।। গল্প ।।




লগ্নভ্রষ্টা
প্রতাপ বোস

জানলার কাঁচটা পুরোটা নামিয়েও পুরোটা  দেখতে পেল না শর্মিলি। শুধু একটা শব্দই দেখা যাচ্ছে –“আতঙ্ক “। এমন ভাবে বিরাটি মিনি আর ৭৮বি মারামারি করে দাঁড়িয়েছে যে দেখবে কার সাধ্য। তার মধ্যে দিয়েও টিভি সিরিয়ালের প্রচারের  হোর্ডিংটা নিয়ে যে ক্যারাভানটা যাচ্ছে সেটাকে অনেকক্ষণ ধরে অনুসরণ করতে করতে শেষ পর্যন্ত ওই একটা শব্দই দেখতে পেল শর্মিলি। তাতে মন ভরলো না। উল্টে কৌতুহলটা গেল বেড়ে কয়েক গুণ ।

অফিস টাইম না হলেও এই সময়টাই ভালোই ট্রাফিকের চাপ আছে যশোর রোডে। ওলা ক্যাবটা পেতে ভালো বেগ পেতে হয়েছে শর্মিলিকে। নভেম্বর মাসের একেবারে শেষের দিক। এই সময়ই  অঘ্রাণের গলা জড়িয়ে ধরে শীতের আদুরে আহ্লাদ ওই ভোর বেলার দিকেই একটু যা বোঝা যায়। কিন্তু এখন তো বেলা এগারোটা। রোদ্দুরের তেজ দেখলে কে বলবে যে এই সেই রোদ্দুর যে ভোরের হাওয়ায় অঘ্রাণের গলায় নাক ঘষতে ঘষতে বলেছিল –‘আমি তোমার অমলকান্তি হতে চাই..’

একে তো বেলা এগারোটাই বিরাটি মোড়ে দাঁড়িয়ে পাক্কা পনের মিনিট চেষ্টা করার পর দুটো ক্যাব বাতিল করে তৃতীয় ক্যাবটা ধরতে হয়েছে  তার উপর এই রোদ্দুরে দাঁড়ানোর জন্য ঘেমে নেয়ে একসা হয়ে গেছে শর্মিলি। আজ যাওয়ার ইচ্ছে ছিল না। কাল রাতের থেকে শরীরটা ম্যাচম্যাচ করছে। কিন্তু আজও সমু মানে সৌম্যকান্তি বললে ও না বলতে পারে না।

ক্যাবের ঠাণ্ডা হাওয়ায় একটু স্বস্তি হতেই চোখটা আটকে গেল ক্যারাভানটার গায়ে। এতো ভিড়, হর্ণের মধ্যেও কেমন নির্বিকার ভাবে চলেছে রাস্তার ডানদিকটা ঘেঁষে। একটা টিভি সিরিয়ালের বিজ্ঞাপন গায়ে নিয়ে। সাথে একটা স্লোগান। মনে হয় সিরিয়ালের  থিম স্টেটমেন্ট হবে। পুরোটা দেখা যাচ্ছে না... শুধু ওই একটাই  শব্দ। “আতঙ্ক”।

পুরোটা না দেখতে পারলে কেমন খচখচ করে ভিতরটা। মিনিটা আবার গড়াতে শুরু করেছে । এবার নিশ্চয় দেখা যাবে। চোখটা জানলায় সাটিয়ে রেডি হলো শর্মিলি। আর ঠিক সেই সময়ই একটা বাইক দুরন্ত গতিতে একদম জানলার পাশে চলে আসল। বাজাজের পালসর NS 200। লাল টুকটুকে বাইকটার আসল সৌন্দর্য অবশ্য তার পিছনের আরোহীর। খোলা চুলের অষ্টাদশী নির্মেদ চেহারার সমস্ত বিপদজনক বাঁককে যথেষ্টর চেয়ে কম সম্মান জানিয়ে আলতো হাতে প্রেমিকের কোমর জড়িয়ে চোখে হালকা দুষ্টুমির আভাস ছড়িয়ে চলেছে। পরনে ব্লু ডেনিমের সিগারেট জিনস্। সাথে লাল টপ যেটা উপর থেকে হুড়মুড়িয়ে  গড়িয়ে পড়লেও কোমরের থেকে অল্প উপরে প্রচণ্ড জোরে ব্রেক কষে থেমেছে। কিন্তু থামান যাচ্ছে না শর্মির ওলার ক্যাব ড্রাইভার কে। সে যে ভাবে বারবার চোখ ঘুরিয়ে দেখছে বাইকের আরোহী দের তাতে যে কোন সময় ওলা ক্যাবটা সামনের গাড়িকে ধাক্কা মারতে পারে। আতঙ্কিত হলো শর্মি। যেমন হয়েছিল বছর ছয়েক আগে।

“ সমু প্লীজ আস্তে চালাও। আমার ভীষণ ভয় করছে। এতো জোরে চালালে আমি কিন্তু আর তোমার বাইকে চড়বো না।“ শর্মির আতঙ্কে সৌম্যকান্তি হো হো করে হেসে আরও জোরে বাইক ছুটিয়েছিল। আর আতঙ্কে সমুকে আরও জোরে জড়িয়ে ধরেছিল শর্মি। ওদের দুজনকে দেখে কে বলবে যে ওদের প্রেমের বয়স তখন মাত্র এক মাস। শর্মি প্রেসিডেন্সির বি এ ফার্স্ট ইয়ারের ছাত্রী আর সমু ওই কলেজেরই এম এ ইকনমিক্সের ফাইনাল ইয়ার। নবীন বরণ উৎসবেই আলাপ। আলাপটা প্রেমালাপে পৌঁছাতে বেশি সময় লাগেনি। কারণ কথায় বার্তায় ক্রীড়া সংস্কৃতি দেহ সৌষ্ঠব সব কিছুতেই সমু ততদিনে কলেজের টপার। সে মেয়েদের আড্ডার ঠেকের পাশ দিয়ে গেলে আড্ডায় যেন পিনড্রপ সাইলেন্স। সমুকে শুধু একবার দেখার জন্য মেয়েরা পাগল। আর একবার যদি সমু তাদের দিকে তাকাই তবে তো তাদের ফিদা হবার জোগাড়। এহেন সমু শর্মির প্রথম দর্শনেই ক্লিন বোল্ড। একটু শ্যামলা। কিন্তু উদ্ভিন্ন যৌবনা শর্মির দীঘির মতো গভীর অথচ বড় বড় আয়ত চোখ দুটো যেন কথা বলে। সেই মায়ায় ডুব দিতে সমুর মতো খেলোয়াড়দের তো বেশি সময় লাগার কথা নয়। লাগেও নি। সিনিয়র দিদিরা সাবধান করেছিল শর্মিকে সমুর ব্যাপারে। কিন্তু প্রেমে পড়লে কে আর কবে সাবধান বাণী শুনেছে।

বাইকটা হুস করে বেরিয়ে যেতেই চটক ভাঙল শর্মির। এবার অনেকটা অনাবৃত ক্যারাভানের বিজ্ঞাপনের স্লোগানটা। তবে পুরোটা নয়। একটা স্করপিও এমন ভাবে ওটার পিছন পিছন ছুটছে যে আড় ভাবে তাকিয়েও পুরোটা দেখতে পেলো না শর্মি। অথচ ভীষণ দেখতে ইচ্ছে করছে । দেখতে দেখতে আড়াই নম্বর গেট, দু নম্বর গেট পার হয়ে গেল। যত ভি আই পি রোড এগিয়ে আসছে তত যশোর রোড চওড়ায় ছোট হয়ে আসছে তন্বী কিশোরীর কোমরের মতো। আর সেই কোমর জড়িয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছে একের পর এক গাড়ি। লাল সিগন্যালটা সবুজ হওয়ার অপেক্ষা। তারপরই গাড়িগুলো ঝাঁপিয়ে পড়বে ভি আই পি রোডের প্রশস্ত বুকে। শর্মিও প্রাণপণে অপেক্ষা করছে এই সবুজ সিগন্যালটার জন্য। কারণ এরপরই আসবে যশোর রোড থেকে ভি আই পি রোডের দিকে  হরিণের গ্রীবার মতো দুরন্ত বাঁকটা। ওই বাঁকেই অনাবৃত হতে হবে যে ক্যারাভানের বিজ্ঞাপনের স্লোগানটাকে।

এটা তিন মাথার মোড় হলে কি হবে এত গাড়ি এই মোড় দিয়ে যাতায়াত করে যে এখানে সিগন্যাল চেঞ্জ হতে অনেক সময় লাগে। এখন ভি আই পি থেকে যশোর রোডের দিকে গাড়িগুলো ছাড়ছে। একসাথে  অনেকগুলো গাড়ি, পাবলিক বাস, দূর পাল্লার বাস, ভ্যান, অটো, টোটো, বাইক, স্কুটার এমনকি সাইকেল সব তাল গোল পাকিয়ে এমন ভাবে বেরাচ্ছে যে ধাক্কাধাক্কি না লাগাটাই অস্বাভাবিক। সবাই অসভ্যের মতো কান ফাটিয়ে এমন হর্ণ দিচ্ছে যেন ওই গাড়িগুলো ছাড়া পৃথিবীতে আর কেউ কোথাও নেই। বায়ু দূষণের চেয়েও এখন আতঙ্কের ব্যাপার হলো শব্দ দূষণ। মনে মনে ভাবে শর্মি। ইলেকট্রনিক সিগন্যাল থাকা সত্ত্বেও কতগুলো হোম গার্ড আর একটা পুলিশ লাটি উচিয়ে প্রাণপণে চেষ্টা করছে ট্রাফিক  ঠিক রাখার জন্য। এর মধ্যে কোথা থেকে একটা লরি ঢুকে পড়ায় সমস্ত ট্রাফিক সিস্টেম ঘেঁটে গেল। পুলিশটা লাঠি উচিয়ে লরিটা কে সাইড করতে বলছে। আর সমস্ত গাড়ি দের থামিয়ে দিয়ে লরিটা হেলতে দুলতে বাঁদিক থেকে  ডানদিকে যাচ্ছে। কিছুটা ডান দিকে বেঁকে লরির ড্রাইভার সোজা পুলিশের হাতে দশ টাকা গুঁজে দিয়েই চম্পট দিলো আর পুলিশটা নির্ভেজাল মুখ করে হাসতে হাসতে পকেটে টাকাটা ঢুকিয়ে নিলো।

“শালা এইজন্যই এই দেশের কিছু হবে না “ এক দলা গুটকার থুতু ছুঁড়ে হাতের চেটোই মুখটা মুছে বলল পিছনের বাইকের ছেলে টা। “ শালা টাকা পেলে এখানে পুলিশ নিজের কোমরের বেল্টটা পর্যন্ত খুলে দিতে পারে।“
“ বেল্ট কি বলছিস। পুলিশের প্যান্টটাই কোমর থেকে নামানো। যখন যে পার্টি  আসছে করে ...” হ্যা হ্যা করে হাসতে হাসতে সঙ্গত দিলো বাইকওয়ালার বন্ধু।

সিগন্যালে দাঁড়িয়েও বাঁদিকের বাসের কন্ডাকটর সমানে চেঁচিয়ে যাচ্ছে  “ কৈখালী, বাগুইআটি, কেষ্টপুর...বাগুইআটি, বাগুইআটি...”। আর তাই শুনে ঘেমে নেয়ে অস্থির এক বাস যাত্রী বলে উঠল “ আর বাগুইআটি বাগুইআটি করতে হবে না। আঁটি এমনই টাইট হয়ে গেছে। আর বেশি টাইট করলে নৈহাটি হয়ে যাবে... “। এই ধরনের গন রসিকতা মোটেও ভালো লাগে না শর্মির। কিন্তু আজ যেন বড্ড প্রাসঙ্গিক লাগলো কথাটা। সত্যিই অর্থনীতি নিয়ে যেভাবে জেরবার হয়ে আছে সবাই তার উপর এই অনাবশ্যক NRC CAB নিয়ে হুজ্জুতী মানুষকে একেবারে আতঙ্কে পেড়ে ফেলেছে। ও এক বছরের উপর হলো এম এ পাশ করেছে। এখনও চাকরি পাইনি। বাবা তিন বছর হলো রিটায়ার করেছে। একা বিবাহিত দাদার উপর বেশ চাপ পড়ছে বুঝতে পারে ও। বাবা মা ওকে নিয়ে চিন্তিত। তার উপর অন্য একটা আতঙ্ক সারা ক্ষণ ওকে কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে। সর্বোপরি এই NRC আতঙ্ক। আর পারা যাচ্ছে না। ভাবে শর্মি।

সিগন্যালটা লাল থেকে সবুজ হলো। সহসা মনে হলো যেন গাড়িগুলো উচ্চমাধ্যমিক পাস করে কলেজে ভর্তি হয়েছে। এক রাশ উচ্ছাস নিয়ে যশোর রোড থেকে ভি আই পি তে বাঁক নিয়েই উর্ধশ্বাসে ছুটছে। আর তখনই মুহূর্তে এক চিলতে রোদ্দুরের মতো হাসি খেলে গেল শর্মির মুখে। ক্যারাভানটা নিজেকে উন্মুক্ত করছে শর্মির চোখের সামনে। আস্তে আস্তে সরে যাচ্ছে রহস্যের পর্দা। খুলে যাচ্ছে লজ্জার সমস্ত আভরণ।  ভি আই পির বুকের দুরন্ত বাঁকেই বিজ্ঞাপনের স্লোগানটা উঁকি দিলো – “ আতঙ্কের শেষ লগ্নে জন্ম নেয়...”। পুরোটা দেখতে পাওয়ার আগেই থিম্পু, ফুনশিলিং ভুটান থেকে আসা সবুজ রঙের বাসটা আবার ঢেকে দিলো বিজ্ঞাপনটা কে।

কি জন্ম নেয় আতঙ্কের শেষ লগ্নে। কি হতে পারে। কি কি হতে পারে।  এতো দেখছি ভারী মজা। কিছুতেই একবারে দেখতে দিচ্ছে না স্লোগানটাকে। মনে মনে ভাবল শর্মি।  সেও তো একবারে ধরা দেয় নি সমুর কাছে। যৌবনের প্রথম প্রেম বাঁধন হীন ভাবে ছুটেছিল কলকাতার অলিতে গলিতে। পার্ক থেকে পার্কে। ভিক্টোরিয়া,  ইডেন গার্ডেন্স, বালিগঞ্জ লেক, বাবুঘাট, গঙ্গা ভ্রমণ,  বোটানিক্যাল গার্ডেন কিছুই বাদ যায় নি। অস্ত রাগের সূর্যের লালিমা দেখিয়ে সমু বলেছিল ওই আগুন রাঙা আকাশের থেকেও নাকি আগুন ধরানো শর্মির লাল টুকটুকে ঠোঁট। তারপরে গঙ্গার বুকে নৌকার ছাউনির ভিতর শর্মির কোলে মাথা রেখে শুয়ে দুহাত দিয়ে গলা জড়িয়ে ধরে সমু ডুব দিয়েছিল শর্মির আগুনঝরা  ঠোঁটে। তারপর কতবার বিকেলের সূর্য লজ্জায় লাল হয়ে গঙ্গার জলে ভেসে গেল। সন্ধ্যার ঘন কালো চুলে ঢেকে যাওয়া সেই শিহরণ আজও বুকে ঢেউ তোলে শর্মির। কিন্তু ওই পর্যন্তই। আর এগাতে দেয় নি শর্মি।

পুরুষের আদিম আবেগে পুড়তে পুড়তেও কখন উড়ে যেতে হয় জানে নারী মন। সত্যিই কি জানে। না কি নিজেকেও নিজে ঠিক বুঝতে পারে না নারী। সংস্কার, সমাজ, আবেগ, শঙ্কা সব একসাথে  ক্রিয়া করে। কখন যে কোন ঢেউ তীর ভাসিয়ে দেয় কে জানে। এমনই এক ঢেউ তো সত্যিই ভাসিয়ে দিয়েছিল একদিন।

আচ্ছা দূর দূর প্রান্তর থেকে যে বাস আসে তারা কি সাথে করে নিয়ে আসে দূরের মাঠের ঘ্রাণ, রাস্তার ভালোবাসা। সেই কতো দূরের ধুলো ওড়া বাতাস যা বাসের সঙ্গে সঙ্গে চলে সেও কি কিছু বলে যায়। তার আকুলতায় কি আবার বাসটাকে ফিরিয়ে নিয়ে যায় তার ভালোবাসার ঘরে। ভুলতে দেয় না তার প্রথম প্রতিশ্রুতি – আমি যেখানেই যায় না কেন আবার তোমার কাছেই ফিরে আসবো। তাইই হবে না হলে পাশে পাশে গায়ে গা লাগিয়ে চলা সবুজ রঙা ভুটানের বাসটার গা দিয়ে এখনও সেই ভুটানের পাহাড় ছোঁয়া শিশির মাখা কমলা লেবুর বাগানের ঘ্রাণ,  অনাবিল দিগন্ত বিস্তৃত সবুজ উপত্যকার ছেড়ে দিতে না চাওয়ার আকুতি বেশ টের পেল শর্মি।

এমনই একটা আকুতি ভরা ভালোবাসার রোদ্দুরে সমুর বুকের মধ্যে হারাতে হারাতে এমনই হারিয়ে গেছিল শর্মি যে সমুর বাড়িতে থেকে যাওয়ার প্রস্তাব ফেলতে পারল না ও। সবুজ বাসটা এখনও শর্মির সাথে সাথে যাচ্ছে। সেই সবুজ সরণী বেয়ে স্মৃতিরা ঝাঁপটাচ্ছে শর্মির আনমনা চোখে।

সেদিন সমুদের বাড়িতে কেউ ছিল না। সমুর বাবা মা সেদিন কোথাও দুর ভ্রমণে বেরালেন। বেরানোর আগেই অবশ্য শর্মি ওদের বাড়িতে পৌছে গেছিল। সমুর বাবা মার সাথে বেশ কিছুক্ষণ গল্পও করেছে ও। ততদিনে সমুদের বাড়িতে শর্মি বেশ পরিচিত মুখ। তাই দুজনকে বিদায় জানিয়ে নিশ্চিন্তে বেরিয়ে যেতে কাকু কাকিমার কোনও অসুবিধায় হয় নি। তারপরে গল্পে গানে প্রেম সোহাগ আদর ভালোবাসায় দুজনে ভেসে গেছে। আর ভালোবাসার সেই দুর্বল মুহূর্তে সমু যখন শর্মি কে সেদিন রাতে তাদের বাড়িতে থেকে যাওয়ার প্রস্তাব দেয় শর্মি না বলতে পারেনি। বাড়িতে মা বাবা চিন্তা করবে বলে ফোন করে বন্ধুর বাড়িতে আছি বলতে একটুও গলাটা কাঁপেনি শর্মির। তারপর রাতের খাওয়া হয়ে গেলে দুজনে একই বেডরুমে শুয়ে পড়ে। নিভে যায় কৃত্রিম সব আলো। জেগে ওঠে জানলার পর্দায় রাত জাগা জ্যোৎস্নার মায়া। সে মায়া সব কিছু ভুলিয়ে দেয়। নিবিড় হয়ে ওঠে দুটো শরীর। তৃপ্তির শিহরণ খেলে ভালোবাসার দোতারায়।

সবুজ বাসটা হঠাৎ স্পীড বাড়ালো। এক ঝটকায় ক্যারাভানটাকে বাঁদিক দিয়ে ওভার টেক করে চলে গেল। এবার ক্যারাভানটার গায়ে লাগানো বিজ্ঞাপনের লাইনটা সম্পূর্ণ দেখতে পাওয়া উচিত। এই আশায় সোজা হয়ে বসল শর্মি। কিন্তু কোথায় সেই ক্যারাভান। তাকে তো ডান পাশে দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না। কোথায় গেল। তবে কি সেটাও স্পীড বাড়িয়ে সামনে চলে গেছে। বুঝতে না পেরে ওলার ড্রাইভারকে আরও জোরে চালাতে বলে শর্মি।  সম্পূর্ণ লাইনটা তো দেখতেই হবে শর্মিকে। আতঙ্কের শেষ লগ্নে কি জন্ম নেয় সেটা যে জানতেই হবে। কারণ বেশ কিছু দিন হলো একটা চোরা আতঙ্ক শর্মিকে গিলে খাচ্ছে। আর পারছে না সে। এবার কিছু করতেই হবে। বেশ জোরে ছুটছে ওলা টা। দেখতে দেখতে পেরিয়ে গেল কৈখালী, হলদিরাম। বাঁদিকে রাজারহাট যাওয়ার ফ্লাইওভার পিছনে ফেলে গাড়ি এখন বিগ বাজার মোড় থেকে কেষ্টপুর ফ্লাইওভারে পড়ল। ঐ তো দেখা যাচ্ছে ক্যারাভানটা। একটা আম্বুলেন্সের সামনে। শুধু মাথাটা দেখা যাচ্ছে। ওলাটা যথেষ্টই জোরে চালাচ্ছে ড্রাইভার ছেলেটা। কিন্তু মুশকিল হলো কেষ্টপুর ফ্লাইওভারে সবাই জোরে গাড়ি চালাই। তাই এই ফ্লাইওভারের প্রায় আড়াই কিলোমিটার পথে আর ক্যারাভানটাকে ধরার সম্ভাবনা কম। কিন্তু তারপরই তো দমদম পার্ক ক্রশ করেই বেলি ব্রীজ চলে আসবে। আর ওখান দিয়েই তো ওলা বাঁদিকে সল্টলেকের পথ ধরবে। তখন যদি ক্যারাভানটা সোজা চলে যায় তাহলে তো আর জানা হবে না “আতঙ্কের শেষ লগ্নে জন্ম নেয়...” কি? আবার একেবারে সম্ভাবনা নেই তাও বলা যাবে না। কিন্তু এই মুহূর্তে কিছুই করার নেই বুঝে হতাশ হয়ে শর্মি আবার তার স্মৃতির সারণীতে ফিরে আসে।

সেই যে শুরু কাছে আসার, তারপর থেকে সুযোগ সুবিধা মতো মাঝে মাঝেই শর্মি ডুবে গেছে সমুর শরীরী ভালোবাসায়। এতটাই তারা দুজন দুজনকে মিস করতে শুরু করে যে তাদের শরীরী ভালোবাসার ভিডিও করে রাখে যাতে দুজন দুজনকে অফলাইনেও কাছে থাকার অনুভবে যাপন করতে পারে। কিন্তু এটাই যে বুমেরাং হতে যাচ্ছে সেটা শর্মি গিয়ে বুঝল অনেক পরে। ততদিনে মুখোশ খুলে ফেলেছে সমু। একদিন কথায় কথায় বিয়ে নিয়ে কি ভাবছে সমু, জিজ্ঞাসা করলো শর্মি।
“ আমাদের প্রেমের আজ ষষ্ঠ বর্ষ পূর্তি হলো। কেমন স্বপ্নের মতো মনে হয় যেন সব কিছু। “ আজকের বিশেষ দিন নিয়ে উচ্ছ্বসিত শর্মি।
“ সেই যে তোমার চোখের দীঘিতে ডুব দিয়ে ছিলাম প্রথম দিন, তারপর থেকে তো আমি এখনো হাবুডুবুই খেয়ে চলেছি। স্বপ্ন দেখারও সুযোগ পাচ্ছি না।“ সমুর গলায় যথা রীতি মজার ছোঁয়া।
“ ইসস্। স্বপ্ন বুঝি শুধু আমিই  দেখবো। তুমি দেখবে না?” বুকের মাঝে ঘন হয়ে এসে আহ্লাদী গলায় বলে শর্মি।
“ দেখি তো স্বপ্ন। আরও বড় হওয়ার। ইকনমিক্সের নাম্বার ওয়ান ডেটা অ্যানালিস্ট হওয়ার। আমার আর্টিকেল গুলো ইতিমধ্যে বাংলা নিউজ পেপার গুলো ছাপাতে শুরু করেছে। এরপরই টার্গেট সর্ব ভারতীয় পত্রিকা। “ গর্বিত ভঙ্গিতে বলে উঠলো সৌম্যকান্তি।
“ তুমি বড়ো হও সে তো আমিও চাই। কিন্তু..। “
“কিন্তু কি?” অধৈর্য হয়ে ওঠে সৌম্য।
“ কিন্তু সেই স্বপ্নে আমি কোথায়?”
“ কি বলতে চাও তুমি?” শর্মিকে বুকের থেকে সরিয়ে দিয়ে জিজ্ঞাসা করে সৌম্য।
“ মানে এবার আমাদের একসাথে স্বপ্ন দেখার সময় হয়েছে। সেটা কি তুমি বোঝো না!” একটা অভিমান পাশ ফিরে শোয় শর্মির মনের মাঝে।
“ ছাড় তো এসব। চলো আজকে আমরা লং ড্রাইভে মন্দারমনি যাবো। আজ রাতে ওখানে থেকে কাল চলে আসবো।“ সৌম্যর এড়িয়ে যাওয়াটা বুঝতে পারে শর্মি। অভিমানটা দলা পাকিয়ে গলা দিয়ে উঠে আসতে থাকে। তবু সৌম্যর উপর অগাধ বিশ্বাসে শর্মি চলে যায় মন্দারমনি।
“ দেখো বাবা মা এখন বারবার বলছে বিয়ের কথা। এবার তুমি বাড়িতে ব্যাপারটা বলো।“ মন্দারমনির মোহময়ী রাতের উথাল-পাথাল করা মৌতাত কাটিয়ে পরের দিন ফেরার পথে আবার প্রসঙ্গটা তুলেছিল শর্মি।
“ এতো তাড়াহুড়ো করছ কেন? বলছি তো বাবা মা কে ঠিক সময় হলেই বলবো।“ সমুর গাড়ির স্পীড আচমকাই বেড়ে যায়। শোঁ শোঁ করে বয়ে যাওয়া বাতাস কিছু যেন বলতে গিয়েও থমকে যায় শর্মির টলটলে চোখের দিকে তাকিয়ে।
“ এই নিয়ে গত ছ মাস ধরে তুমি একি কথা বলে যাচ্ছ। তুমি বুঝতে চাইছো না আমার অবস্থা। বাবা রিটায়ার করে গেছে তিন বছর হলো। দাদা বৌদি ইঙ্গিতে বাবা মা কে বলেই চলেছে আমাকে কেন বিয়ে দেওয়া হচ্ছে না। আর আমি তো বুঝতে পারছি না তোমারই বা সমস্যা কোথায়। “
“ সমস্যা আছে।“
“ কিসের সমস্যা সেটা তো বলবে।“ শর্মি যেন পণ করেছে আজ জবাব নিয়েই ছাড়বে।
“ আমি এখন ক্যারিয়ার নিয়ে ব্যস্ত। আমি এখন অন্য কোন দিকে সময় দিতে পারবো না।“ সামনে একটা বাম্প ছিল। গতি না কমিয়ে তার উপর দিয়েই চালিয়ে দিল সমু। আচমকা ঝনঝন করে উঠলো গাড়িটা।
“ তার মানে তুমি আমাকে তোমার প্রকৃত জীবন সঙ্গী ভাবো না। আমার উপস্থিতি তোমার জীবনে অনুপ্রেরণা নয়। বরং বোঝা। তোমার উন্নতির অন্তরায়। অথচ বিয়ে হীন প্রেম...”। শর্মিকে শেষ করতে দেয় না সৌম্য।
“ উফফ্। টিপিক্যাল মিডল ক্লাস মেন্টালিটি! “ বিরক্তি ঝড়ে পড়ে সৌম্যর গলায়। আঘাত পায় শর্মি। রুষ্ট কন্ঠে বলে ওঠে –
“ মিডল ক্লাসরাই এই সমাজটার ভ্যালুসগুলো এখনো ধরে রেখেছে। না হলে উচ্চবিত্তরা যে ভাবে সমাজের সর্ব স্তরে দুর্নীতি ছড়িয়ে দিচ্ছে তাতে হয়তো সমাজটাই ভেঙে খান খান হয়ে যেতো। “
“ তুমি কি চাও বলো তো? “ সৌম্য সোজা তাকায় শর্মির চোখের দিকে।
“ আমি চাই তুমি আমাকে বিয়ে করো। চলো একসাথে জীবনের ছন্দে পা মেলায়। আমাদের প্রেম পাহাড়ি নদীর শুধু উচ্ছাস ছেড়ে সমতলের গভীর ব্যাপ্ত দুই তীর ভরিয়ে দিক তার পলি মাটি দিয়ে। নবান্নের ঘ্রাণে পরিপূর্ণ হোক জীবন।“ দু পাশের সোনালি ফসলের ক্ষেতের বুক চিরে চলে গেছে পিচের কালো রাস্তা। তার মধ্য দিয়ে তীব্র গতিতে ছুটে চলেছে গাড়িটা।
“ আমার পাহাড়ি নদীই ভালো লাগে। সমতলের মন্থর নদী নয়।“
“ তার মানে তুমি বিয়ে করতে রাজি নও।“
“ না এখনই রাজি নই। পরে ভেবে দেখবো।“ সৌম্যর উদাসীনতা খান খান করে দিচ্ছে শর্মির স্বপ্ন। কেমন সুবিধাবাদী শোনায় সৌম্যর কথাগুলো। না আর স্বপ্নের ফেরি নয় এবার রুঢ় বাস্তবের মুখোমুখি দাঁড়ায় শর্মি।
“ তাহলে তুমি বিয়ে করবে না। অথচ সহবাস চালিয়ে যাবে! আমি সব বলবো কাকু কাকিমা কে...” কথা শেষ করতে পারেনা শর্মি। তার আগেই সৌম্যর একটা বলিষ্ঠ হাত চেপে ধরে শর্মির মুখ। তারপর হিসহিস করে চাপা গলায় বলে ওঠে সৌম্য-
“ ভুলে যেও না তোমার সমস্ত নগ্ন গোপন ছবি ভিডিও গুলো কিন্তু আমার কাছে আছে। সোশাল মিডিয়ার জন্য তার একটাই কিন্তু  যথেষ্ট!”
স্তব্ধ হয়ে যায় শর্মি। এটা কি বলল সৌম্য। গাড়ির উইন্ডস্ক্রিনে হু হু করে বয়ে যাওয়া বাতাস চাবুকের মতো পড়তে থাকে। সারা রাস্তা কেউ আর কোনো কথা বলে নি।

ওলাটা কেষ্টপুর ফ্লাইওভারের ডাউনওয়ার্ড স্লোপ দিয়ে নামতেই বেশ জোরে ব্রেক কষে ড্রাইভার।  আর তাতেই চটক ভাঙে শর্মির। আরে তাই তো। ওলাটা তো আবার ক্যারাভানটার পাশে চলে এসেছে। তবে ক্যারাভানটা এখন ওদের বাঁদিকে। ওদের মাঝখানে শুধু সেই অ্যাম্বুলেন্সটা। এখন দমদম পার্কের সিগন্যালে দাঁড়িয়ে আছে। সিগন্যালটা খুললেই অ্যাম্বুলেন্সটা নিশ্চয় আগে বেরিয়ে যাবে। আর তখনই এত ক্ষণের প্রতীক্ষা সার্থক হবে। মনে মনে ভাবে শর্মি।

সেদিনের ঘটনার পর টানা দু মাস কেউ কারোর সাথে যোগাযোগ করেনি। না শর্মি। না সৌম্য। তারপর প্রথম ডাকটা আসে সমুর কাছ থেকেই। আর সমু ডাকলে আজও শর্মি না বলতে পারে না। একদিকে ভালোবাসার প্রবল আবেগ আর একদিকে সেদিনের অপমানের তীব্র দহন সাথে চোরা সেই আতঙ্ক শর্মিকে একেবারে দিশাহারা করে ফেলেছে। সোশ্যাল মিডিয়াতে যদি সত্যি সত্যি সৌম্য ভিডিও গুলো আপলোড করে দেয় তাহলে কি হবে। বাবা, মা, আত্মীয় পরিজন, বন্ধু বান্ধব,  পরিচিত সবার মাঝে মুখ দেখাবে কি করে। সেদিন থেকে আতঙ্ক কুরে কুরে খাচ্ছে শর্মিকে। আর পারছে না সে। আতঙ্কের শেষ  সীমায় পৌঁছে গেছে। কি করবে বুঝতে পারছে না।

সিগন্যাল টা খুলেছে। অ্যাম্বুলেন্সটা হুটার বাজাতে বাজাতে পড়ি মরি করে হুস করে চলে গেল। আর তারপরই পিছন দিক থেকে হুড়মুড়িয়ে চলে আসল একটা মিছিল। নো ক্যাব। নো এন আর সি স্লোগান দিতে দিতে। সিগন্যালটা আবার লাল করে মিছিলটা কে দমদম পার্কের দিকে ঘুড়িয়ে দিল ট্রাফিক পুলিশ। আর তারপরই ঝলমল করে উঠলো বিজ্ঞাপনের পুরো স্লোগানটা ক্যারাভানটার গায়ে।

ইয়েস ! পেয়ে গেছি উত্তর। মনে মনে ভাবলো শর্মি। মেরুদণ্ডটা সোজা করে বসল গাড়ির মধ্যে। বেলি ব্রীজ ক্রশ করছে ওলাটা। এখুনি পৌঁছে যাবে সল্টলেকে সমুদের বাড়ি। সমস্ত দ্বিধার পরিসমাপ্তি। আর কোন আতঙ্ক নেই। সমস্ত দোলাচল, সংকোচ, অনিশ্চয়তা ঘুচিয়ে দিয়ে গেল স্লোগানটা।

ওলাটা একেবারে সমুদের এ ই বল্কের বাড়ির কাছে থামল। ভাড়া মিটিয়ে ওলাটা ছেড়ে দৃঢ় ভঙ্গিতে বাড়ির মধ্যে ঢুকলো আত্মবিশ্বাসী শর্মি। বেল বাজাতেই দরজা খুললো সমু। সাদা পাঞ্জাবি সাথে ব্লু জিনসের প্যান্টে হ্যান্ডসাম সমু। একগাল হেসে শর্মিকে জড়িয়ে ধরে ভিতরে নিয়ে গেল। আজও বাড়িতে কেউ নেই। সমু জেনে শুনেই আজকে বাড়িতে ডেকেছে তাহলে। দু একটা মামুলি কথা বলার পরই শর্মিকে গভীর ভাবে জড়িয়ে ধরল সমু। তারপরে আদরে আদরে পাগল করে দিল শর্মিকে। আস্তে আস্তে নরম হয়ে যাচ্ছিল শর্মি। তবু নিজেকে সমুর আলিঙ্গন থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে সপাটে বলল শর্মি-
“ দেখো তোমার সাথে সহবাসে আমার আপত্তি নেই। কিন্তু আজ তোমাকে আগে বিয়ের কথা ফাইনাল করতে হবে এবং তোমার বাবা মা কেও জানাতে হবে আমার সামনে। “

হো হো করে হেসে উঠল সৌম্য। দু পা হেঁটে কম্পিউটার টেবিল থেকে পেন ড্রাইভটা নিয়ে চোখের সামনে নাচিয়ে বলে উঠল – “ এটা নিশ্চয় ভুলে যাও নি তুমি!”

শমির চোয়াল শক্ত হলো। চোখের সামনে ভেসে উঠলো ক্যারাভানে দেখা জনপ্রিয় টেলি সিরিয়ালের থিম স্টেটমেন্ট  –
“ আতঙ্কের শেষ লগ্নে জন্ম নেয়  লড়াই।“
হ্যাঁ। লড়াই। আতঙ্কের খাদ থেকে বাঁচতে ওটাই শেষ অস্ত্র। সেটাই প্রয়োগ করলো শর্মি –
“ তুমি ওগুলো সোশ্যাল মিডিয়ায় দেখাতে চাও তো। দেখাও। আমার কাছে ওগুলো ভালোবাসার চিহ্ন। লজ্জার নয়। কিন্ত যেটা লজ্জার সেটা হলো তোমার রুচি ও মানসিকতার। আর মনে রেখ ওই ভিডিও গুলোর এক কপি আমার কাছেও আছে। আমি চললাম...”
“কোথায় যাচ্ছ?” চেঁচিয়ে ওঠে সৌম্য অচেনা শর্মিকে দেখে।
“ পুলিশ স্টেশন। ওদেরকেই আমি সব খুলে বলবো। আর হ্যা এই ভিডিও গুলো দেখিয়েই বলবো যে তুমি বিয়ের মিথ্যে প্রতিশ্রুতি দিয়ে আমার সাথে সহবাস করেছ।“ এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলেই সোজা দরজার বাইরে বেরিয়ে আসে শর্মি।

“ এক মিনিট শর্মি। এক মিনিট। এদিকে দেখো।“ সৌম্যর চোখে চকিতে খেলে যায় এক ধূর্ত হাসি। শর্মি বুঝতেও পারে না। ফিরে তাকাই সৌম্যর দিকে।
সৌম্য ধীরে ধীরে পাঞ্জাবীর পকেট থেকে বের করে আনে বহু ব্যবহৃত সিঁদুরের কৌটো আর সেটা তুলে ধরে শর্মির চোখের সামনে।
পাপোশে পা মোছে শর্মি ।



          লাখু গোয়ালার গরু          
ঋভু চট্টোপাধ্যায়

দরজাটা হাল্কা খুলে মুণ্ডুটা দরজার ভিতরে কিছুটা ঢুকিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘ডাক্তার সাহেব আসব?’ ডাক্তারবাবু মাথা তুলে একবার দেখে বললেন, ‘তুমি কে,সোজা আমার ঘরে, কি ব্যাপার?’
–এজ্ঞে আমি লাখু গোয়ালা,আমার লখির লগে এয়েছি।
–কি হয়েছে তোমার লখির?
-এজ্ঞে বাচ্চা দিবেক।
–বাচ্চা দিবেক তো ভর্তি করে দাও।
-এজ্ঞে ইখানেই গ্যাঁড়া, ভরতি লিছে নাই।
-কেন?
-এজ্ঞে টিকিটের লাইনে কত কথা, বাপের নাম শুধায়, মায়ের নাম শুধায়।
-তুমি তাদের নাম বলবে।
-ইখানেই গ্যাঁড়া, মায়ের নাম জানি, আদুরি, কিন্তু বাপের নাম তো জানি না।
–কেন? তোমার মেয়ে নয়?
-বিটির পারা বটে, কিন্তু বিটি লয়।
-তাহলে যার মেয়ে তার নামটা লিখে দাও, আর এখান থেকে যাও, আমার অনেক কাজ।
–উখানে তো নাম লিছে নাই।
-আচ্ছা আমি বলে দেব, এবার নাম নিয়ে নেবে।
তারপরেই মহকুমা হাসপাতালের সুপার বেল বাজিয়ে হাসপাতালেরর এক চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারিকে ডেকে বললেন,‘এই পল্টু এই লোকটার কি হয়েছে একটু দেখে দিও তো।’ কর্মচারি ভদ্রলোক আচ্ছা বলে বেরিয়ে যাওয়ার মিনিট কুড়ি পরে এক্কেবারে হাঁপাতে হাঁপাতে সুপারের ঘরে এসে বলেন,‘স্যার লোকটা একটা গরু নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি করতে এসেছে, গরু নাকি বাচ্চা দেবে।’ কথাটা শুনেই সুপারের মাথার অবশিষ্ট চুলগুলো নিজেদের মধ্যে ঝগড়া ঝামেলা আরম্ভ করে দিল।এই হাসপাতালে যোগ দেওয়ার পর প্রতিদিনের নিত্য নতুন ঝামেলাতে মাথার চুল পঞ্চাশটাতে গিয়ে ঠেকেছে।ঝামেলা বলে ঝামেলা, জন্ম প্রমান পত্র থেকে মৃত্যু প্রমান পত্র, ডাক্তার থেকে জমাদার, মোক্তার থেকে ফোক্তার, ঝামেলা করতে কেউ বাদ দেয় না।এর পর রোগী থেকে ভোগি, পেসেন্ট পার্টি থেকে লোকাল পার্টি, ব্যান্ড পার্টি ও তো আছে।সুপারের অবস্থা এখন ছেড়ে দে মা ঘুমিয়ে বাঁচি।কিন্তু এসব কথা বাইরের লোককে বলা যায় না।তাই একটু ঝাঁঝ নিয়ে বলেন, ‘লোকটাকে ডাকো তো দেখি।’ ডাকতেই লাখু গোয়ালা হাজির।সুপারের দিকে তাকিয়ে একটা লম্বা পেন্নাম ঠুকে বলে, ‘বলেন স্যার।’
–তোমাকে এই হাসপাতালে গরু নিয়ে আসতে কে বলেছে?এটা কি গরুর হাসপাতাল?
-তা লয় জানি, কিন্তু আমাকে যে বললেক এখন মানুষের হাসপাতালে পশুদেরও চিকিৎসে হচে।
শেষের কথাটা শুনে সুপার রীতিমত রেগে উঠে বলেন, ‘কে বলেছে, এই কথা কে বলেছে শুনি।’
-এজ্ঞে আমার পুঁটিকে যে মাস্টার পেরাইভেট পড়ায়, সেই তো বললেক।
-তোমাকে বলে দিলে, আর তুমি অমনি নিয়ে চলে এলে।
-কি করব সার, আমি তো লেকাপড়া শিখি নাই, আমাকে যা বললেক তাই করলুম। বললেক, ‘লাখু কাকা, তুমার গরুর বাচ্চা দিবে, তুমি আমাদের মহকুমা হাসপাতালে নিয়ে চলে যাবে।’ আমি অবাক হয়ে শুধারাম, ‘আমাদের হাসপাতালে আমার লখির চিকিৎসে করবেক কেনে?’ আমাকে বললেক, ‘তুমার আর বুদ্ধি হল নাই কাকা, কলকেতাই মানুষের হাসপাতালে কুকুরের টিরিটমেন্ট হইচে, আমাদের হাসপাতালে তুমার গরুর চিকিৎসে হবেক না কেনে?’
আমি বললুম, ‘নারে তুই আমাকে বোকা বানাচ্ছিস।’ আমাকে বললেক, ‘নাগো কাকা, তুমি এক কাজ কর, পঞ্চায়েত অফিস থেকে লিখিয়ে নাও।’
আমি সঙ্গে সঙ্গে আমাদের পাড়ার ডালু বোসকে বললাম, দুদিন পর ডালু বোস কাগজ দিয়ে দিলেক, আমার লগে ভারি খাতির কিনা।শেষের কথাগুলো শুনেই সুপার রীতিমত অবাক হয়ে বলল,‘তোমাকে কাগজ দিয়ে দিলে?’
–লাখু বেশ স্বাভাবিক ভাবেই বলে, ‘হুঁ, দিবে নাই কেন? আমাদের গাঁয়ের বটে।’
রাগে তখন সুপারের মাথা ফুটতে আরম্ভ করছে।যথা সম্ভব মাথা ঠাণ্ডা রেখে বলে, ‘দেখি তো কাগজ টা।’
লাখু গোয়ালা পকেট থেকে কাগজটা বের করে সুপারের হাতে দিল।কাগজটা পড়ে সুপারের চোখ দুটো  খুলে পাশের গাছে চেপে যাওয়ার মত অবস্থা হল।কাগজের ভাষা সত্যি হলে গরুর নাম লক্ষী ঘোষ, বাবার নাম লক্ষণ ঘোষ।সুপার কাগজটা টেবিলে রেখে লক্ষণের দিকে তাকিয়ে বলে, ‘তুমি পড়াশোনা কর নি?’
–এজ্ঞে না, নুনু বেলাতে গেদে অভাব ছিল, পড়তে পারি নাই।
সুপারের অনেক কথা বলতে ইচ্ছে করলেও কিছু না বলে শুধু বলে, ‘দেখ এটা মানুষের হাসপাতাল, এখানে পশুর চিকিৎসা হয় না।’ লাখু বলে,‘কেনে, কলকেতার হাসপাতালে কুকুরের টিরিটমেন্ট হলে ইখানে গরুর হবেক নাই কেন?’
এই প্রশ্নে সুপার কি উত্তর দেবে বুঝতে পারছিল না,শুধু বলে,‘তোমাদের গ্রামে গরুর ডাক্তার যায় না?’
–যায় সার, তবে ভালো লয়, প্যাটে পুকার উষুধ দ্যায়, উসব খেলে গরুট গেদে লাদে,ইতিমধ্যে বাইরে একটা গোলমাল শুনে সুপার তার চেম্বারের বাইরে এসে দেখে হাসপাতালে ভিতরে সবাই একটা গরুকে নিয়ে অস্থির। গরুটাও হাম্বা হাম্বা করে ডেকে বেশ কয়েকটা ঘরে কিছু ক্ষয় ক্ষতি করে শেষে লেবার রুমে ঢুকে পড়েছে।কথাটা শুনে লক্ষণ লেবার রুমের ভিতর গিয়ে মিনিট দশ পরে হাসি মুখ নিয়ে বেরিয়ে বলে, ‘আমার লখির বকনা হইছে। গ্যাঁজলাটা কেটি গেলে আপনাকে খাঁটি দুধ খাওয়াবো।’



 রাস্তা

ওড়িয়া গল্প  : লক্ষী চান্দ
অনুবাদ  : প্রদীপ কুমার রায়

-একবার রাস্তা পাল্টে গেলে কেমন হয় ...!
- রাস্তা , মানে....?
- এই আমাদের সামনে চিক্ চিক্ এই পিচ রাস্তাটার মতন ।
- যতোসব আজেবাজে কথা  । কি রে তুই কেনো রাস্তা হতে যাবি ।
- ছোট্ট দিন থেকে রাস্তা আমাকে খুব টানে । দেখছিস না যেই রাস্তা আমাদের কে আগে নিয়ে যায়, সেই রাস্তা আবার আমাদেরকে ফিরিয়ে নিয়ে আসে ।
- কি অদ্ভুত তুই ! সেইটাই তো রাস্তা র কাজ । এই কথাটা নিয়ে এতো ভাবুক হবার কি আছে !
- না রে , রাস্তা খালি রাস্তা নয় । জীবনের গতিকে ত রাস্তা ই নিয়ন্ত্রণ করে কিনা বল ! আমাদের জীবনের সঙ্গে তার এক সূক্ষ্ম সম্পর্ক আছে । রাস্তাই ত আমাদের সব অত্যাচার সহ্য করে আমাদের আগে নিয়ে যায় ।
- শুন্ , আমার এখন অনেক কাজ । তোর এইসব বাজে কথা শোনার সময় নেই আমার । আমি বললাম ।
- তুই যাবি যদি যা । কিন্তু যেতে যেতে শুনে যা , আমি একদিন রাস্তা হয়ে যাবো আর তুই আমার উপর দিয়ে হেঁটে চলে যাবি ।
- ধুর্ পাগল , যতোসব বাজে কথা ।

তারপরে আমরা দুইজন আলাদা, নিজের নিজের কাজে ব্যাস্ত কারোর কাছে সময় নেই । ওর বাজে কথা মনে রাখতে ও আমার ইচ্ছে নেই ।

কিন্তু কিছু দিনের পর আবার আমরা সেই জায়গায় একসাথে । তবুও সে তার অদ্ভুত পাগলামি নিয়ে । আমি অনেকটা পথ এগিয়ে যেতে পেরেছি । অথচ সে আটকে রয়েছে তার সেই রাস্তা র প্রেম নিয়ে । আমি জানিনা সে রাস্তা কে কেনো এত ভালো বাসে । কেন তার সব স্বপ্ন কে জমাকরে রাস্তা র নামে উইল্ করে দিতে চায় । আমি জানি কিছু পাগল থাকে যারা কিছু একটার প্রতি অত্যন্ত ভাবপ্রবণ এবং আসক্ত । কিন্তু এই নির্জীব রাস্তা কে এইরকম ভালোবাসা আমি কোথায় ও দেখিনি ।
আমাকে দেখামাত্র সে বললো - রাস্তা......
- এই , আমি এখন আমার স°সার নিয়ে ব্যস্ত। প্লিজ , তোর রাস্তা ফাঁস্তা নিয়ে কথা বলিস না । যদি অন্য কিছু বলার আছে তবে বল ‌।যা আমার কাজে লাগবে, জীবন টা একটু সুখের হবে ।
- আহ্ ... তুই এতো বস্তুবাদী । আমার কথা শুনতে তোর ইচ্ছে নেই । তুই ত আমার একমাত্র বন্ধু । তুই যদি শুনতে না চাইবি , আমি আর কাকে বলবো ।

সে অভিমান করে ।
দূরে চলে যাবার জন্য অন্য রাস্তা ধরে ।

এখন আমার হেরে যাওয়া উচিত ভেবে আমি হেরে যাই । চিত্কার করে ওকে ডাকি । সব আমি শুনবো বলে ওকে কথা দেই ।
ও খুসি হয় । আমার কাছে ফিরে আসতে পা বাড়ায় ।

কিন্তু ওর ফিরে আসাটা ঠিক ফিরে আসা নয় ।একটা গাড়ির ভীষণ ধাক্কা খেয়ে রাস্তার উপরে পড়ে । আমার চোখের সামনে রাস্তায় ওর খণ্ড খণ্ড রক্তাক্ত দেহ । রাস্তা চেটে নেয় ওর সব রক্ত ।

এই সেই রাস্তা ।
এখন সেই রাস্তা এবং তার উপর আমি দাঁড়িয়ে.....!



 ভাদ্রের রোদ
শ্রাবণী গুপ্ত সরকার

একটা মধ্যবিত্ত ভদ্রপাড়া। মোটামুটি প্রায় সবাই শিক্ষিত। পাড়ার সবচাইতে বড়ো বাড়িটায় ছোট বড়ো মিলিয়ে জনা বাইশেক সদস্য তো হবেই। কর্মজীবনের কারণে অনেকেই পৈত্রিক বাড়িতে থাকেন না। কিন্তু সব উৎসবে, পার্বণে জমজমাট বাড়িতে ফিরে আসার আকর্ষণ সবারই প্রবল।

যে বাড়িতে এত লোক, সে বাড়িতে একদঙ্গল ছানাপোনাও থাকবেই। সে দলটিও মন্দ নয়, নানাবয়স মিলিয়ে সতেরো জন তো বটেই। সব সময়ই চলছে হৈ হল্লা। একদল স্কুলে বেড়িয়ে গেল তো, অন্যদল কলেজে রওনা হলো। বিরাট রান্নাঘরে দুটো উনুনে রান্না হয়েই চলেছে সকাল বিকেল।   

এত লোকের বাড়িতে পুজোআর্চা লেগেই আছে। নিত্য পুজোর সঙ্গে লক্ষ্ণী পুজো, নারায়ণ পুজো আর সরস্বতী পুজো হয়। বাঙাল বাড়ি, খুব ঘটা করে অক্ষয় তৃতীয়ার কাসুন্দি তৈরীর ধূম দেখা যায়,  জামাইষষ্ঠীর দিন পুজো হয় আর হ্যাঁ তার সঙ্গে এলাহি পেটপুজোর বন্দোবস্তও থাকে। বিরাট ছাদে প্রায় বারোমাস রোদ খায় আচার, বড়ি আর আমসত্ত্ব। বিশ্বকর্মা পুজোয় পাড়ার ছেলেদের সঙ্গে মিলেমিশে ছাদে ঘুড়ি ওড়ায় বাড়ির ছেলের দল। 

এই বাড়ির বড়ো বৌ সবসময়ই অগোছালো, সন্তানাধিক্যে স্বাস্থ্যহীনা, সদাব্যস্ত। কাজকর্মের ফাঁকে   বাড়ির ছোটোদের নামতা মুখস্থ করানো, ছড়া শেখানোর কাজটাও চালান ভালোবেসে। আর বাড়ির বাগানে রকমারি সব্জির গাছ লাগানো, তাদের দেখভালও করেন বড়ো যত্নে। 

প্রতিটি পুজোর বিধি অনায়াসে মনে রাখেন বীথি। বাবার আদরের মেয়ে, অকাল পিতৃবিয়োগে পড়াশোনায় ইতি দিয়ে প্রবেশ করেছেন সংসার জীবনে। সংসারে বড়োদের ত্যাগ করার নীতিতেই বিশ্বাসী তিনি। বাড়ির সব ছোটোরাই তাঁকে বড়ো ভালোবাসে। সবসময়ই হাসিমুখে থাকেন তিনি।

ভাদ্রমাসে তালের বড়া তৈরীর সঙ্গে এ বাড়িতে ভাদ্রের রোদে আলমারি আর ট্রাঙ্কের জিনিসপত্র দেওয়াও একটা পর্ব বটে। ছাদ, সব কটা বারান্দা বোঝাই হয়ে যায়। একটা ন্যাপথালিন মেশা পুরোনো গন্ধে বাড়িটা ভরে ওঠে। ছোটোরা চকচকে চোখে তাকিয়ে থাকে কোথাও যদি কোন গুপ্তধন, হয়তো একটা পুরোনো বই কিংবা হারানো খেলনা পাওয়া যায়। তাতেই কত মজা।   

এই রকমই এক ভাদ্রের সকালে একতলার বারান্দায় বীথি আর তাঁর স্বামী সমীরবাবু ঘর থেকে  জিনিসপত্র এনে রাখছিলেন পেতে রাখা মাদুরের উপর। বেনারসী শাড়ি, পুরোনো বালিশ, কাঁথার রাশি, নানারকম বইপত্র, ওষুধের বাক্স, ঝিনুক বাটি... কি নেই। একটা ছোট বাক্স এনে খুলতেই বাড়ির সবার ছোটো তোড়া এসে ঝাঁপিয়ে পড়লো কি আছে দেখতে। সমীরবাবু এক ধমক দিয়ে সরিয়ে দিলেন।

একতলার বারান্দার এক কোণে ঠোঁট ফুলিয়ে বসে তোড়া ভাবছিল বাক্সটায় কি এমন ছিল যে জেঠু অমন ধমক দিলেন? কার জিনিস ওটা? সেজদি এসে অনেক বুঝিয়ে, স্নান করিয়ে ভাত খাওয়াতে বসে বললো, ওদের এক দাদা, জেঠু জেঠিমার প্রথম সন্তান, যে কিনা একটা দুর্ঘটনায় মারা গিয়েছিল, তারই কিছু জিনিস ঐ বাক্সটায় রাখা আছে। পাছে ছোটোদের হাতে পড়ে সে সব নষ্ট হয়ে যায়, তাই জেঠু প্রথম সন্তানের স্মৃতিটুকু আগলে রাখার জন্য একটু কঠোর হয়েছিলেন। 

পরে সেজদি বাক্সটা খুলে দেখালো ছোটো ছোটো জামা, জুতো, কত ছড়ার বই, লাট্টু, বল। মনটা  খুব খারাপ হয়ে গেল তোড়ার। বইয়ে নাম লেখা ছিল ‘সবুজ মজুমদার’--- ওদের সবার বড়দা, বেঁচে থাকলে কত বড়োটাই না হতো। এত কষ্ট জেঠু আর জেঠিমা চেপে রাখেন! হাসিমুখে সব কাজ করেন, কিন্তু বুকের মধ্যে বয়ে চলে অনন্ত দুঃখের অতল নদী।

বছর দশেক পরে যখন হাসপাতাল থেকে জেঠুর প্রাণহীন দেহটা বাড়িতে এলো, সেদিনও এক ভাদ্রের দুপুর। অসুস্থ জেঠিমাকে এনে বসিয়ে দেওয়া হলো খাটের একপাশে। শোকার্ত মানুষটি বলে উঠলেন, “যাও, সেখানে গিয়ে তোমার বাবা-মাকে দেখতে পাবে, সবুজের সঙ্গেও দেখা হবে। ভালো থেকো। আমার জন্য আর কিছুদিন অপেক্ষা করো।” তোড়া দেখলো জেঠিমার মুখটা আকাশের আলোয়  উজ্জ্বল লাগছে।




শেষ বেলায়
সুস্মিতা দে

ঘড়ির কাটায় ৯ টা বেজে ৬ মিনিট। বাইরে গ্রাস করেছে অন্ধকার, তোলপাড় করছে ঝড়ে। গাছ গুলো যেন উন্মাদের মতো বেহিসেবী আচড়ে পড়ছে।

গৈরিকের ঘরে তখন ঝড়ের তাণ্ডবে লোডশেডিং। জানলা খোলা। ঠাণ্ডা হাওয়া ঢুকছে। অন্ধকারে সে বিছানার ধারে পা ছড়িয়ে বসে। তৃষা ওর হাঁটুর ওপর মাথা রেখে পাশ ফিরে শুয়ে আছে। গৈরিকের ডান হাতটা তৃষা দুহাতে ধরে রেখেছে নিজের গলার কাছে। আর গৈরিক বা হাতের আঙুল ডুবিয়ে হাত বোলাচ্ছে তৃষার ভেজা চুলে।

হঠাৎ একটা আলোর ঝলকানিতে চমকে উঠল গৈরিক। তারপর বিকট বাজ পড়ার শব্দ। এক মুহুর্তও দেরি না করে জানলাটা বন্ধ করতে গেল গৈরিক। শাটারটা টানতে গিয়ে দেখল ফ্ল্যাটের পাশে সুপারি গাছের মগডালটা ভেঙে পড়েছে তারের ওপর।
তৃষা অযথা ভয় পাবে বলে ওকে কিছু না বলেই জানলাটা বন্ধ করে দিল গৈরিক।
পেছন ফিরে দেখল ঘরময় অন্ধকার। রহস্যময়ী তার প্রেমিকা মোমবাতি জ্বালিয়ে ঘরে ঢুকছে। তৃষা মোমবাতিটা আড়াল করে মাটিতে রাখল।

দুজনে বসল খাটের ধারে। আসার সময় বৃষ্টিতে ভিজে যাওয়ায় গৈরিক নিজের একটা শার্ট পড়তে দিয়েছিল তৃষাকে। মোমবাতির আলো যেন জড়িয়ে ধরেছে তৃষার নগ্ন কোমল পা দুটো। গৈরিককে কোনো মায়ার জাল তৃষার দিকে ক্রমশ টেনে চলেছে। অপলক দৃষ্টিতে সে তাকিয়ে তৃষার হাঁটুর নীচের দিকে।

জানলার পাশের লাইট পোস্টটা থেকে হঠাৎ আলোর এক ঝলক ঢুকল ঘরে। কেপে উঠল গৈরিক। পুরোনো মোহো থেকে সামলে নিল নিজেকে। মনে পড়ল, গত দুসপ্তাহ আগে তৃষার ফোনে খুঁজে পাওয়া চ্যাট গুলোর কথা। গৈরিক খাটের কোণে সরে গিয়ে ফোন ঘাটতে শুরু করল।

তৃষা বুঝতে পারল ওর প্রতিটা চেষ্টাই বৃথা। শেষ কোনো আশা বেঁচে নেই আর। গলা শুকিয়ে এলো। বিছানা থেকে উঠে জানলাটা খুললো তৃষা। দাপুটে হাওয়া খোলা চুলের বাঁধ ঠেলে ঢুকল তিনতলার ঘরে। চোখ বন্ধ করল তৃষা। ওর মুখে তখন বৃষ্টির ছিটে। ভিজেছে বুকের কাছে শার্টটাও।

গৈরিক নিঃশব্দে পাশে এসে দাঁড়াল। বিদ্যুতের নীলাভ আলো জমেছে তৃষার মুখের প্রতিটা রোমকূপে। আফসোস হলো, তৃষার এই অকৃত্রিম রূপ কোনোদিনও না দেখার। প্রকৃতির আধাঁরেই আজ সেজেছে তৃষা।

জানলার রেলিঙে তৃষার রাখা ডান হাতটা ধরল গৈরিক। তৃষা অসহায়ভাবে তাকাল গৈরিক এর দিকে। প্রথম দিন কলেজ ক্যান্টিনের সেই অপলক দৃষ্টির স্মৃতি নিয়ে নিজেদের ফিরে পেল তারা। তবে এবার শেষবারের মতো।

গৈরিক তৃষার চিবুকটা তুলে গালে আলতো করে মুছে দিল গড়িয়ে পড়া অনর্গল জলের বিন্দু। তৃষার গালে হাত রেখেই গৈরিক স্মিত হেসে বলল,
– তুই ভালো থাকবি, দেখিস।
– হয়ত।
– বিয়েতে বলবি তো?
– যোগাযোগ রাখবনা ...
– লুকিয়েও জানবি না কেমন আছি!
– না।

হঠাৎ একটা ঝোড়ো হাওয়া ধেয়ে এলো দুজনের দিকে। মুখ নামালো তৃষা। দুজনেই নিঃস্তব্ধ।

তৃষা গৈরিকের হাতটা ধরে কাতর স্বরে কেঁদে উঠল,
– তুই কি কোনোদিনও ক্ষমা করবিনা গৈরিক?
– তোর ওপর আমার একটুও রাগ নেই রে পাগলি
– তবে একটা সুযোগ ...
– যে শরীরে আমার পর অন্যকারোর অধিকার আসে আমি তাকে মেনে নিতে পারবনা রে। কোনোদিনও না।

আবার একটা ঝোড়ো হাওয়া। বসার ঘর থেকে আওয়াজ এলো কিছু ভেঙে পড়ার। গৈরিক তৃষার হাত সরিয়ে ঘর থেকে বের হলো। মোমবাতিটা নিভে গেল।।




খেলাঘর
শর্মিষ্ঠা ব্যানার্জি

এই প্লিজ দেখনা প্রীতম, আমাদের মাস্টার বেড়রুমে এই পার্পল কালার টা কেমন হবে?  , আদুরে গলায় দেবযানী প্রীতমের পিঠে টোকা দিয়ে জিজ্ঞেস করল।  প্রীতমের চোখ ল্যাপটপে সাঁটা, সে  আজকাল অফিসের কাজ বাড়িতেও বয়ে আনে।  অন্য কোনদিকে কি হচ্ছে সে সব দিকে তার নজর দেবার  সময়  কোথায়।   এই সমস্ত পাতি ব্যাপারে মাথা ঘামাতে সে পছন্দ করে না  ।কাজের জগতে উন্নতি করাই তার প্রধান লক্ষ্য  । ল্যাপি থেকে চোখ না সরিয়েই দেবযানী কে বল্ল উফ বিরক্ত কোরো না প্লিজ , তোমার যা পছন্দ তাই করাও না, আমি কি বারণ করেছি কোনোদিন তোমায়।
তা বলে তোমার একটা চয়েজ থাকবে না?   এবার একটু পিছন ফিরল প্রীতম,  হাতে শেড়কার্ড মেলে বসে থাকা দেবযানী র দিকে তাকাল বিরক্তিভরে। প্লিজ দেবী, তোমার যা ভালো লাগে করাও যা টাকা লাগবে নাও, কিন্ত এখন আমাকে ডিস্টার্ব কোরোনা ।
কথাগুলো বলেন আবার ল্যাপটপে মনোনিবেশ করে প্রীতম । এসব কথা শুনতে আজকাল অভ্যস্ত হয়ে গেছে দেবযানী, অবহেলা গুলো তার গা সওয়া  হয়ে গেছে ।
 সত্যিই তো প্রীতম তাকে যথেষ্ট সুখে রেখেছে, কোনো অভাব রাখেনি তার যখন খুশি শপিং,  পার্লার এ গিয়ে রূপটান , বন্ধুদের সাথে মিট করা ।  একটা মেয়ে যা যা চাইতে পারে তার অনেকটাই তাকে দিয়েছে প্রীতম। কিছুতেই তো বাধা দেয় না । তার ও তাই  উচিৎ প্রীতমের সুবিধে অসুবিধে গুলোকে মানিয়ে নেওয়া।

এই যে এই নতুন ফ্ল্যাট  কেনা, তার সাজানো গোছানোর জন্য যা দরকার তার টাকা চাইলে প্রীতম কোনো প্রশ্ন না করেই দেবযানীর হাতে তুলে দিয়েছে গোছা গোছা টাকা, । তবু দেবযানীর মনে হয় প্রীতম যদি একটু কিছু অন্তত বলতো ফ্ল্যাট টা সাজানোর ব্যাপারে,   তাহলে  ভালোই লাগত তার ।  বিছানা থেকে উঠে স্লিপার পায়ে গলিয়ে নেয় দেবযানী ।হেমন্তের সন্ধ্যেতে এখন অল্প অল্প ঠান্ডা ভাব ।ব্যালকনি তে টাঙানো দোলনায় এসে বসে ।  মূহুর্ত গুলোকে একলাই উপভোগ করতে শিখে গেছে আজকাল সে।


সকাল আটটা নাগাদ প্রীতমের অফিসের গাড়ি আসে, প্রীতমের আজ একটা ইমপর্টেন্ট মিটিং আছে । যাবার আগে বলে গেছে ফোন সুইচড় অফ থাকবে চিন্তা না করতে আর ফোন না করতে।  সকাল দশ টা নাগাদ ই রাজু রঙ মিস্ত্রী ঢুকে পড়ে। কাজ অনেক টাই এগিয়ে এসেছে। দেওয়ালে পুট্টি প্রাইমার সব রেডি, এবার শুধু রঙ টাই বাকি। আজ স্টাড়ি রুম টা রঙ করবে ওরা। নীল ঘরের দেওয়াল জুড়ে থাকবে আলমারি ভর্তি বই... আর বই। আর জানলার কোনে ছোট্ট একট স্টাড়ি টেবল।  গরীব স্কুল মাস্টারের মেয়ের স্বপ্ন এর চেয়ে বেশি আর কিই বা হবে । বাবা বলতো নীল রঙ জ্ঞানের রঙ। আকাশের মতো, সমুদ্রের মতো জ্ঞানের বিস্তার, বিশালতা, উদারতা নীল রঙে । সব পাচ্ছে আজ তোমার মেয়ে বাবা, শুধু কি যেন একটা  নেই?  মনে মনে বলে দেবযানী। আচ্ছা মনে মনে বলা কথা কি বাবা শুনতে পাবে?  হাসি পায় দেবযানীর । প্রীতম বাবার প্রিয় কৃতি ছাত্র ছিল একসময়। প্রীতমের সাথে দেবযানীর বিয়ের সময় বাবার গর্বিত মুখটা আজো মনে পড়ে  যায় দেবযানীর  ।
আচ্ছা কায়াহীন রা কি ছায়ামানুষের কথা শুনতে পায়?  কে জানে।


রাজুর কথায় মনোযোগ ভাঙে,  ভাবিজি, দেখিয়ে আজ ক্যেয়া লায়া আপকে লিয়ে।  রাজু হরিয়ানার ছেলে। কলকাতায় এসেছিল কাজের খোঁজে, তারপর লক্ষীরানী সাঁতরা কে বিয়ে করে বাঙালী ই হয়ে গেছে। ছেলেটা আসে সিঙুরের দিক থেকে, বিয়ের পর শ্বশুরবাড়িতেই ক্ষেত খামারী করে আর মাঝে মাঝে ডাক পেলে রঙের কাজ।  ভারি ভদ্র ছেলেটি।  মাঝে মাঝেই কাজের ফাঁকে  দেবযানী কে মুগ্ধতার দৃষ্টি তে দেখে । দেবযানী 7বুঝতে পারে সব ।  তবু কিছু বলে না। রূপ তো দেখার জন্যই। কিন্ত এই রাজুই কাজ করতে শুরু করলে তার মতো মনোযোগী মানুষ কাউকে পাওয়া যাবে না। কত যত্ন নিয়ে দেওয়ালে সাদা রঙ কে রঙিন করে তোলে।  দেওয়াল গুলোও যেন বেরঙ সাদা থেকে রঙিন হতে পেয়ে ঝলমলিয়ে হাসে।
ওমা কি বড়ো ফুলকপি গো, আর আর পালং গুলো কি কচি কচি,  বাচ্চাদের মতো খুশি তে উজ্বল হয়ে ওঠে দেবযানীর মুখ।  তোমাদের ক্ষেতের বুঝি?
রাজুর  মুগ্ধতা ভরা চোখ একটু লাজুক হয়, মাথা নামিয়ে মেঝের দিকে তাকিয়ে বলে হাঁ ভাবি।
কপট রাগ দেখিয়ে দেবযানী বলে, আবার কেন আনলে? এই তো পরশু মটরশুঁটি আর বেগুন এনেছিলে। আজ কিন্ত দাম নিতেই হবে।
নেহি ভাবি, বো হম নেহি লেংগে। হামনে প্যার সে দিয়া আপকো, তো ফির পঁয়সা কিঁউ?
খিলখিল করে হেসে ওঠে দেবযানী, হাসির দমকে চোখে জল এসে যায় তার। আচ্ছা বাবা দাম দেবো না। কিন্ত আর আনবে না কেমন । তোমার বউ কি বলবে বলতো।

রঙের বালতি ব্রাশ তুলে ঘরের দিকে যেতে য গিয়েও রাজুর চোখ আটকায় দেবযানীর দিকে । সুন্দর মুখে হাসির  উচ্ছ্বলতায় আরো খুবসুরৎ লাগছে তার ভাবীকে। ঠিক যেন টিভিতে দেখা মাধুরী দিক্ষিত।
লক্ষীরানী বহুত আচ্ছি হ্যা ভাবী, উসনে হি দিয়া ইয়ে আপকে লিয়ে।  কথাটা শুনে  উদাস হয়ে যায় দেবযানীর মন।  ইসস এমন একটা সংসার যদি তার থাকতো। শুধু ভালোবাসা, মায়া মমতা দিয়ে গড়তো তার নিজস্ব জগৎ কেমন হতো তাহলে।
বেলা গড়ায়, দেবযানীর ঘরের  সাদা দেওয়ালগুলো নীল হয় ক্রমশ। প্রীতমের  আজ মিটিং তাই ফোন করাও মানা। দেবযানী জানে সবকিছুই, প্রীতমের অফিসের বস সায়না  কাপুর এর  সাথে প্রীতমের রাত জেগে লুকিয়ে সেক্স চ্যাটিং। মিটিং এর নাম করে সিঙ্গাপুর এ আউটিং। সব জেনেও সে চুপ করে থাকে। কখনো কখনো চুপ করেই থাকার মধ্যেও সুখ আছে । মনে পড়ে ছেলেবেলায় বাবা কত খেলনাবাটির সেট কিনে দিত সেই সব  দিয়ে সাজাতো তার নিজের খেলাঘর। কখনো ভাঙত আবার নতুন করে সাজাতো।

সেই নকল খেলাঘর সাজাতে সাজাতে কখন যে নকল টাকে আসল ভেবে ফেলেছে তাই কি ছাই দেবযানী জানে । এই খেলাঘর ইচ্ছা করলেও সে নতুন করে ভেঙে সাজাতে পারবে না। তবু প্রত্যেকটা দিন সে অভিনয় করে চলে সুখী জীবনের । মনে মনে বলে আমি সুখী সুখী সুখী। অলস দুপুরে বারান্দার কোনে এলোভেরা গাছের পাশে বসে পাতা উলটে বের করে তার প্রিয় কবি নির্মলেন্দু গুণের কবিতার লাইন গুলো

শিশুরা খেলাঘর করে,
তারা হাঁড়ি, পাতিল,বাসন কোসন নিয়ে
বড়োদের মতো সংসার সংসার খেলে।
তারপরে, একসময় ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ে
ঘুমভাঙা র পর শুরু হয় তাদের অন্যখেলা।
এক্কাদোক্কা, গোল্লাছুট কিংবা কানামাছি ভোঁ ভোঁ।

বড়োরাও খেলা ঘর করে।
তাদের বাসন – কোসন গুলো আকৃতিতে বড,
তাদের কামনা বাসনার মতো
তারা তাদের খেলাঘরের নাম রাখে সংসার।
শিশুদের মতো তারাও ক্লান্ত হয়,
তারাও সংসার ভাঙে, কিন্ত শিশুদের মতো ঘুমতে পারে না।



মা তুঝে সেলাম
চৈত্রী চৌধুরী

স্বাধীনতা দিবসেও ছুটি নেই। প্রাইভেট কোম্পানি। বিশেষ প্রয়োজনে অফিসে যাচ্ছি বাসে করে। কিছুদূর যেতে এক স্টপেজ থেকে এক ভদ্রমহিলা আরেকজনকে নিয়ে উঠলেন বাসে। প্রতিবন্ধী সিটে তাকে বসিয়ে নিজে দাঁড়ালেন গা ঘেঁষে। ভিড় বাস। তিলধারনের জায়গা নেই। ভিড়ের জন্য দেখতে পেলামনা কাকে নিয়ে উঠলেন মহিলা। মহিলার মুখে ঘামের বিন্দু, চোখেমুখে ক্লান্তি। বাস কন্ডাক্টর জিজ্ঞেস করলেন, “দিদি, আজও স্কুল?”
হাসেন মহিলা। “না, আজ আসলে ফ্ল্যাগ হোয়েস্টিং আছে। এমনি স্কুলের মত ওদের স্কুলেও হয় তো”।
বুঝলুম মহিলা প্রতিবন্ধী স্কুলে নিয়ে যাচ্ছেন সন্তানকে। একটু পরে নেমে গেলেন ওঁরা। খেয়াল করে দেখলাম, ওনার ছেলে প্রতিবন্ধী। ডানদিকের প্রায় পুরোটাই অচল। ক্রাচে ভর দিয়ে হাঁটলেও সাহায্য লাগে। ডানদিকের চোখও নষ্ট। তাছাড়া, দেখে মনে হল হালকা মস্তিষ্ক বিকৃতিও আছে। সন্দেহ হল, মাকে আদৌ চিনতে পারছে কি? এমন ছেলেকে স্কুলে নিয়ে যাওয়া কত কষ্টকর ভেবে মন কেঁপে উঠল।

হাসিমুখেই নামলেন মহিলা। ধরে ধরে নামালেন ছেলেকে। চুলটা ঠিক করে দিয়ে ওর মুখের ঘাম মুছিয়ে দিলেন। কন্ডাক্টরকে পয়সা মিটিয়ে বললেন, “আসি”। রাস্তার মোড়ে লাগানো মাইকে হঠাৎ বেজে উঠল দেশাত্মবোধক গান, “মা তুঝে সেলাম”। বাস ছেড়ে দিলো। ধীরে ধীরে গলির মোড়ে হারিয়ে গেল মহিলা ও তাঁর ছেলের অবয়ব।