।। রম্যরচনা ।।

তোমার সঙ্গে একা
শুভায়ন বসু

অনেক বছর পর, আজ তোমার সঙ্গে দেখা। যে তোমাকে একদিন খুঁজে পেয়েছিলাম কলকাতার বাসের ভিড়ে বা ফুটপাথের অস্থির অপেক্ষার মাঝে,যে তোমাকে লালন করেছিলাম হঠাৎ কালবৈশাখীর ঝড়ে বেসামাল প্রকৃতির খেয়ালে, যে তোমার সঙ্গে হেঁটে ছিলাম কিছুটা পথ  সেই দামাল যৌবনের দিনগুলোয়,যে তুমি  লুকোনো থাকতে মানিব্যাগের গোপন ভাঁজে আর আশা যোগাতে জীবনের ওঠা-পড়া আশা-হতাশার দোদুল্যমান লড়াকু দিনগুলোতে, সেই তুমি। তুমি তো পাল্টে গেছ অনেক, আর নেই সেই ‘তুমি’ । আমিও পাল্টে গেছি, পাপের বোঝা আর সংসারের চাপের ভারে কুঁজো হয়ে গেছি একটু। তবু মনটা সতেজ আছে এখনও, আগেরই মত। এখনও বাগবাজার বাটা বা হেদুয়ার সামনে অপেক্ষা করে সেই মন, নীল পালক হয়ে, কোন এক হলুদ পাখির জন্য। শুধু তিরিশটা বছর পেরিয়ে গেছে।
 তুমি কথা বলছ না আমার সাথে , আমারও কিছু বলার নেই তোমাকে। শুধু নির্বাক তাকিয়ে থাকা ছাড়া। তুমি সুখী হয়েছ ? না ,জানতে চাইনি আমি। কি হবে জেনে? তখন যদি তুমিও সেই একই প্রশ্ন কর, কি বলব আমি? তার চেয়ে বৃষ্টির তোড়ে ভেসে যাক না অতীত। স্থান-কাল-পাত্র নিরপেক্ষ হোক না আমাদের অসীম শূন্যতার মিলন। শূন্যের সঙ্গে শূন্য যোগ দেওয়া ছাড়া,এ  তো আর কিছু নয় ।
তোমার সঙ্গে কিছুটা সময়, সে যেন অনন্ত জীবন। এ যেন এক গভীর আত্মবীক্ষণের গ্লানি এনে দেয়। কি পেয়েছি, কি পাইনি, কি হতে পারত, হিসেবের সময় এটা নয়। এ শুধু তোমার সঙ্গে একা থাকার সময়, আমার সঙ্গেও।
গঙ্গার ধারে দু’জনে দাঁড়িয়ে আছি, সূর্য অস্ত যাচ্ছে ।শহরের ক্যানভাস আকাশের মায়াবী আলোয় ভরে যাচ্ছে। আমার বুকটাও ভরে উঠছে। শুধু অনেক বছর ধরে অপেক্ষা করার পর, শেষ তুলির টান বা শেষ কবিতার লাইন, আজ শেষবার সৃষ্টি করে নিঃশেষ হয়ে যাব আমি। আমার আর কিছুই বলার থাকবে না, তোমারও না। সূর্য ডুবে গেলে, সন্ধ্যার অন্ধকারে চারিদিক ডুবে যাবে। আমরা আবার যে যার পথে ফিরে যাব। আর হয়তো কোনদিন দেখা হবে না। শুধু থেকে যাবে কিছু স্মৃতি, দুজনে পাশাপাশি পথ হাঁটার সেই সময়টার কথা ভেবে অকারণ হাহুতাশ করবে একটা  পাগল মন। সিগারেটের ধোঁয়ার মতো বের হয়ে আসবে সারা জীবনের  আফশোস।
চারিদিকে ব্যস্ত মানুষের ভিড়, স্ট্রীটলাইট গুলো জ্বলে উঠল। নির্বাক সন্ধ্যাবেলায় প্রিয় কবিতার বইয়ের পাতা উল্টোচ্ছ তুমি। আমি তার শেষ কবিতা মনে মনে লিখে ফেলছি, আর কোনদিন কবিতা লিখব না। জীবন ঢেকে দিচ্ছে আমার এই তিরিশ বছরের সব না পাওয়ার অভিযোগ  আর পরাজয়ের লজ্জাকে। তুমি সেই পরম নৈঃশব্দের আদরে,প্রশ্রয়ে, আমার সারা জীবনের সমস্ত কান্নাকে ধুইয়ে দিয়ে চলে যাচ্ছ এক অসীম জীবনবোধে।
যাবার আগে তুমি ফিরে তাকালে একবার। ঠিক যেমন ফিরে তাকিয়ে ছিলে কৈশোরের সেই প্রথম দেখার দিনটাতে। হাতে হাত ছুঁয়ো না, বড় শীত করে ।শুধু চোখের মিলনে আজ অনেক ইতিহাসের পাতা  লেখা হয়ে গেছে,সেই  আমার কাছে যথেষ্ট। অনেক মেঘ, মনকেমন করে উড়ে এসেছে, আশ্রয় না পেয়ে আবার  ফিরে চলে গেছে ঘরভাঙ্গা পাখির মত। তুমিও চলে যাচ্ছ, ঠিক সেদিনের মত। সেই জেব্রাক্রসিং, সেই ট্রাফিক সিগন্যাল, চলন্ত বাস থেকে নেমে সেই উড়ন্ত চুমু লুফে নেওয়া ।রাস্তা পেরোলেই তুমি, কিন্তু পারলাম কি পৌঁছতে ? মাঝে বয়ে গেল কিছু  গঙ্গার জল, কিছু ধোঁয়া-ধুলো-ঘামের গন্ধ,কয়েকটা নির্বোধ লাভলেটার আর একটা  গোটা কলকাতা  শহর ।জীবন কিছুই নেয়নি আমার থেকে, বরং অনেক  ফিরিয়ে দিয়েছে। আমিও সেইসব নিয়েই আছি,তাই তোমার চলে যাওয়ার দিকে আর তাকিয়ে থাকব না। দীর্ঘশ্বাস? শুধু সেটাই হয়তো লুকোতে পারব না।আর তুমি? তোমার চোখের কোনও  কি ভিজে উঠল একবার? তুমিও কি নিজেকেই বোঝাচ্ছ? আর তা জানার উপায় নেই ।ঠোঁটদুটো অস্ফুটে কিছু বলতে চেয়ে, কেঁপে কেঁপে থেমে যায়।
সমস্ত নৈঃশব্দ, সমস্ত সময় আর আমার ‘আমি’ কে নিয়ে কালো  সন্ধ্যার  ড্রপসিনের ওপারে চলে যাচ্ছ তুমি, একা।



লিখে খাওয়া
রাজীব পাল


এইমাত্র এক বন্ধু ফোন করেছিলো। অনেক দিন পর তাই সামান্য অভিমান হয়েছিল আমার। আর তাই নাম্বার সেভ থাকা সত্ত্বেও -"হ্যালো, হ্যালো কে বলছেন? কে..." ওপ্রান্ত রেগে গিয়ে দিলো একটা জুতসই শব্দবাজি নিজস্ব অভিধান থেকে। আর উপায় নেই। বললাম " হ্যাঁ বল্"। অনেক দিন পর তাই জানতে চাইলো, "কী করছিস?" জবাব যেন তৈরিই ছিল একদম, " কবিতা লিখে খাচ্ছি" ওযে চমকে গেল বুঝতে পারলাম। কিছুক্ষণ কোনো সাড়াশব্দ নেই। আমি সমানে হ্যালো হ্যালো করে যাচ্ছি। আমি যে একটু আধটু লেখালেখি করি ও তো সেটা জানে। হাসতে বলল, "বাহ্! তুই এত বড়ো কবি হয়ে গেছিস! দারুণ বন্ধু, খুব আনন্দ পেলাম!" কী মুশকিল মাঝেমধ্যে এমনি হয়। একটা শব্দ বা একটা বাক্যের  বহুমুখী অর্থের জন্য কত কিছুই যে উল্টে পাল্টে যায়! এই সময়ে কেউ কবিতা লিখে প্রচুর রোজগার করছেন এবং সেই রোজগারে তার দিব্য চলে যাচ্ছে, এটা অতি বড়ো কবিও কল্পনা করতে পারেন না! আর আমি তো অতি নগণ্য একজন। ওকে বললাম, " আমি এ কথা বলিনি যে, ভুল বুঝেছিস তুই, এইমাত্র একটা কবিতা লিখে খাবার খেতে বসেছি সেটাই বলেছি রে..." বিস্তারিত শুনে ও এমন অট্টহাসি দিলো যে আমার ফোনের স্পীকার ফেটে যাওয়ার যোগাড়। কথায় কথায় অনেকটা সময় পেরিয়ে গেল। ফোন রেখে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম।