রতিষ্ঠিত করার উদ্দেশ্যে পুরাণে স্থান দেওয়া হয়েছে। এই দেবীর পূজো মনসা এবং শীতলা দেবীর মতো বাংলার বাইরেও পূজিত হয়। জেমস টড ( ব্রিটিশ ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানির লেফট্যানেন্ট কর্নেল ছিলেন) জানায় রাজস্থান অঞ্চলে অষ্টাদশ শতাব্দীতে অরণ্য-ষষ্ঠীর অনুষ্ঠান মহিলারা বনে করতো। পিপুল গাছের (অশ্বত্থ) তলায় বেদী বানিয়ে সমবেত হয়ে এর পূজো করা হতো, সেই বেদীকে বলা হত 'ষষ্ঠী তলা'। এখনো অনেক গ্রামে এই রকম ষষ্ঠী তলা দেখা যায়। এটি একটি পবিত্র বনের প্রতীক হিসেবে দেখা হয় বলে এর নাম অরণ্য-ষষ্ঠী।
বাংলার লোক ঐতিহ্যে, দেবী ষষ্ঠী শিশুদের অভিভাবক দেবতা ও নারীদের উর্বরতার দেবী হিসাবে পরিচিত। অনেক যুগ ধরে শিশু জন্মের পরে প্রসতি গৃহে ষষ্ঠ দিনে এই দেবীর পূজোর প্রচলন হয়ে আসছে। তাছাড়াও সন্তানের জন্মের পর থেকে শৈশবকালের প্রতিটি পদক্ষেপের সময় নারীরা তার উপাসনা করে । প্রার্থনা করে তাদের সন্তানের সুস্বাস্থ্য ও সুখের জন্য। একই সঙ্গে বন্ধ্যা মহিলারাও সন্তান লাভের আশায় পূজো করে। বাংলায় নিম্নবর্ণের স্ত্রীরা, যারা ধাত্রী-মা হিসেবে পরিচিত ছিলেন, তারাও প্রধান দেবতা হিসেবে দেবী ষষ্ঠীর উপাসনা করতো। ষষ্ঠী শব্দের আক্ষরিক অর্থ বাংলাতে 'ষষ্ঠ', এই কারণেই ষষ্ঠী-ব্রত মাসের ষষ্ঠ দিনে পালন করা হয়। বাংলা ছাড়াও ভারতের উড়িষ্যা সহ উত্তর ভারতের অনেক স্থানেই একই রীতি অনুসরণ করা হয়। বিহারে, ষষ্ঠ দিনের অনুষ্ঠানটিকে ছঠী (ষষ্ঠ) বলা হয় এবং ষষ্ঠীকে ‘ছঠী মাতা’।
ষোলশ শতকে বৃন্দাবন দাসের চৈতন্য ভাগবতে উল্লেখ আছে চৈতন্যের জন্মের ষষ্ঠ দিনে দেবী ষষ্ঠীর পূজোর কথা। যদিও তার অনেক আগে থেকেই বাংলায় এই পূজোর প্রচলনের প্রমাণ পাওয়া যায়। যেমন- দ্বাদশ বা ত্রয়োদশ শতাব্দীতে লেখা দেবী-ভাগবত এবং ব্রহ্মবৈবর্ত-পুরাণ নামে সংস্কৃত গ্রন্থগুলিতে দেবী-ষষ্ঠীর নাম রয়েছে। দেবি-ভাগবতে ষষ্ঠীকে বলা হয়েছে দেবী কাত্যায়নী (দুর্গার আর এক নাম)। আবার, আমেরিকান প্রত্নতাত্ত্বিক, আর্নেস্ট ম্যাকে মনে করেন যে দেবী ষষ্ঠীর উৎসের বিষয়টি সিন্ধু সভ্যতার ঐতিহ্যের থেকে এসেছে। তিনি প্রাক-ঐতিহাসিক হরপ্পার খনকার্যের থেকে কিছু পোড়ামাটির এক দেবীর মূর্তি আবিষ্কার করেছিলেন এবং ধারণা করেছিলেন যে ষষ্ঠীকে সেখানে সম্ভবত নতুন জন্ম নেওয়া শিশুর অভিভাবক দেবতা হিসাবে পূজা করা হয়েছিল। অন্যদিকে, বাংলায় সবচেয়ে প্রাচীন লোকসাহিত্য 'মঙ্গলকাব্যে’ এই দেবীর প্রসঙ্গ রয়েছে। বিশেষত, ষষ্ঠীমঙ্গল হ'ল ষষ্ঠীদেবী সম্পর্কিত সর্বাধিক প্রচলিত বিখ্যাত গ্রন্থ, যা সতের শতকের শেষার্ধে লেখা হয়েছিল। মধ্যযুগে বাংলায় বিশেষভাবে প্রচলিত ষষ্ঠীমঙ্গল কাব্যে যে কাহিনী পাওয়া যায় তা হলো নিম্নরূপঃ
সায়বেনে নামে এক বনিক তার সাত পুত্র ও পুত্র বধূদের নিয়ে ষষ্ঠী পুজো করতো। এক দিন গর্ভবতি ছোট পুত্রবতী লোভে পড়ে পূজোর আগেই ষষ্ঠীর উপাচার থেকে কিছু খাবার খেয়ে নেয়। চুরির সমস্ত অপবাদ একটি কালো বিড়ালের উপরে দিয়ে দেয়। এদিকে কালো বিড়াল হলো দেবীর বাহন। তাই বিড়াল ক্রুদ্ধ হয়ে ছোট বউয়ের পর পর ছয় পুত্রকে আতুর ঘর থেকে নিয়ে পালায়। সাত পুত্রের সময় ছোট বউ বিড়ালের পেছন পেছন অরণ্যে প্রবেশ করে দেখতে পায় ষষ্ঠী তলায় তার সন্তানকে। শেষপর্যন্ত, দেবী ষষ্ঠীর কাছে দোষ স্বীকার করে অনেক প্রার্থনায় সন্তানকে নিজের কাছে ফিরে পায়। তারপর থেকে ষষ্ঠীর মাহাত্ম্য ছড়িয়ে পড়ে ও ঘরে ঘরে পূজিত হয়। এই দেবীর কোন মুর্তি নেই বলে অনেকে স্থানে মনসার মূর্তিকে পূজো করা হয়। তবে প্রায়শই ষষ্ঠীর চিত্র আঁকা হয় একটি বিড়ালের উপরে এক মায়ের প্রতিমূর্তি হিসাবে যার চারপাশে রয়েছে এক বা একাধিক শিশু। যেহেতু বিড়াল এই দেবীর বাহন, তাই বাঙ্গালীদের মধ্যে বাড়িতে বেড়াল পোষা অনেকটা মা ষষ্ঠীকে সন্তুষ্ট করার মানসিকতা কাজ করে। আবার, কালো রঙ এমনিতে যে কোন শুভকাজে অশুভ বলে প্রতিপন্ন হলেও, কালো বিড়ালকে কিন্তু কখনই ‘অপয়া’ মনে করা হয় না।
চিত্রটি উইকিপিডিয়া থেকে সংগৃহিত
এতো গেল দেবী ষষ্ঠীর কাহিনী। কিন্তু এখন প্রশ্ন হছে জামাই কিভাবে ষষ্ঠীর সঙ্গে যুক্ত হতে পারে বা জামাইদের সঙ্গে এই আচারের কি সম্পর্ক? প্রকৃতপক্ষে ঐতিহ্যগতভাবে, বাংলায় একটি প্রথা বিশেষভাবে প্রচলিত ছিল বা গ্রাম বাংলায় এখনো আছে, যে কন্যার বিয়ের পর যতক্ষন না পর্যন্ত সন্তান হচ্ছে, কন্যার বাবা-মা তার বাড়িতে পরিদর্শন বা অন্ন গ্রহণ করবে না। দক্ষিণ এশিয়ায়, তাই আজও অনেক যুবতী স্ত্রী গর্ভবতী হওয়ার জন্য এবং সর্বোপরি একটি পুরুষ সন্তানের জন্ম দেওয়ার জন্য বিয়ের পরপরই তীব্র পারিবারিক চাপের মুখোমুখি হন। এদিকে, জামাই (বাংলায় জামাই) হলো এই উর্বরতা সমীকরণের একটি অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। সেইজন্যই মা ষষ্ঠীর ঐশ্বরিক আর্শিবাদের পরিবেষ্টনের আওতায় আনা হয় জামাইদের। আর জুন মাসের ষষ্ঠী পূজোর দিনটিকে উত্সর্গ করা হয় জামাইয়ের জন্য। তাই অরণ্য-ষষ্ঠীর আর এক নাম 'জামাই ষষ্ঠী'। এই দিনে বাঙ্গালিদের শ্বশুরবাড়ী থেকে তাদের কন্যা ও জামাইকে একটি মহা ভোজের জন্য আমন্ত্রণ জানায়। বাড়িতে আসার পরে শাশুড়ি জামাইকে ছয়টি ফলযুক্ত একটি প্লেট দিয়ে তাঁর মাথায় স্পর্শ করে এবং হাতে হলুদ সুতো বেঁধে পাখার হাওয়া দেয়। একে ষষ্ঠী সূতো বলে। তারপর দুপুরে বিভিন্ন স্বাদের রান্না করে শ্বাশুড়ি জামাইকে আদর যত্নের সঙ্গে আপ্যায়ন করে। এককথায় বাড়ির সবাই মিলে হৈ হৈ করে খাওয়া-দাওয়া, আনন্দ করে একটা দিন কাটায়। প্রবহমানকাল ধরে বাংলায় এই নিয়ম চলে আসছে। এখন তো 'জামাই ষষ্ঠী’ বাঙ্গালীর সংস্কৃতির এক অবিচ্ছেদ্দ অঙ্গ হয়ে উঠেছে। জামাই-ষষ্ঠীর তাৎপর্য বাঙ্গালীর যাপনে এতটাই যে কোন ভাল আপ্যায়নের উপমা হিসেবে ‘জামাই- আদর’ কথাটি ব্যবহার করা হয়।
চিত্রটি গুগল থেকে সংগৃহিত
যদিও বর্তমান যুগে মেয়েদের এই আচার ও ব্রত পালনকে নিয়ে সমাজতত্ববিদদের মধ্যে শুরু হয়েছে নানা বিতর্ক। অনে্ক গবেষক উদ্বেগ প্রকাশ করছেন এই বলে যে, কেন হিন্দু মহিলারা বিনা প্রশ্নে এখনও শত শত নারী বিরোধী আচার অনুষ্ঠানগুলি সম্পাদন করে চলেছে। যেখানে, ইতিহাসে জুড়ে বুদ্ধিমান লোকেরা বহু বিযুক্তিবাদী সংস্কৃতি বিলুপ্ত করে দিয়েছে। যদিও কিছু দেশে পুরুষতান্ত্রিক ঐতিহ্যের অনুষ্ঠান আগের তুলনায় আরও ভাল ভাবে পালিত হচ্ছে। এই প্রসঙ্গে, আমি কয়েকজন নৃতত্ববিদদের মন্তব্য তুলে ধরছি। লীলা দুবে, তাঁর একটি প্রবন্ধে লিখেছেন যে হিন্দু ধর্মীয় রীতিনীতিগুলির প্রভাবে নারীরা আরো বেশী মাত্রায় তাদের স্বামী এবং অন্যান্য পিতৃস্থানীয় আত্মীয়দের অধীনস্থ হয়। বলা যায়, ব্রত বা আচারের পালনের মাধ্যমে নারীরা একজন আদর্শ বধূর তকমা অর্জন করে, যা সমাজের তৈরী করা নীতি ও মূল্যবোধ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। আবার সুসান ওয়াডলি বলেন, মনস্তাত্ত্বিক অনুভব নারীদের এই আচারগুলিতে অংশগ্রহণ করতে উৎসাহী করে। একই যুক্তি জেমস ফ্রিম্যানও উপস্থাপন করেছেন। তাঁর মতে, এই ধরনের আনুষ্ঠানিক আচারে অংশগ্রহন তাদের একটি মানসিক আরাম এনে দেয়। অনেকে তাদের ভাগ্য পরিবর্তনের সুযোগ হিসাবেও বিবেচনা করে, যা আগের জন্মের কর্ম দ্বারা পূর্বনির্ধারিত।
অ্যানি ম্যাকেনজি পিয়ারসন অবশ্য ১৯৯৬ সালে অন্যরকম যুক্তি দেখান। তিনি বলেন, ব্রত রীতি অনুশীলনের মাধ্যমে মহিলারা ক্ষমতায়িত হতে পারেন, যার জেরে স্ব-নির্ভরতা এবং আত্মবিশ্বাস অর্জন করে নিজেদের ক্রিয়াকলাপের পরিধি বাড়িয়ে তুলতে সক্ষম হয়। তাঁর লিখিত গ্রন্থ ‘গিভস মি পিস অফ মাইন্ড’-এ বলেছেন, এর ফলে নারীদের মনের প্রশান্তির সুশৃঙ্খল প্রসার ঘটে, যা বর্ণনায় 'সৌভাগ্য' বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
এই বিতর্কের জোরে আজকাল একটা জোরালো দাবি উঠে এসেছে নারীদের কাছ থেকে। জামাই ষষ্ঠী হলে বৌমা ষষ্ঠী কেন নয়? ফলস্বরূপ, কয়েক বছর ধরে মিডিয়া ও সংবাদ পত্রে দেখতে পাচ্ছি, বাঙ্গালীদের ঘরে বৌমা ষষ্ঠীও খুব ধুমধাম করে পালন হচ্ছে। এটা অবশ্যই বাঙ্গালি সমাজের আধুনিক মননের পরিচয়। সুতরাং, বিতর্ক তো থাকবেই। তাই বলে কি আনন্দ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে হবে। বাঙ্গালী বরাবরি আমোদপ্রিয়। কথায় ছিল বার মাসে তের পার্বণ, সেখানে না হয় আরও একটি পার্বণ যোগ হলো, বৌমা ষষ্ঠী। ক্ষতি কি। অন্তত এই সুযোগে পরিবারের সবাই মিলে এক যোগে খাওয়া-দাওয়া, হৈ-হল্লা করে মিলন উৎসব পালন করা যাবে। সুতরাং একটু পরিবর্তন করে যদি একবছর জামাই-ষষ্ঠী পালন করি, আর পরের বছর বৌমা ষষ্ঠী, তাহলেই বা মন্দ কি!
★সূত্রঃ
১. Anne Mackenzie Pearson, 1996, "Because It Gives Me Peace of Mind": Ritual Fasts in the
Religious Lives of Hindu Women.
২. আশুতোষ মজুমদার, ১৯৯২, মেয়েদের ব্রতকথা
৩. James Freeman, 1980, The Ladies of Lord Krishna: Rituals of Middle-Aged Women in Eastern
India.
৪. James Tod, 1920, Annals and Antiquities of Rajasthan or the Central and Western Rajput State
Of India. Vol. II.
৫. Leela Dube, 1988, On the Construction of Gender: Hindu Girls in Patrilinineal India.
৬. Susan Wadley, 1976, Brothers, Husbands and Sometimes Sons: Kinsmen in North Indian Ritual.
Eastern Anthropologist. Vol. 29. No. 1,
৭. শীলা বসাক, ১৯৯৫, মেয়েলি ব্রত লোকাচার
৮. শ্রী অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বাংলার ব্রত