এবং খোঁজ

মাসিক সাহিত্য পত্রিকা

বৈশাখ, ১৪২৭ বঙ্গাব্দ।। বর্ষ-১ 

আত্মপ্রকাশ সংখ্যা: জন্ম




সুজনেষু,
          "পৃথিবীর গভীর গভীরতর অসুখ এখন", আশা করি কুশলে আছেন। 'এবং খোঁজ' ব্লগের নামকরণ থেকে শুরু করে লেখা জমা দেওয়া পর্যন্ত যেভাবে আপনি পরিবার প্রীতি দেখিয়েছেন- ব্যক্তিগত ভাবে আমি মুগ্ধ। ভবিষ্যতেও এভাবেই পাশে থাকবেন আশা রাখাটা তাই অমূলক নয়।

চিরাচরিত প্রথা ভেঙে 'এবং খোঁজ' ওয়েব ম্যাগাজিনের কোনও মনোনীত লেখসূচি বা সূচিপত্র থাকছে না! থাকছে না কোনও সম্পাদকীয় কথা না বাড়িয়ে "আজি শুভ দিনে" আসুন অক্ষর যাপন করি।





।। কবিতা ।।


আরাধ্য
 শান্তনু পাত্র

যখন মূলরোম জল খোঁজে
বুকের গভীরে বাজে দীর্ঘশ্বাস
পাতা খোঁজে বিরল আলোক
অপেক্ষা ফিরে যাও,
অন্ধকার হাতড়ে হাতড়ে
ফিরে যাও রাতপাখি।

ঠিক তখনই সেই হাসি,জলোচ্ছ্বাসের মতো
ঈশ্বরীয় প্রতিধ্বনি ছুটে যায়;
ছুটে যায় পৃথিবীর প্রাণ, বান ডাকে।

বসে আছি গভীর সমুদ্রের মতো
নারী বারবার ফিরে আসে
আরাধ্য প্রেমিকের কাছে
ঠিক যেন উতলা নদীটি।


ইয়ার্কি এক অবৈতনিক প্রেম
রবিন বণিক

সুনন্দা, তুমি কি জানতে ইয়ার্কি এক অবৈতনিক প্রেম
যত খুশি মারো যেন এক অমায়িক সরলরেখা
এসো, জলে পেতে রাখি আমাদের ইয়ার্কি–জীবন
নির্দিধায় দু'চারটে অক্টোপাসের দিকে বাড়িয়ে দিই ঠাট্টার হাত
সেও নিশ্চিন্তে বাড়িয়ে দেয় অগাধ অতল স্রোত

সুনন্দা, জানো ইয়ার্কি এক দুলে ওঠা শৈবাল–দল
বাতাসও ইয়ার্কির মতো নির্দিধায় ঢুকে পড়ে ফুসফুসে
বড় হয়, ক্রমে ক্রমে দীর্ঘ হতে থাকে আমাদের অবৈতনিক প্রেম—



ছায়া
গোলাম রসুল

এখানে গাছের ছায়া সরু হয়ে এসেছে
রুগ্ন একটি কবরের ধারে দাঁড়িয়ে আমি অনুমান করছিলাম পৃথিবীর নিরবতা
জলে আমাদের ছায়া প্রাণপণ বাঁচার চেষ্টা করছে
কি কারণে আমরা জলের ধারে এসেছিলাম জানি না
আর কি কারণে আমরা জন্মেছিলাম অচেনা
কবরের আর্তনাদের ভেতর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে নদী
বালি নেই কান্না নেই আমাদের  অভিজ্ঞতায়


    ছোঁয়া
    দেবাশিস সাহা

মাথার উপর রোদ ডাকে
মা ছুটে বেড়ায় পাঁচ বাড়ি
আচঁলে জলখাবার
বাবুদের


 দয়া ভরা দু-হাতের ছোঁয়া
 শাড়ির আঁচলে
চোখ বুজলেই
           সেই দৃশ্য
গা ঘিন ঘিন করে
চাঁদ ওঠে
মা পিঠ শুকাতে দেয়
অন্ধকার শুষে নেয়
                  মা 'র পাপ
আমার হাতে
      কোনো পাপ
          লেগে নাই তো!


মাটির স্টপেজে নেমে
হরিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়


মায়ের হাত ধরে হঠাৎ করে
বাস থেকে নেমে পড়তাম মাটির স্টপেজে
একটা গল্পবলা সোজা রাস্তা
হ্যারিকেন জ্বলা চায়ের দোকানটা
মাথায় বসে থাকে দাদুর মতো

একটু এগিয়ে যেতেই কামার কাকা
লোহা পেটাতে পেটাতে মুখ তুলতো
হাতুড়ির নিচে দেখতাম
সাঁড়াশিতে ধরা রাস্তা
পাঠশালা ছড়িয়ে আছে দিগন্ত জুড়ে
মাথা নিচু করে সুর দিয়ে সবাই পড়ছে নামতা

হাত ধরে ধরে হাঁটি
চায়ের দোকানের ঝাঁপ বন্ধ হলে
চাঁদ তারা পথে আলো জ্বালে
কোনো মুখে নেই ঘুমকথা
হাঁটতে হাঁটতেই ঘুম পাড়ায় মা
ঘুমের মধ্যে দেখি খসে গেছে হাত
হাঁটার উৎসবেই খুশি ঝরে পড়ে

প্রায় ত্রিশ বছর পরে
আজ সকালে মায়ের কুলুঙ্গির কৌটো থেকে
বার করেছিলাম হাঁটার গল্প
আবার সাজিয়ে রাখলাম
মাটির স্টপেজে নেমে দিগন্তের সবুজের ওপারে
হারিয়ে যাওয়ার নদী।



।। রম্যরচনা ।।


  এক বর্ষণ মুখর রাতে
     কণিকা দাস

            রাত তখন গভীর। সারাদিন ভ্যাপসা গরমের পর সন্ধ্যার দিকে একটু একটু করে মেঘ জমছিল। এখন তুমুল বৃষ্টি হচ্ছে।শিলিগুড়ি শহরের   চিলড্রেন পার্কের ভিতরে দাঁড়ানো বিদ্যাসাগর মহাশয় মনে মনে ভাবেন- নাহ্,অনেকদিন ধরে এই এক ভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে পায়ে বাত ধরে গেল। যাই আজ একটু বেড়িয়ে আসি। দেখি আমার মতো আরো যেসব বন্ধু মূর্তি হয়ে দাঁড়িয়ে আছে তারা কে কেমন আছে! তিনি আড়মোড়া ভেঙে বেদি থেকে নামার সময় ভাবলেন, একটা ছাতা হলে ভালো হতো। পরক্ষনেই হাসলেন। ধুর ছাতা দিয়ে কি হবে? এমনিতে তো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভিজতে থাকি।  গাছের জন্য অবশ্য মাথায় জলটা কম পড়ে। কিন্তু ওই যে বজ্জাত পাখিগুলো! ওগুলো তো আমার মাথা, কাধ, নাক, মুখে নিজেদের কম্ম সারার জায়গাই করে নিয়েছে। গন্ধে নাড়িভুঁড়ি উল্টে আসে। কি আর করা যাবে? দাঁতে দাঁত চেপে তাই সহ্য করতে হয়। তবু ভালো, আজ একটু বৃষ্টির জলে স্নান করে শুদ্ধ হওয়া যাবে। এই ভেবে তিনি হাঁটতে শুরু করলেন। একে তো গভীর রাত, তার উপরে বৃষ্টি। রাস্তায় একটা প্রাণীও নেই। কয়েকটা কুকুর নিরাপদ আশ্রয়ে থেকে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে। কই ওরা তো তাড়া করছে না! এমনিতে তো এত রাতে একটা বাইক যেতে দেখলেও ঘেউ ঘেউ করে 'এই মারি তো সেই মারি' করে তেড়ে আসে! যাক্ গে, ওদের মতলব বোঝা আমার কম্মো নয়। তিনি হাঁটতে হাঁটতে বাঘাযতীন পার্ক এর সামনে এসে পড়েছেন। এখানে এত আলো আর ওই বেদীটা দেখে অবাক হলেন।  ভাবতে ভাবতে এগুচ্ছেন। 'বিদ্যাসাগর বাবু'….ডাক শুনে থমকে দাঁড়ালেন। এরকম ক্ষীণস্বরে কে আবার ডাকছে?

          ডানদিকে তাকিয়ে দেখেন আলো অন্ধকারে মাথা বাড়িয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।--ওহে তুমি এখানে! কাছে গিয়ে বললেন, চলো হেঁটে আসি।

      করুণ কণ্ঠে রবি ঠাকুর বললেন, আমার কি আর সে জো আছে? দেখুন না আমার অবস্থা। মাথা থেকে বুকের অর্ধেক পর্যন্ত কেটে বসিয়ে রেখেছে। কি কষ্ট কি কষ্ট!একটু নড়াচড়ও করতে পারিনা। দিনরাত কেবল হাত দিয়ে কাকপক্ষী তাড়িয়ে দিন কাটে। 

       বিদ্যাসাগর দেখলেন ঠিকই তো! বললেন আজকের মানুষগুলোকে ঠিক বুঝতে পারি না। কি দরকার ছিল অর্ধেক ধর এখানে বসিয়ে রাখার! এতই যখন তোদের শ্রদ্ধা-ভক্তি তখন নিচের অংশ জুড়ে দিলি না কেন? কি আর করা যাবে! তা ভাই ওই যে ওখানে এত আলো ওটা কি?   

        ওটা শহীদ মিনার। বাংলা ভাষাকে স্বীকৃতি দানের জন্য লড়াইয়ে যারা শহীদ হয়েছেন তাদের উদ্দেশ্যে নির্মাণ করা হয়েছে।

       ওখানে মূর্তি নেই কেন?

   এত লোকের মূর্তি কি করে এক জায়গায় রাখবে? তাই হয়তো নেই! মাঝখানে যে মাথা নিচু করে আছে সে হল মা-- মানে মাতৃভাষা। আর দু'দিকে দুটো করে চারটা স্তম্ভ যারা মাথা উঁচু করে আছে ওরা সন্তান। মায়ের অসম্মান হতে দেবে না কিছুতেই।

         বিদ্যাসাগর মনে মনে ভাবেন, যাক তাহলে আমার দেশের মানুষ বাংলা ভাষাটাকে ভোলেনি। প্রকাশ্যে বলেন যার মাথায় এই প্ল্যানটা এসেছে তাকে সাবাস দিতেই হয় কি বলো?

      ঠিক বলেছেন।

      তুমি এখানে দাঁড়িয়ে কত কিছু দেখতে পাও!

      -- হ্যাঁ, এই যে দেখতে পাচ্ছেন ঘরটা, এখানে নানা রকম অনুষ্ঠান হয়। ওই শহীদ বেদীতেও হয়। মাইক লাগানো থাকে তাই আমি শুনতে পাই।

      --তা আজকালকার ছেলেপুলেরা বাংলা ভাষায় পড়াশোনা করে? আমার বর্ণপরিচয়, তোমার সহজপাঠ? যা দেখি--! সকাল থেকে আমার সামনে দিয়ে কত বাস যায়। সব ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের নাম লেখা। কিছু ছাত্রছাত্রীকে অবশ্য হেঁটে, রিক্সায়, সাইকেল বা টোটোতেও যেতে দেখি। ওরা নিশ্চয়ই তোমার আমার বই পড়ছে!

         ওরা পড়ে কিনা জানিনা, তবে শহীদ দিবস বা আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে তো ওরা গলা ফাঁটায়, আজকের প্রজন্ম নাকি বাংলা একদম পড়তে চায় না। মা-বাবাও এই নিয়ে গর্ব করে বলেন- আমার ছেলেটা, মেয়েটা বাংলা একদম পড়তে পারে না। বাংলাটাও যদি ইংরেজিতে পড়া যেত তাহলে কত ভালো হত।

          বিদ্যাসাগর মহাশয় একটা ভারী নিঃশ্বাস ফেলে  বলেন-- অথচ দেখো আমরা ব্রিটিশ আমলেও বাংলাভাষার উন্নতির জন্য কত পরিশ্রম  করেছি। আর আজকাল কি হলো!...তোমার তো আবার এই বাংলা গান, কবিতা আর গল্পতেই বিশ্বজোড়া নাম।

     রবি ঠাকুর গর্বের হাসি হেসে বলেন-- তা যা বলেছেন! তবে আপনিই বা কম কিসে? মেয়েদের শিক্ষার প্রসারে আপনার অবদান তো অনস্বীকার্য। কিন্তু এই আধুনিক মেয়েরা কি আমার কথা আর মনে রেখেছেন? দুজনে চুপ থাকেন কিছুক্ষণ।

        তারপর বিদ্যাসাগর বাবু বলেন, রবি তুমি তো আবার চলতে পারবে না যাই আমিই একটু হেঁটে আসি।

         রবীন্দ্রনাথ পিছু ডাকেন। বিদ্যাসাগর বাবু কদিন আগে শুনলাম কে বা কারা আপনার মূর্তি ভেঙ্গে ফেলেছে? এই নিয়ে তো এই পার্কের মাঠেও  কত লোক জড়ো হয়ে প্রতিবাদ করলো! বিদ্যাসাগর  বলেন আমার ওখানেও বেশ কিছু লোক জড়ো হয়ে প্রতিবাদ করলো, তাই জানতে পারলাম। কলকাতার বিদ্যাসাগর কলেজের ঘটনা। তা বাপু তোদের কে বলে এই মূর্তি বানাতে আর কেইবা বলে ভাঙতে? আমরা তোদের জন্য যা দিয়ে এসেছি সারা জীবন সেগুলো ধরে রাখ্ না। তাহলেই তো আমরা তোদের মাঝে বেঁচে থাকি। আমাদের নিয়ে তোদের আর রাজনীতি না করলেই নয়? আমরা যে শিক্ষা এতদিন ধরে তোদের দিয়েছি সেগুলো অক্ষরে অক্ষরে পালন করলে, দেশের সব লোকের ভিতর শিক্ষার আলো পৌঁছে দিলে আর কোন সমস্যা থাকে! এই যে আমাদের কোথাও গলাসহ মুন্ডুটা,  কোথাও আবার কোমর পর্যন্ত, কোথাও সারা শরীর বানিয়ে রেখেছে সেখানে কাকপক্ষী তাদের পয় নিষ্কাশন এর জায়গা বানিয়ে নিয়েছে। এগুলো সহ্য হয় বলো? সারাদিন গাড়ির ধোঁয়ায় নাক চোখ জ্বালা করে। বৃষ্টিতে ভিজি, রোদে শুকোই। দে না বাবা একটা ছাউনি দিয়ে। আমরা তাও একটু সম্মান নিয়ে বাঁচি। শুধু জন্মদিন আর মৃত্যু দিন এলে তোদের মনে পড়ে আমাদের কথা। তখন ঝাড়পোছ, রং লাগানো আর মালা পড়ানো। ব্যাস কর্তব্য শেষ।

     বিদ্যাসাগর মহাশয়কে উত্তেজিত হতে দেখে রবি ঠাকুর বলেন, এভাবে উত্তেজিত হবেন না। আপনার আবার প্রেসার বেড়ে যাবে। কি করবো বলুন? এটাই তো আমাদের ভবিতব্য। কেন যে বিখ্যাত হতে গেলাম? কেওড়াতলা শ্মশানে তো সবকিছু শেষ হয়ে গিয়েছিল আবার কেন টেনে আনা!

        এদিকে তখন বৃষ্টি থেমে গেছে। রাতও প্রায় শেষ হয়ে এল। বিদ্যাসাগর মশাই বললেন, ওহে এবার যেতে হবে। লোকজন আবার প্রাতঃভ্রমণে বের হয়ে গেলে আমাকে দেখে ভয় পেতে পারে। আরেক দিন সময় নিয়ে আসবো। তখন দু'জনে খোশগল্প করব।

       বিদ্যাসাগর হাত নেড়ে বিদায় জানিয়ে হন হন করে হাঁটতে লাগলেন। ততক্ষণে দু একটা পাখি বাসা ছেড়ে বের হতে শুরু করেছে।




যখন ফালগুনী রায়ের সঙ্গে আকাশে উড়তুম
মলয় রায়চৌধুরী


          যখনই ফালগুনী পাটনায় এসেছে, বলেছে, চলুন আকাশভ্রমণে যাওয়া যাক ।

          নীল তুলোয় গড়া আকাশ আমাদের দখলে,  আমরা দুজনে ডানা মেলে যথেচ্ছ উড়তুম, পালকের রঙ আর মাপ ইচ্ছানুযায়ী বদলে নিতে পারতুম, উড়তে-উড়তে বা ওড়ার আগে ।

          পুনপুন নদীর ওই পারে, গণ্ডক নদী যেখানে বাঁক নিয়ে গঙ্গায় ঢুঁ মেরেছে, তার ওপরের আকাশে, শোনের বালিয়াড়ির ওপরের সোনালি আকাশে, কোইলওয়ারের ওপরের নীইইইইইল আকাশে, উড়েছি, উড়েছি, উড়েছি, এনতার, অপরিসীম টলারেন্স লেভেল গড়ে উঠল আকাশে গিয়ে ।

          ডানা, ঠোঁট, পা, পায়ের পাতা, যখন যে পাখির চাই, সেই পাখিদের কাছ থেকে পেয়ে যেতুম । সেই পাখির আকার পেয়ে যেতুম, আর দুজনে উড়তুম পাশাপাশি, কথা বলতে-বলতে বা ঠোঁট বুজে ।

          চাকরি থেকে সাসপেন্ড, মানে অফিসে যাবার বালাই নেই, ব্যাঙ্কশাল কোর্টে সাজা হয়ে গেছে, হাইকোর্টে রিভিশান পিটিশান করেছি, কবে ডেট উঠবে তার ঠিক নেই । হাইকোর্টের উকিল পেয়েছি সদ্য ইংল্যাণ্ড-ফেরত কিরণশঙ্কর রায়ের সহযোগীতায়, উনি যার আন্ডারে জুনিয়ার, সেই মৃগেন সেন, ক্রিমিনাল লইয়ার, লড়বেন মামলাটা, আরও চারজন অ্যাসিস্ট্যান্টের সাহায্যে ; বলেছেন, চিন্তা নেই ।

         সুবিমল বসাক যোগাযোগ রেখেছে ওনাদের সঙ্গে, ডেট উঠলে জানাবে ।

          চিন্তা যখন নেই, তখন আকাশেই উড়ি । চিন্তা কেবল টাকার ।

          ফালগুনী পাটনায় ওর দিদির বাড়িতে, যাঁর প্রতিবেশী ফালগুনীর প্রেমিকার স্বামী ।

          ফালগুনী সকাল-সকাল পৌঁছে গেছে আমাদের বাড়ি, দরিয়াপুরে । ইমলিতলা পাড়া ছেড়ে দরিয়াপুরে চলে এসেছি ; হিপি-হিপিনীরা নেপালে যাবার পথে দরিয়াপুরে হল্ট করে স্টিমারে বা নৌকোয় গঙ্গা পার হয়ে হিচহাইক করে চলে যায় কাঠমাণ্ডু ।

         ফালগুনী কাঠমাণ্ডু যেতে চায় না, পাটনায় দিদির বাড়ি আসার উদ্দেশ্য তো প্রেমিকার সঙ্গে চাউনি বিনিময়, যদি সুযোগ পাওয়া যায় ।

        চাউনি বিনিময় হয়ে গেলে,  সেদিন আকাশে ওড়ার অফুরন্ত নীল, সারসদের পাশাপাশি, সাগর-ঈগলদের সঙ্গে, বেগুনি কালেমের ফিকে বেগুনি-নীল পালক আর গোলাপি ঠ্যাঙের, কালো চকচকে ফিঙের, শাদা-গোবকের ঝাঁকের, ভুবনচিলের সঙ্গে শীতের ফিনফিনে দুপুরের ওড়াউড়ি ।

          আকাশে ওড়ার অনেকরকম সরকারি হাওয়াইজাহাজ ছিল তখন, বোর্ডিং পাসও বেশ সস্তা, দু-আনা পুরিয়া, চার-আনা পুরিয়া, আট-আনা পুরিয়া, পৌয়া বাটলি আট আনা, ছটাক বাটলি চার আনা, সোমরস খুচরা দু আনা, ঠররা খুচরা চার আনা, লমনি তাড়ি পাতার দোনায় এক-আনা, মাটির ভাঁড়ে চার আনা ।

          হিপি-হিপিনিদের দেয়া লাইসারজিক অ্যাসিডে ভিজিয়ে শোকানো ব্লটিং পেপারের এক ঘন ইঞ্চের টুকরো আর পিসিপি বা অ্যাঞ্জেল ডাস্টের গুঁড়ো ফ্রি, পেইনটার করুণানিধান মুখোপাধ্যায় আর অনিল করঞ্জাইয়ের সৌজন্যে, স্টকে অবশ্য বেশি নেই ।

         একাধদিন ফালগুনী বলত, আজকে কাঁদতে-কাঁদতে উড়ব, ভুবনচিলেরা কাঁদে, চলুন চিলেদের পাশাপাশি উড়ি ; আপনি খেয়াল রাখবেন যাতে চোখের জল মাটিতে ঝরে না পড়ে, যেখানে পড়বে সেখানে হয়তো দৈত্যরা জন্ম নেবে, সে দৈত্যরা ধোঁয়ায় গড়া, আমি চাইনা ওই ধোঁয়া লোহানিপুর পাড়ায় দিদি-জামাইবাবুর বাড়ির দিকে ভেসে যাক ; আমার ভিতর এক কুকুর কেঁদে চলে অবিরাম ।

         আমি ওকে বলি, আমিও চাই না হে, তোমার জামাইবাবু সেই কলেজে পড়ার সময় থেকে আমার ওপর চটা । ওনার ক্লাসে সিটে বসে হিসি করেছিল কানাইলাল সাহা, আর উনি ভাবলেন কাজটা আমার, কেননা উনি যখন রিকশায় চাপছিলেন তখন আমি হেসে ফেলেছিলুম । উনি এতো মোটা যে রিকশঅলা বলেছিল, হুজুর আপনার ওজন তো দুজনের, আপনি একজনের ভাড়ায় কি করে যেতে চাইছেন ! রিকশয় চাপার আগে উনি প্রতিবার হুড ঝাঁকিয়ে পরখ করে নিতেন বইতে পারবে কি না ।

        ফালগুনী বললে, জানি, যেদিন থেকে শুনেছেন আপনি আমার বন্ধু , সেদিন থেকেই উনি আমাকে সাবধান করেছেন যে আপনি আমাকে উচ্ছন্নে নিয়ে যাবেন, দিদিকেও বলেছেন যাতে আপনার সঙ্গে না মিশি । আপনার গ্রেপ্তারির খবরটা ইনডিয়ান এক্সপ্রেস বেশ নোংরাভাবে প্রকাশ করেছিল ।

        তোমার দিদি আমাদের বাড়ি এসে মাকে বলে গেছেন যে আমি তোমাকে নষ্ট করে দিচ্ছি ।

        ফালগুনী বললে, ওনাদের তো পাখিদের সঙ্গে আকাশে ওড়ার, নদীর তলায় হাঙর, তিমি, সিলমাছ, ইলিশঝাঁকের সঙ্গে সাঁতার কাটার, মাটির নিচে ঢুকে ডাকিনি-প্রেতিনিদের সঙ্গে আগুনের হল্কার ভেতরে নাচবার অভিজ্ঞতা নেই, তাই ।




        আজকে গুলফি ঘাটের শ্মশানে গিয়ে ওড়া যাক, হাথুয়া মার্কেটের পানের দোকান থেকে দুখিলি গিলোরি পান কিনে খেতে-খেতে বললে ফালগুনী । তালশাঁসের মতন পানের ভেতরে ভাঙের মশলা ভরা, একটু সময় লাগে উড়তে, যতক্ষণে আমাদের ডানা আকাশ পাবে ততক্ষণে গান্ধি ময়দানের ভেতর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছে যাবো শ্মশানে ।

        তীরে বালি জমে-জমে গঙ্গা নদীর সঙ্গে শ্মশানও এগিয়ে চলেছে ; যাদের শব পুড়ছে তাদের দাদু-দিদা যেখানে পুড়েছিল, সেখানে ঘাস গজিয়েছে । শবদাহ চলছে দূরে । ভালই, আমাদের জন্য বসার জায়গা, শবাযাত্রীদের সঙ্গে, তারা একে-একে ন্যাড়া হচ্ছে, আর আমরা একটু-একটু করে উড়ছি, যেন লম্বাগলা বগিবক, ক্ষনিকেই ডানা মেলব দুজনে ।

         ফালগুনী বললে, ওই দেখুন, সময় ; আঘাত লুকিয়ে রাখাও শিল্প, বুঝেছেন ।

          বললুম হ্যাঁ, সময়কে দেখছি ।

         শবকে শোয়াবার আগে তার দেহ থেকে আঙটি ইত্যাদি খুলে নিচ্ছিল শ্মশানডোম । শবের ছেলে বললে, বাবার হাতের ঘড়িটা থাকতে দাও, ওটা ওনার প্রিয় রোলেক্স ঘড়ি, উনি বলেছিলেন  যে মারা গেলে যেন ঘড়িটা খোলা না হয় ।

         সময়কে দেখলুম, পুড়ছে ।

         ফালগুনী বললে, নীল আকাশে পৌঁচেছেন কি ?

         নাহ, এখনও মাটির কাছাকাছিই উড়ছি, চড়ুই-শালিখদের মতন ।

         তাহলে চলুন, ওই সাধুদের জমায়েতটায়, ছিলিম ফুঁকছে ।

         দুজনে বসলুম গিয়ে, কিছুই বলতে হল না, ছিলিম এগিয়ে দেয়া হল আমাদের দিকে; সাধুরা কাপড় ভিজিয়ে ছিলিমে মুড়ে ফোঁকে না, আমি রুমাল বের করে মুড়ে নিলুম ।

        দুজনেই দু-ফুঁক করে মারলুম । ফিরে গিয়ে বসলুম আগের জায়গায় । হাতঘড়ি পুড়তে আরম্ভ করেছে শবের সঙ্গে ।

        পোড়া ঘড়িটা আমাকে কনফিডেন্স দিচ্ছে, মড়াটাকে ধন্যবাদ ; একটু থেমে, ফালগুনী  বললে, সবই আছে, আমার জন্য নয় ।

        তুমি তার মানে ওড়া আরম্ভ করে দিয়েছ ! দাঁড়াও ওই আইসক্রিমের ঠেলা থেকে দুটো কাঠিবরফ কিনে আনি ।

        হ্যাঁ, আনুন, আমারও গলা শুকিয়ে গেছে, কাশতে চাই না, কাশতে ভয় করে, আমাদের পরিবারে কাশি ব্যাপারটা নিষিদ্ধ ।

        নিয়েলুম দুটো আইসক্রিম । চুষতে চুষতে মনে হচ্ছে সবকিছু নতুন, ন্যাড়ালোকগুলোর মাথা ঘিরে রুপোলি জ্যোতি, শবের আগুনে কমলা আর সবুজ রঙের পরিরা নাচছে, গঙ্গা আর নেই, সবুজের পর সবুজ ।

       ফালগুনী বললে, ভাঙের সঙ্গে পানের ভেতরে অন্যকিছুও ছিল, বুঝলেন, ওইপারের গাছগুলোও দেখতে পাচ্ছি, গাছেদের লালরঙের পাতাগুলো দেখতে পাচ্ছি, আগে এরকম গাছ দেখিনি, নৌকো দেখছেন, মাঝিদের গান শুনতে পাচ্ছেন, সালারা রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইছে বোধহয় ।

        কোন গান ?

        আপনি রবীন্দ্রসঙ্গীত জানেন ? ওই গানটা, কেন যামিনী না যেতে জাগালে না ।

        জানি, চলো ওই দিকে, জলে গিয়ে বসি, এখানে বুড়ো শবযাত্রীরাও কাঁদতে আরম্ভ করেছে, বুড়োরা এরকম ভেউ-ভেউ করে কাঁদছে, আগে দেখিনি ।

        চলুন, ফিরতে ফিরতে শুকিয়ে যাবে , সব কান্নাই শুকিয়ে যায়।

        নদীর কিনারায় গিয়ে বসি দুজনে, জলের খুদে ঢেউ ভিজিয়ে দিয়ে যাচ্ছে । স্টিমার গেলে তখন ঢেউগুলো জোর পাবে ।

        আমি শুরু করি, গলা ছেড়ে, বেসুরো হলেও কিছু এসে যায় না, জানি, শ্রোতা বলতে গঙ্গা নদী আর ফালগুনী রায় । আমার স্কুলের বন্ধু বারীন গুপ্ত আর সুবর্ণ উপাধ্যায় থাকলে তিনজনে মিলে গাইতুম, বারীন গুপ্ত তাড়ির হাঁড়িতে তবলা বাজাত গাইতে গাইতে ।


কেন যামিনী না যেতে জাগালে না, বেলা হল মরি লাজে

শরমে জড়িত চরণে কেমনে চলিব পথের মাঝে

আলোকপরশে মরমে মরিয়া হেরো গো শেফালি পড়িছে ঝরিয়া

কোনোমতে আছে পরান ধরিয়া কামিনী শিথিল সাজে


         বললুম, ব্যাস এইটুকুই মনে আছে ।

         ফালগুনী বলল, ওই কটা লাইনই গাইতে থাকুন ।

         আরেকবার গাইবার পর দেখলুম ফালগুনীর চোখে জল । কয়েক ফোঁটা পড়ল নদীর ঢেউয়ে । স্মৃতির টর্চারের কাছে পুলিশের থার্ড ডিগ্রিও পালকের সুড়সুড়ি । কিংবা হয়তো ওই বৃদ্ধদের কান্নার শোক নিজেও নিণে নিয়েছে কিছুটা ।

         এই শ্মশানে আমার বড়োজ্যাঠার মুখাগ্নি করেছিলুম ; তখন পুরুতমশায় সতীশ ঘোষাল বলেছিলেন, শ্মশানে এলে একধরণের বৈরাগ্য হয় ।

         দুজনে চুপচাপ বসে রইলুম সন্ধ্যা পর্যন্ত । আমরা সেই স্হিতিতে, যাকে হিপি-হিপিনীরা বলে ‘স্টোনড’ ।

         ফেরার সময়ে, রূপক সিনেমার কাছে ঘুগনি খেলুম । ফালগুনী বললে, আমি কিন্তু ইনসেন নই, কেবল অযাচিত ঘটনার সঙ্গে সমঝোতা করে ফেলছি । আর আপনি যেচে লাৎ খাচ্ছেন ।

        বললুম, আমার টলারেন্স লেভেল এখন অমেয় ।



          আরেক দিন ফালগুনী । সেই একই পোশাকে, ঝোলা কোট আর ধুতি, দুটোই নোংরা, কখনও কাচা হয় না, দেখলেই বোঝা যায়, কোটটা ওর বাবা বা কাকার কারোর, বা তারও আগের, ওদের জমিদারির অবশেষের চিহ্ণ । মাঝখানে সিঁথিকাটা, কাঁধ পর্যন্ত চুল, স্নান করা হয়ে ওঠেনি বেশ কয়েকদিন, নখ বড় হয়ে উঠেছে । ওর আঙুলগুলো চিত্রকরদের মতন । পায়ে চটি ।

          আমার ঘরে গিয়ে বসবে চলো । ঘরে বসে ওড়ার সুবিধা হল অযথা হাঁটতে হয় না, বাইরে বেরোলে দুপুরের রোদে ডানার পালক শুকিয়ে ঝরঝরে হয়ে যায় ।

          ধোঁয়ার গন্ধে আপনার মা জেনে ফেলবেন, বলবেন না তো কিছু ?

         ফুঁকব না, গিলব । তাছাড়া হিপি-হিপিনীরা আমাদের বাড়িকে হলটিং স্টেশান করে মা আর বাবাকে কবি-আঁকিয়েদের জগতের সঙ্গে সম্যক পরিচয় করিয়ে দিয়েছে, ছোটোলোক পাড়ায় বসবাস করার এই সুবিধা ।

         কী আছে ?

         অ্যাঞ্জেল ডাস্ট । করুণা-অনিল নেপাল থেকে ফেরার সময়ে একটু দিয়ে গিয়েছিল, বেশ মজার, নিজেকে হারিয়ে না ফেলেও ওড়া যায় । জলে গুলে খেয়ে নিলেই হল । ঘণ্টাখানেক পরে উড়তে থাকো ।

        অরেঞ্জজুসের সঙ্গে অ্যাঞ্জেল ডাস্ট বা পিসিপি গুলে খেলুম দুজনে  ; অতিথিকে অরেঞ্জজুস খাওয়ানো যেতেই পারে ।

        ফালগুনী বললে রেকর্ড প্লেয়ারটা লাগান, রবীন্দ্রসঙ্গীত নয় ।

        মোৎসার্ট ছিল, লাগিয়ে দিলুম ।প্রথম-প্রথম মোৎসার্ট শুনে বুঝতে পারতুম না, রেকর্ডের লেবেল দেখে বুঝতুম । বারবার শুনে আইডিয়া হয়ে গেছে ।

        সোফায় রুপোলি মেঘের ওপর শুয়ে ফালগুনী বলল, আমিই সঙ্গীত হয়ে গেছি, সঙ্গীত শুনছি না, সঙ্গীত হয়ে গেছি, দেখুন গায়ে হাত দিয়ে, মিউজিকের ফ্রিকোয়েন্সি অনুভব করবেন । সবকিছু বেশ ভালো লাগছে, মনে হচ্ছে কল্পনাশক্তি আঙুলের ডগায় চলে এসেছে, জলের ফোঁটা টেবিলের ওপর পড়েছে, দেখুন, দেখতে পাচ্ছেন, প্রিজমের মতো দেখাচ্ছে, প্রিজমের সাতরঙা লাইট ছড়িয়ে পড়ছে, মোৎসার্ট বললেন তো ? মোৎসার্টকে বুঝতে পারছি, অনেকদিন পর রিল্যাক্সড ফিল করছি, সবায়ের সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছে করছে, কিন্তু কেউ তো আমার সঙ্গে কথা বলতে চায় না ।

         তুমি ওড়া আরম্ভ করে দিয়েছ ; উড়তে থাকো, মেঘের ওপর দিয়ে ওড়ো, বেশি কথা বোলো না, আরও ওপরে ওঠার পর কথা বোলো।

         কথা বলতে ভালো লাগছে, বারান্দার দরোজা  দিয়ে দেখুন, আকাশের রঙ, বেগুনি হয়ে গেছে । সত্যিই কি বেগুনি ?

         বেগুনি রঙটা মোৎসার্টের সঙ্গীতের প্রতিধ্বনি, অবাস্তব নয় ।

       ধ্বনি শুনছি না কিন্তু, কেবল প্রতিধ্বনি শুনছি, কান পেতে শুনুন, রাস্তার লোকজন আর যানবাহন চলারও প্রতিধ্বনি শুনছি আয়নার দিকে তাকান, আয়নার দিকে তাকান, টান দিচ্ছে, আয়নাটাই আমাকে টান দিচ্ছে । রাস্তায় তাকান, রাস্তায় তাকান, রিকশটা ভাসছে, রিকশঅলা কই, ট্রাকটাও উড়তে উড়তে চলে গেল ।

        তুমি বললে, তুমিই সঙ্গীত হয়ে গেছ, নেশা করলে কি তুমি তোমার কবিতা হয়ে যাও ?

        সোফায় সটান মেঘের ওপর শুয়ে ফালগুনী বললে, এক্ষুনি বলতে পারব না, নেশা  ছেড়ে গেলে বলতে পারব । এখন আমি ওই পিঁপড়েটার সঙ্গে কথা বলতে পারি, পিঁপড়েটা আমার কথা ঠিক বুঝতে পারবে ।

        দুপুরে মাংস-ভাত খাবার পর ফালগুনীকে আরেকবার প্রশ্নটা করলুম ।

        ফালগুনী বলল, জিজ্ঞাসা করেছিলেন নাকি ? তখনই বলতে পারতাম, এখন পারব না, এখন কবিতা নিয়ে ভাবতে চাই না ; বাড়ি গিয়ে ঘুমাতে চাই । কেমন একটা চাপ-দেয়া পীড়া ছিল যখন এসেছিলাম, কানে অস্পষ্ট কোলাহল ছিল, অ্যাঞ্জেল ডাস্টে পীড়া লাঘব হল মনে হয় । বাকি যেটুকু আছে, নিজে খাবেন না, আরেকদিন বসব ।  রিকশা ভাড়াটা প্লিজ দিয়ে দিন ।



        আজকে কনভেন্ট স্কুলের মোড়ের দোকান থেকে চরস কিনে খাওয়া যাক, কী বল ? ফালগুনীকে বললুম ।

        খাবার কথা বলছেন কেন ? ফুঁকলে বেশি আনন্দ হবে ।

        আনন্দের জন্য ফোঁকো ?

        দৈনিক ব্যানালিটি থেকে বেরিয়ে শান্তি পাই ! আমি কি বোদলেয়ার নাকি যে কবিতা লেখার জন্য নেশা করব !

        বোদলেয়ার, থিওফেল গতিয়ে আর ওনাদের আগে ডি কুইনসি, এই নেশাগুলোর কথা কিন্তু বলেছেন সৃজনশীল হয়ে ওঠার জন্য ।

        ধ্যুৎ । বোদলেয়ার হ্যাশিস, আফিম আর মারিহুয়ানার তুলনায় ওয়াইনকে গুরুত্ব দিয়েছেন ওনার আর্টিফিশিয়াল প্যারাডাইস বইতে ।

        তার কারণ হল রোমান্টিকরা প্রাচ্যের নেশাকে মনে করত জংলিদের সংস্কৃতি । তাইতো দেখা যায় এমিল জোলার বইতে  মদ খাওয়া আর বৈভবের তোল্লাই ; উল্টো দিকে আমাদের দেশে ওনাদের ঢঙে মদ খাওয়াটা অধঃপতনের লক্ষণ । আসলে উপনিবেশবাদ ওইভাবে প্রতিফলিত হয়েছে আমাদের আর ওনাদের সংস্কৃতিতে। বোদলেয়ার আফিম আর হ্যাশিশের বিরুদ্ধে লিখে গেছেন ; আফিমের ব্যবসা ইউরোপই চালু করেছিল, ভারতে আফিম চাষ করে চিনে রপ্তানি করত । আফিম বিক্রির টাকায় তৈরি হয়েছিল রোমান্টিক যুগের বনেদ । বোদলেয়ারও আফিম খেতেন সিফিলিসের যন্ত্রণা উপশমের জন্য ; অথচ পরে গিয়ে আর্টিফিশিয়াল প্যারাডাইস লিখলেন প্রচ্ছন্নভাবে ওয়াইনের গুণগান করে ।

       ফালগুনী বললে, আমি কবিতা লেখার জন্য নেশা করি না, নেশা করি দৈনন্দিন ব্যানালিটি থেকে বেরোনোর জন্য, আপনি যদি আমাদের বাড়ির সদস্য হতেন তাহলে বুঝতে পারতেন, কলকাতায় সময় কাটানোটাও ব্যানাল হয়ে দাঁড়িয়েছে । মেঝে থেকে মার্বেলপাথর তুলে বিক্রি করে দিচ্ছে কেউ-কেউ । প্রেম নেই, প্রেমে না-থাকার ব্যাখ্যাহীনতা আছে ।

       তুমি তো তোমার বাড়ির বিষয়ে বলো না কিছু, জিগ্যেস করতেও কুন্ঠিত হই, তোমার দাদা তুষারের সঙ্গে মারামারি করেছিলে শুনেছি ।

        আমি করিনি, তুষারই দাদাগিরি ফলিয়ে মেরেছিল আমাকে ; হাংরি আন্দোলনে যোগ দেয়া ও পছন্দ করেনি, বলছিলো এই আন্দোলনের ভবিষ্যত নেই, তার ওপর মামলা-মোকদ্দমা ।

        তোমার চেয়ে দশ বছরের বড়ো, তাই হয়তো । আমার দাদা আমার চেয়ে পাঁচ বছরের বড়ো, কিন্তু আমাদের সম্পর্ক তো বন্ধুত্বের ।

        আপনি বুঝবেন না, আপনাদের কথা আলাদা । আপনাকে বলেছিলাম চাইবাসায় নিয়ে চলুন, নিয়ে গেলেন না, শালপাতায় হাড়িয়া খাওয়া হল না, শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কাছে শুনেছি, হাড়িয়া আর মহুয়ার কথা, টাটকা গরম-গরম মহুয়া । উনিও কবিতা লেখার জন্য নেশা করতেন না, নেশাগ্রস্ত থাকতে ওনার ভালো লাগত।

       ভাবলুম বলি যে তোমার মতনই প্রেমে চোট খেয়েছেন শক্তিদা, কিন্তু বললুম না । তার বদলে বললুম, যাকগে, চলো, দোকান খোলাই রয়েছে, ভিড়ের ভেতর দিয়ে হাত ঢোকাতে হবে । শিক্ষিত চেহারা দেখলে গাঁজা-চরসের দোকানের ভিড়টা আপনা থেকে জায়গা করে দ্যায়, মদের দোকানে কিন্তু করে না । বোদলেয়ার যে কেন মদের পক্ষে আর গাঁজা-চরসের বিরুদ্ধে যুক্তি দিয়েছেন তা এই ব্যাপারটা থেকে স্পষ্ট হয় । আমার সেজমামার শশুরের গনোরিয়া ছিল, উনি ব্যথা উপশমের জন্য আফিম খেতেন । শশুরের জন্য কিনে নিয়ে যেতেন সেজমামা, তখনকার দিনে সরকারি দোকানে যৌনরোগের জন্য চাই বললে, আফিম সহজেই কিনতে পাওয়া যেত ।

         এনাদের থেকে, এই ভিড়ের মানুষদের থেকে আমাদের কোনো পার্থক্য নেই মলয়, দেখতে কি আমি একই রকম নই, চুল আঁচড়াইনি কতদিন, দাড়িও বেড়ে চলেছে, স্নান করা হয়ে ওঠেনি বেশ কয়েক দিন ; আপনি তবু ডেইলি স্নান করেন, কিন্তু দাড়ি বাড়িয়ে চলেছেন, পোশাকেও আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন, এই একটা কর্ডুরয় ফুলপ্যান্ট আছে ?

        এটা নোংরা হয় না, কাচাকাচি করতে হয়না । একটাকার কয়েনটা ওদের কোমরের মাঝখান দিয়ে জানলার ভেতরে ঢুকিয়ে বলো দো পুরিয়া চাটনি ।

        মূর্খকুৎসিতদরিদ্র মানুষ-মানুষীর মিছিলে আমি ভেসে চলে ভুলে যাই সে সময়ে আমি বেটাছেলে না মেয়েছেলে ।

        ঠিকই বলেছ তুমি, এই ভিড়ে ঢুকে বোঝা গেল যে বোদলেয়ার, র‌্যাঁবো, করবিয়ের, লাফোর্গ, আঁতোয়া আর্তোর উদ্দেশ্যময় নেশা করা থেকে সম্পূর্ণ আলাদা আমাদের উদ্দেশ্যহীনতা এই মূর্খ কুৎসিত দরিদ্র লোকগুলোর সঙ্গেই তুলনীয় ; তুমি এলে আমি নেশা করি, করুণা-অনিল এলে নেশা করি, রাজকমল চৌধুরী এলে করি, ফণীশ্বরনাথ রেণু বাড়িতে ডাকলে গিয়ে নেশা করি । নিজে একা-একা গাঁজা-চরসের নেশা করি না ।

        একদিন নিয়ে চলুন না ফণীশ্বরনাথ রেণুর বাড়িতে ।

        হাজিপুরের একজন বিডিও ডেকেছে আমাদের, রাজকমল, রেণুও যাবেন, তুমিও চোলো সঙ্গে, স্টিমারে করে ওপারে, পাকা কলার কাঁদি ঝোলা বাগানে সাহিত্যসভার আয়োজন করেছে বিডিও ।   

        যাবো । বোর হয়ে গেছি এখানে । সুভাষরা পত্রিকা বের করবে বলছে । কবিতা লিখে রেখেছি কিন্তু এখনও চায়নি আমার কাছ থেকে । কেউই আমার কবিতা প্রকাশ করতে চায় না ।

        সুবিমল বসাকের কাছে দিয়ে রাখো কয়েকটা । সুভাষ পত্রিকা বের করছে চিঠিতে জানিয়েছে ত্রিদিব । আমি, দেবী, সুবিমল, ত্রিদিব বাদ যাচ্ছি । দ্যাখো তোমাকে ইনক্লুড করে কি না ।

        সুবিমলবাবুকে দিয়েছি ; বললেন বুলেটিন বেরোনো অনিশ্চিত ।

        হ্যাঁ, আমার মাইনে এখনও আটকে আছে, উকিলের কাছেও বকেয়া রেখেছি ।



         ফালগুনী বললে, গিলে তো নিলাম, ইউফরিয়া আরম্ভ হল না তো ! ফুঁকলে বরং এতক্ষণে শুরু হয়ে যেত । চলুন সবজিবাগের সামনের জাহাজঘাটায় গিয়ে বসা যাক, স্টিমার যাতায়াত দেখব চাতালটায় বসে । এখানে আন্টাঘাটে সবজিঅলাদের বড্ডো কিচাইন । এটা অ্যাফ্রোডিজিয়াক নয়তো ? বোদলেয়ার নাকি অ্যাফ্রোডিজিয়াক হিসাবে গিলতেন ।

        কম বয়স থেকে বেশ্যালয়ে ঢুঁ মারতেন, তারপর জাঁ দুভালকে সামলানো, দরকার পড়ত হয়ত অ্যাফ্রোডিজিয়াক হিসাবে ।

       হাঃ হাঃ, পা দুটো ক্রমশ মাখনের তৈরি মনে হচ্ছে, মাতালের মতন হাঁটছি না তো ? আপনিও লিকুইড হয়ে উঠছেন । চেয়ে দেখুন, চেয়ে দেখুন, ছায়ার খাপে-খাপে শরীর বসছে না ।

       এক্ষুণি উড়ো না, আরেকটু সামলে চলো, এই রাস্তাটার দু-পাশে ভিকিরি । গিন্সবার্গ যখন এসেছিল, এই ভিকিরিগুলোর ফোটো তুলে নিয়ে গেছে ।

        বিট-ফিটদের কথা বাদ দিন, শালারা প্রচুর টাকা কামাচ্ছে কবিতার বই বেচে, পৃথিবী ঘুরছে ; ওনাদের কবিতা ততো ফিল করতে পারি না । আমার ব্যক্তিগত-সত্য কি বিট কবিদের পক্ষে অনুভব করা সম্ভব ? আমার সত্যাবস্হা  আমার নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে, আমি তা নিজে অনুভব করতে পারি, অবিরাম তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছা করে । এক ঘণ্টার বেশি হয়ে গেল এখনও জাহাজঘাটায় পৌঁছোলাম না তো ।

        ঘড়ি তো পরে আসিনি, দাঁড়াও এই লোকটাকে জিগ্যেস করি । ভাইসাব কিতনা বজা হ্যায় ?

        ইগারা বজকে পঁয়তিস মিনট ।

        কেবল পাঁচ মিনিট হয়েছে, মনে হচ্ছিল একঘণ্টা ; কারো ঘড়িতে কটা বেজেছে জেনে কীই বা হবে । সময় জিনিসটা আনরিলায়বল । সেদিন দেখলেন পুড়তে, পুড়েই চলেছে । আপনি আমার হাতটা থরে থাকুন, হাওয়া যা দিচ্ছে, উড়ে না যাই , নাকি পৃথিবী অভিকর্ষহীন হয়ে গেল ।

         তুমি পৃথিবীকে অভিকর্ষহীন করে ফেলেছ । ইউফোরিয়া চাইছিলে !

        ব্যাপারটা কী বলুন তো ? টেম্পল অফ ইনফিনিটি খুলে যাচ্ছে চোখের সামনে । এটাই হ্যালুসিনেশান বুঝেছেন, স্বপ্ন থেকে আলাদা ।

        তোমার তো দেখছি কনশাসনেস দিব্বি রয়েছে । চলো ওখানটায় বসা যাক, স্টিমারযাত্রীদের ভিড় কম ওই জায়গাটায় । লোকগুলোর এতো চেঁচামেচির কী আছে বুঝিনা ।

        হ্যাঁ, আমার কোনো কিছুতেই আর তেমন নেশা হয় না । খালাসিটোলাতে গিয়েও মাতাল হইনি কোনোদিন। আপনার কি এরকম হয়েছে যে কবিতার লাইন চলে আসছে মনের মধ্যে অথচ লিখতে ইচ্ছা করছে না ।

        আমি মনে রাখতে পারি না, যদি কাগজ কলম কাছাকাছি থাকে তাহলে লিখে রাখার চেষ্টা করি ।

        জলে উড়ছি, জলে উড়ছি, মানুষগুলো মাছের মতন সাঁতার কেটে স্টিমারে উঠছে, দেখুন দেখুন । আবার কাশি পাচ্ছে, লেমোনেড খাওয়ান না, হাফ-হাফ ।

       দাঁড়াও, কেশো না, আনছি লেমোনেড, খসখসের গন্ধ থাকে সবুজ লেমোনেডে, কাশি কমাবে তোমার ।

       সুধীন দত্ত বেঁচে থাকলে ওনার বাড়ি যেতাম একবার, শুনেছি এক্কেবারে সাহেব মানুষ ছিলেন, মদ খাবার কেতা ছিল । পাতা ফুঁকে যেতাম কবিতা শোনাতে , ওনার প্রতিক্রিয়া এনজয় করতাম ।

       গলা ধাক্কা খেতে, ওনার অর্ডারলিকে ডেকে বলতেন, থ্রো হিম আউট । আমি বুদ্ধদেব বসুর কবিতা ভবনে গিয়েছিলুম । নাম শুনেই মুখের ওপর দড়াম করে দরোজা বন্ধ করে দিয়েছিলেন । প্রথমটা খারাপ লেগেছিল, তারপর পথে নেমে এই ভেবে আনন্দ হল যে আমার দুর্নাম ওনার কাছে আগেই পৌঁছে গেছে ।

       মানুষ কেন মানুষকে অপছন্দ করে বলুন তো ? আমি তো কাউকে অপছন্দ করি না । সময় যেখানে পুড়ে নষ্ট হয়ে চলেছে, সেখানে কাউকে আঘাত দেবার কোনো মানে হয় না । এই যে সকলের সঙ্গে থাকি, থাকাটুকুই সার । আমাদের নাম নিউজপেপারের নোংরা পৃষ্ঠায় ছাপা হয়, তবু স্বর্গে যাবো, দেখে নেবেন ।


৬   

          সোফার ওপর মেঘে শুয়ে যাকে বলে ‘স্টোনড’ সেই তুরীয় অবস্হায় ফালগুনী, এলএসডিতে ভিজিয়ে শোকানো এক ঘন ইঞ্চের ব্লটিং চিবিয়ে ।

         আমি খাইনি ; ফালগুনীকে লক্ষ্য রাখার জন্য । দুজনে তুরীয় অবস্হায় থাকলে মা এসে দেখবেন আর বিরক্তি প্রকাশ করবেন । ফালগুনীর দিদি অলরেডি এসে কথা শুনিয়ে গেছেন ।

        ওর দিকে তাকিয়ে ভাবি, কিসে আক্রান্ত ফালগুনী ? রবীন্দ্রনাথের বৌঠান, জীবনানন্দ দাশের লাবণ্য, শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের শীলা--- ফালগুনী কি সেভাবেই আক্রান্ত ? ওনারা কবিতায় নিয়ে গেছেন আত্মস্হিতিকে ; ফালগুনী সেইভাবে কবিতায় নিয়ে যেতে চাইছে না, অত্যন্ত গোপন রাখতে চাইছে, শেয়ার করতে চাইছে না আমার সঙ্গে, এমনকী নিজের কবিতার সঙ্গেও ! কেন ? কী বলব ওর আত্মস্হিতিকে ? দৌর্মনস্য ? লুগিয়াউব্রিয়াসনেস ? গোপন ঐকান্তিকতা ? অতৃপ্তি ? উদ্দেশ্যহীনতা ?

          গ্রিক ভাবুকরা মনে করতেন পিত্ত কালো হতে থাকলে দৌর্মনস্য দেখা দেয়, আর তা যদি সারতে বহুদিন লেগে যায় তাহলে বুঝতে হবে কোনো অপদেবতা ভর করেছে । ফালগুনীকে কথাটা বলেছিলুম একদিন । ও বললে, আমি তো চাই ডাকিনী-পিশাচিনী ভর করুক, ক্যাথারসিসের অদৃষ্ট করে তো আসিনি ।

          জ্যোতিষীরা মনে করেন শনির প্রকোপে পিত্তদোষ হয়, এবং তার দরুন দৌর্মনস্য । ফালগুনী বলেছিল একবার, ওর নাকি এখন শনির সাড়ে-সাতি চলছে, যা পারা যায় এই সাড়ে-সাতি পিরিয়ডেই লিখে ফেলতে হবে । অথচ লেখালিখি তো তেমন করছে না । ওয়েটিং ফর গোডোর মতন সদাসর্বদা যেন অপেক্ষা করে আছে, কিসের অপেক্ষা তার অনুসন্ধান করে চলেছে, প্রত্যাদেশের, অনুপ্রাণনার ।

        শুয়ে-থাকা ফালগুনীকে দেখে সুফি সন্তদের কথা মনে এলো । আরবরা ‘হুজুন’ বা ‘হুজ্ন’ বলে একটা শব্দ প্রয়োগ করে, নিজের ভেতরে নিজে প্রবেশ করে যাওয়া ব্যাখ্যা করার জন্য । ইরানের দার্শনিক-ডাক্তার বলেছিলেন ‘হুজ্ন’ হল এমনই এক স্হিতি যখন প্রেমিকার নাম শুনলেই ব্যর্থ প্রেমিকের নাড়ি-স্পন্দন তীব্র হয়ে ওঠে । আমি ফালগুনীর প্রেমিকার নাম জানতুম, কিন্তু এই নিরীক্ষা করে দেখিনি কখনও, কেননা জানতুম না ঠিক কী ধরণের ইনট্রিগ ওকে ছেঁকে ধরেছিল যে এই ক্যাটাসট্রফিক পরিস্হিতিতে ফালগুনী পৌঁছেচে । রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দ, শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের পৃষ্ঠভূমি জানি, অথচ নিকটবন্ধুর ব্যাপারই জানা হয়ে উঠল না । দাঁতে ঈশ্বরকে প্রেমিক কল্পনা করে বলেছিলেন যে, একজন মানুষ যদি হৃদয় দিয়ে, মন দিয়ে, আত্মা দিয়ে ঈশ্বরে সম্পূর্ণভাবে আত্মসমর্পিত না হয়, তা হলে সেই লোকটি এমনই এক গোপনতায় আক্রান্ত হয় যা সে কাউকে বলতে পারে না, সে একাই ওই ভার বইতে বাধ্য হয়  ।

       জার্মান লেখক জিন পল ‘ওয়েলৎশমের্তস’ অভিধাটি কবি-লেখকদের এই বিশ্ববীক্ষার প্রেক্ষিতে তৈরি করেছিলেন : “বাস্তব জগতটি মনের জগতকে সন্তুষ্ট করতে পারছে না” । পাশ্চাত্য সাহিত্যে এই আত্মস্হিতি নিয়ে যাঁরা কাজ করে গেছেন তাঁদের মধ্যে উল্লেখ্য হলেন চার্লস অগাস্টিন, সাঁৎ ব্যভ, শাতুব্রিয়ঁ, আলফ্রেদ দি ভিনি, আলেকজান্ডার পুশকিন, মিখাইল লেরমেনতোভ, ন্যাথানিয়েল হথর্ন, হার্মান হেস, হাইনরিখ হাইনে প্রমুখ ।

        বাংলা সাহিত্যে হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় ( ১৮৩৮ - ১৯০৩ ) এই ভাবনার ওপর ভিত্তি করে ‘চিন্তা-তরঙ্গিনী’ নামে একটি কাব্য লিখেছিলেন ; বাহুল্য বলা যে তখনকার সমালোচকরা ‘চিন্তা-তরঙ্গিণী’ কাব্যের আধুনিকতাকে উপলব্ধি করতে পারেননি । অক্ষয়চন্দ্র সরকার লিখেছিলেন, ‘হেমবাবু কালস্রোতের যেভাগে প্রথম দেখা দেন, সেই ভাগ অতি বিষম ; কালস্রোত তখন কেবলই ভাঙ্গিতে ছিল ; ভাঙ্গিব বলিয়াই ভাঙ্গিতে ছিল, গড়িব বলিয়া ভাঙ্গিতেছিল । হেমবাবুর জন্মসময়ে কোনও কিছু ভাঙ্গিতে পারিলেই কৃতবিদ্য আপনাকে গৌরবান্বিত মনে করিতেন । সমাজ ভাঙ্গিতে হইবে, ধর্ম ভাঙ্গিতে হইবে । এমনকী, অনাচারে অত্যাচারে স্বাস্হ্য ভঙ্গ করিয়া, অকালে কালগ্রাসে ডুবিতে থাকাও যেন সেই সময়ে গৌরবের বিষয় বলিয়া ধারণা হইত । আর এখন হেমবাবুর মৃত্যু সময়ে বোধ হয়, যেন সিকস্তির পর একটু পয়স্তি হইতেছে।’

      পড়ে মনে হবে অক্ষয়চন্দ্র সরকার যেন ফালগুনী রায়ের সমালোচকদের নকল করছেন ।

      আত্মস্হিতির এই অবস্হাটি বৌদ্ধধর্মে বহুকাল আগেই ব্যাখ্যা করা হয়েছিল, যখন বুদ্ধ ‘দুঃখসত্য’-এর কথা বলেছিলেন, যে-সত্যটি  চারটি সত্যের অন্যতম । বৌদ্ধধর্মে অবস্হাটি আশাবাদ বা নিরাশাবাদের নয়, তা বাস্তববাদের ।





        তুমি স্বর্গে চলে গেছো ফালগুনী, ১৯৮১ সালের মে মাসে, সাড়ে তিন দশক আগে ।

        তোমাকে বলেছিলুম গোলঘরের ভেতরে গিয়ে তোমার কবিতাপাঠ শুনব, তোমার কন্ঠস্বর একুশবার প্রতিধ্বনিত হবে, তা আর শোনা হল না, যেদিন আমরা গোলঘরে গিয়েছিলুম সেদিন বন্ধ ছিল, তাই একশো চুয়াল্লিশটা সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে তোমার কবিতা শুনেছিলুম, সম্পূর্ণ নয়, অর্ধেক, কেননা তুমি কাশতে আরম্ভ করেছিলে, আমরা সঙ্গে করে জল বা পিপারমেন্ট লজেন্স নিয়ে যাইনি ।

       তোমাকে বলেছিলুম চাইবাসায় রোরো নদী আর লুপুংগুটু ঝর্ণা দেখাতে, শালপাতায় হাড়িয়া আর মাটির ভাঁড়ে মহুয়া খাওয়াতে নিয়ে যাব ; তা আর হতে পারেনি ।

      এই বাংলা আর দুই বাংলার বহু সংকলন প্রকাশিত হয়েছে । সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, পবিত্র মুখোপাধভায়, শান্তনু দাশ যেমন তোমাকে বাদ দিয়েছেন, তেমনই মণীন্দ্র গুপ্ত । অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত আর দেবীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায় তোমাকে বাদ দিয়েছেন ‘আধুনিক কবিতার ইতিহাস’ আর ‘ষাটের দশকের কবিতা’ সন্দর্ভে । প্রদ্যোত সেনগুপ্ত তাঁর ‘অন্য দিগন্ত : ষাটের কবিতা’ রচনাটিতে । আশিস সান্যাল তাঁর ‘ষাটের কবিতা’ গ্রন্হে । আরও বহু গ্রন্হে,  যার হদিশ রাখিনি আমি, কী-ই বা হবে বলো ।

      তোমার ‘নষ্ট আত্মার টেলিভিসান’, বাসুদেব দাশগুপ্ত প্রথম প্রকাশ করার পর বারবার ছাপা হয়ে চলেছে । অলোক গোস্বামী, শুভঙ্কর দাশ, আলোক সরকার, মনফকিরা, সমীর রায়চৌধুরী পুনর্মুদ্রণ করেছেন, তোমার অপ্রকাশিত কবিতা যেগুলো সুবিমল বসাকের কাছে ছিল অন্তর্ভুক্ত হয়েছে ।

     বইটি ছাপা হবার পরই ফুরিয়ে যাচ্ছে ।

     দুই বাংলায় তোমার পাঠকসংখ্যা অগুণিত ; তোমার সময়ে ইনটারনেট ছিল না । এখন ইনটারনেটে তোমার কবিতা খুঁজলেই পাওয়া যায়, সম্পূর্ণ বইটির কবিতা পাওয়া যায়, তোমার সম্পর্কে প্রবন্ধ-নিবন্ধ পাওয়া যায় ।

     তোমাকে আবার পাঠকদের সামনে আনছেন ‘চন্দ্রগহণ’ পত্রিকা ।

    জানি,  সুফিসন্তদের মতো তুমি আগ্রহহীন ।




।। মুক্তগদ্য ।।


ভ্রমি বিস্ময়ে
সৌরভ বর্ধন

কোন আলোতে প্রাণের প্রদীপ জ্বেলে পাখিরা আমার কাছে আসে, কোন চেতনায় ঘোর লাগিয়ে ফিরে যায় সে! কোন নদীর সে তটভূমি, কোন সে নিবিড় অরণ্যমন তাকে আশ্রয় দেয়, রসদ দেয়, দুর্নিবার কৌতূহলের খোরাক জোগায়! জানি না। আমাদের নেপথ্যে কোন পরাগের মিলন ঘটে কেউ জানে না। কিছু মুহূর্ত শুধু ধরে রাখে কালের ইতিহাস। ভোর ৪টে ৫০এ যখন আজ ঘুম ভেঙে গেলো, কান খুলেই শুনি বাইরে অজস্র পাখির কিচিমিচি। আমাদের বাড়িতে এবং আশেপাশে এমনিতেই নানান রকমের প্রচুর পাখি থাকে, নিত্য তাদের টুইটুই আমি শুনতে অভ্যস্ত, কিন্তু এতো সকালে এতো পাখি একসাথে এমন করছে কেন! ব্যাপারটা দেখতে হচ্ছে! মূত্রথলিতে চাপও বাড়ছিলো, ফলে উঠলাম বিছানা ছেড়ে, ফোনটা হাতে নিয়েও আবার রেখে দিলাম, কারণ ফোন হাতে কাউকে দেখলে আমাদের পাখিরা বিরক্ত হয়; যাইহোক, ছিঁটকিনিটা আস্তে খুলে পেরিয়ে গেলাম ঘর, ঝিমধরা এই মস্ত সকাল পাখপাখালির কলতানে যেন মন্ত্রময়! সাথে ড্রিপড্রিপ করে বৃষ্টি হচ্ছে। এই ঘনীভবনের শব্দ আর পাখিদের টুইটার ---- সে এক পার্থিব শিহরণ। উঠোনময় দাঁড়িয়ে থাকলাম। পাশের বাড়ি থেকে অখিলবুড়ো ক্যাঁচকুঁচ করতে করতে বেরিয়ে গেলো জিরো-ব্যালেন্সের ব্যাঙ্কে লাইন দিতে, এতো ভোরে গিয়েও হয়তো দেখবে এরমধ্যেই আরও জনা ২০ বুড়োবুড়ি লাইন দিয়ে ফেলেছে। আ আ আ করে একটা দাঁড়কাক বাজ-পড়া শুকনো দেবদারু গাছে গিয়ে বসলো, জার্মান লতার ঝোপটা শুকিয়ে গেছে, ওর অবলম্বন অশ্বত্থ গাছটা নতুন কচিপাতা নিয়ে ভোরের আকাশে মেঘ দেখছে, খোবলানো পাঁচিলের ওপর তিনটে ছাতারে লাফাচ্ছে তিনমনে, মা ওদের প্যাঁচাপাখি বলে, পাশের বাড়ির সঙ্গে ঝগড়ায় গতবছর আমাদের যে পুরনো আমগাছটার সবচেয়ে ফলবতী ডালটা কাটতে হলো সেটা সবসময় থাকে শালিখদের দখলে, আর এই তিনরকম পাখিদের নজরে নজরে রেখে খাবার সরানো কাঠবেড়ালীদের প্রধান কাজ, তারাও এই ভোরে সতর্ক ছাদের কার্নিশ থেকে। সংখ্যায় শালিখ ও ছাতারেদের পরই গরিষ্ঠতা পায় বুলবুল বা দোয়েলরা, দিব্যি এই ভোর সমাপনে ওরা হাজির, পায়খানার ছাদে লাফিয়ে বেড়াচ্ছে আর ডাকছে, কী ডাকছে, কার প্রতি এতো মায়া জমে আছে ওদের। বেশিরভাগ পাখিদের এক আশ্চর্য স্বভাব হলো উড়ে বেড়ানো, অথচ কী নির্দ্বিধায় এরা রাত ভোর করে দেয়। আমার জানলার পাশেই যে ছোট কাঁঠালগাছ, লেবুগাছ আর পেয়ারা গাছের ঘরদোর, সেখানেই চড়ুই, টুনটুনি আর আরও ছোটো কী যেন নাম পাখিগুলোর ঠাণ্ডা লড়াই চলে, আজ তাও বন্ধ, অস্থির সমবেতকণ্ঠে ওরা কার মোকাবিলা করছে! যদিও হাঁড়িচাচার ওই এক স্বভাব, কাউকে কিচ্ছু বলবে না শুধু এদিকওদিক মাথা ঘুরিয়ে খেয়াল রাখে সব। মিষ্টি কুল গাছটায় বেনেবৌদের সম্ভবত দুটি পরিবার থাকে, অদ্ভুত এক স্বরে তারা ডাকে, নকল করা যায় না মোটে। যাকে নকল করা যায় সে বিখ্যাত, জগতজোড়া তার খ্যাতি। তাই এতক্ষণে সেগুন গাছের উপর থেকে কোকিল ডেকে উঠলো, এত করুণ সুর আমি আগে কখনও শুনিনি। জাতকের প্রেমের মতো স্নেহরস এই ভোরে বইছে। যে প্রেমের বিন্দু সিক্ত খ্যাপার আবেগ ধরে রাখে অবিকল, সে প্রেমই সফল হয়। এত প্রেমের কথা কেন! প্রেম তো আমাকে উবিয়ে দিয়েছে সেই কবেই! তবুও যে কী হয়, কেন লিখি আবার সকাল হলো, তোমার প্রণয়ে রোদ ওঠে ছলছল, এত রূপ তোমার প্রিয়, আরও প্রিয় শঙ্খিনী শতদল! অথবা, অথবা এমন নূতন ক'রে প্রতিবার হাতে-হাতে ফুল রাখো যদি, আমি হবো কাতর আকাশ তোমার, তুমি হবে অসীম জলধি! আরও আরও আরও কত ডাকাডাকি, কত রকমের ভঙ্গি, কত কত প্রত্যয় আমার চারপাশে কোলাহলময় শোকের মতো ছোটাছুটি করছে, কাউকে চিনছি, কাউকে চিনছি না, অচেনা বিশ্বাসে পা কেঁপে কেঁপে উঠছে, আমি হাত তুলে নিলাম, প্রেমের কবিতা আমি লিখতে চাই না, আমি মুঠোতে পাখি ধরার সুযোগ পেয়েছি, ঘাতিনীর বুকের ঘী খাইতে চাহি না আর। মুঠোতে পাখি ধরার সুযোগ পেয়েছে যে, সে আর স্তন ছুঁতে চাইবে কেন বলো। এক টুকরো রোদ্দুর পড়লে যে জল রুমালের থেকে দূরে সরে যায়, তাকে জয়ের গন্ধ দিলে সে আর ফিরে আসবে কেন। এইসব আট-ছয় ভাবতে ভাবতে পাখিদের গূঢ়বাক্য শ্রবণসুখ পেরিয়ে যায়। কেন দাঁড়িয়ে ছিলাম, কী শুনছিলাম, কোথায় কখন কীভাবে কিছুই ঠাহর হয় না, কখন ঘরে এসে গেছি, পাখা অফ্ করে শুয়ে পড়েছি আবার, জোরকদমে বৃষ্টি আর হাওয়া শুরু হয়েছে, তীব্র ঘুমে আমি সমাজ ও মানুষের মতো শুকিয়ে ফেলেছি চোখ, আমি কিচ্ছু দেখি না আর। এতো তীব্র হাওয়া বইছে আজ সারাটা দিন, এতো তীব্র আকুতি এই পরিবেশে, যেন উত্তরণ নেই। দৃঢ় চকচকে গীতের ভেতর ঠাণ্ডাচোখ লাল মেলে রয়েছে, যতটা মুঠো তুলে ধরলে এই দাঁড়িয়ে থাকা লজ্জার, ততটা অনন্তখাদ আমি দাঁড়াতে পারি না। তবুও পাখিরা ডেকে যায়, কেবলই ডেকে যায় আমার ঘোরের ভেতর, না লিখতে পারার বেদনার ভেতর কুড়ে কুড়ে খায় কুহুরব। আজ ভোরবেলা দরকার ছিল বাড়ির পেছন দিকটা যাওয়ার, গেলে দেখতে পেতাম প্রাকৃত ঝোপের তল দিয়ে দিয়ে সন্তর্পণে হেঁটে চলেছে তিতিরপাখি অথবা জলপিপি এসে দাঁড়িয়ে আছে শুকনো ডোবার ধারে। যেমন, হৃদয়ের দ্বার ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকে শরীর, সুদীর্ঘ প্রতীক্ষার পর বহিঃস্থ রেখারা সচল হয়, তাদের তুমি জীবন বলে ডাকতে পারো অথবা না।     





।। গল্প ।।


3 সিক্রেটস
প্রতাপ বোস

 “কি রে কিছুই তো দেখে গেলি না। সবই কি বানিয়ে লিখবি?”

‘অত চাপ নিয়ো না বাবা। সব ঠিক হয়ে যাবে।‘
“কিছু  Essay তো দেখে যেতে পারতিস। কাছাকাছির মধ্যে টপিকটা আসলে তোর লিখতে সুবিধা হতো।“
‘কিছু Essay দেখেছি। সেরকম টপিক আসলে ভালো। না হলেও কোনও চাপ নেই। স্টোরি রাইটিং অপশন আছে তো।‘
“স্টোরি! “ আমি হায় হায় করে উঠলাম। ছোট্টু যদি স্টোরি লেখে, তাও আবার পরীক্ষার খাতায়, তাহলে সেই গল্পের গরু যে ঘাস ছেড়ে পরীক্ষকের মাথা চিবিয়ে খাবে, সে নিয়ে আমি নিশ্চিত। কিন্তু ছোট্টুর আজকের ইংলিশ ল্যাঙ্গুয়েজ পরীক্ষা নিয়ে নিশ্চিত বা হতে পারছি কোথায়।
আমার পাশে ছোট্টু বসে। যশোর রোড ধরে ড্রাইভ করছি। অফিস টাইম বলে রাস্তায় ট্রাফিকের বেশ চাপ। তবু একহাত স্টিয়ারিং এ। আর এক হাত ছোট্টুর কাঁধে বরাভয়ের মতো রেখেছি। ICSE পরীক্ষা। এই প্রথম বোর্ডের এক্সাম দিচ্ছে আমার ছোট ছেলে। এতোদিন স্কুলের টিচাররা ক্ষমা ঘেন্না করে ব্যাপারটা ম্যানেজ করে দিয়েছে। কিন্তু  এবার তো বাইরের টিচার। কি যে হবে ভাবতে ভাবতে মনে পড়ে গেল ওদের ছোটবেলার কথা। আবার ধরলাম ছোট্টুকে।
“গল্প লেখা তো বেশ শক্ত রে। যে থিমের উপর লিখতে হবে সেই থিমটাকে আগে বুঝতে হবে। তারপর সেই থিমটা অনুযায়ী ঘটনা, চরিত্র সব ভাবতে হবে। তারপর আস্তে আস্তে ঘটনার সুতো ছাড়তে ছাড়তে ক্লাইম্যাক্সে পৌঁছাতে হবে। তারপর...”
‘ও নিয়ে তুমি ভেবো না। ওসব আমি অনেক লিখেছি আগের পরীক্ষা গুলোই।‘ ছোট্টু আমাকে থামিয়ে দিয়ে বলে ওঠে।
“আরে তোকে তো আমি চিনি। গল্প কপি করতে তুই ওস্তাদ। কিন্তু নতুন জিনিস বানানো...”
আবার আমাকে থামিয়ে দিয়ে হো হো করে হেসে ওঠে ছোট্টু।
“হাসিস না ছোট্টু। ছোটবেলায় তোদের দুজনকে নিয়ে যখন গল্প গল্প খেলতাম তখন তোর দাদা খুব রেগে যেতো তোর উপর। কারণ দাদা বানিয়ে যে গল্পই বলুক না কেন তুই নতুন কিছু দিয়ে শুরু করে ঠিক দাদার গল্পে ঢুকে পড়তিস।  ওই সেই গরুর রচনার মতো। শ্মশানের রচনায়ও তুই গরুকে শ্মশানের ভিতরে ঢুকিয়ে ঘাস খাওয়াতিস।“
‘আরে বাবা। তুমি এত চিন্তা করছো কেন? এখানে তো আর দাদা নেই। যা করার আমি একাই করবো।‘ আমাকে আশ্বস্ত করার ঢঙে বললো ছোট্টু।
ভাবতে ভাবতে খেয়ালই করিনি কখন ওদের স্কুলে পৌঁছে গেছি। ছোট্টুকে নামিয়ে দিয়ে আমি চলে আসলাম। তারপর জীবনের প্রাত্যহিক ব্যস্ততায় দু তিন ঘন্টা হু হু করে কেটে গেল। পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর ছোট্টুকে আবার রিসিভ করে বাড়ি ফিরছি। একটু চুপচাপই ছিলাম। পরীক্ষা কেমন হয়েছে জিজ্ঞেস করছি না দেখে ছোট্টু নিজেই শুরু করলো।
‘তুমি কি এখনো চাপে আছো?’
“না না চাপের কি আছে। যা হওয়ার তো হয়েই গেছে। একবার পরীক্ষা হয়ে গেলে আমি আর চাপের মধ্যে থাকি না। তোকে তো সে কথা আগেই বলেছি।“
মুখে বললে কি হবে। আমি যে ওর বডি ল্যাঙ্গুয়েজ দেখে ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করছি সেটা ছোট্টু বিলক্ষণ বুঝতে পেরেছে। তাই আবার মুখ খুললো ও।
- ‘সে তুমি মুখে যাই বলো, তোমার চাপ কাটানোর জন্যই বলছি, পরীক্ষা কিন্তু আমি ভালোই দিয়েছি।‘
“হুমম। ভালো হলেই ভালো। তবে ভালো কি খারাপ সেটা Essay টা কেমন লিখেছিস সেটা দেখলেই বোঝা যাবে।“
- ‘আমি তো সেই জন্যই বলছি পরীক্ষা আমার বেশ ভালোই হয়েছে।‘
এবার আমার অবাক হবার পালা। ছোট্টু Essay টা ভালো লিখেছে বলাই আমি একটু নড়েচড়ে বসলাম।
“তো কি Essay লিখলি?”
ছোট্টুর মুখে দুষ্টু মিষ্টি হাসি খেলে গেল। আমার দিকে একবার তাকিয়েই আকাশের দিকে গভীর মনোযোগে কি যেন দেখতে লাগলো। আমি যে একটা প্রশ্ন করেছি তার বিন্দুমাত্র প্রভাব তার উপর নেই। বুঝলাম বাবার কৌতুহলের পরীক্ষা নিচ্ছে তার ছোট ছেলে।
তাই ছদ্ম রাগে আদর করে ছোট্টুর জুলপি টা ধরে টানতেই হাসতে হাসতে ও বললো
‘Essay নয় বাবা, Essay নয়।‘
“তাহলে?”
‘স্টোরি লিখলাম।‘
“স্টোরি! ?”  আঁতকে উঠলাম আমি।
‘হ্যা বাবা স্টোরি। ‘
যে আশঙ্কাটা করছিলাম সেটাই সত্যি হয়েছে দেখছি। আর ভেবে লাভ নেই। হাল প্রায় ছেড়েই  দিয়েছিলাম কিন্তু এয়ারপোর্টের সিগন্যালে অনেকক্ষণ অপেক্ষা করতে হচ্ছে দেখে স্ট্যান্ডটা চেঞ্জ করলাম।
“আচ্ছা বেশ বেশ। গল্প যখন লিখেই এসেছিস তো শুনি সে গল্পের কাহিনী। কি ছিল গল্পের থিম?”
‘গল্পের থিম ছিল “ দ্য সিক্রেট “।‘
“ওকে। কাহিনীর স্থান, কাল, পাত্র?”
‘এই সময়েরই গল্প। তবে প্লেসটা হলো বার্সেলোনার আউট স্কার্ট। আর মেইন ক্যারেকটার হলো অ্যারোন ও গ্যারুন।‘
বার্সেলোনা!! অ্যারোন! গ্যারুন! আমি আঁতকে উঠলাম। বলে কি ছোকরা। কোলকাতা থেকে একেবারে ক্যাটালোনিয়া! বাংলা বাদ দিয়ে একেবারে স্পেন! বেশ বুঝতে পারছি ছোট্টু কিছু একটা ঘোঁট নিশ্চয়ই পাকিয়েছে। এমনিতে আমার ছোট ছেলে ফুটবল পাগল। নেমারের একেবারে ডাই হার্ড ফ্যান। নেমার আগে বার্সেলোনা তে খেলতো। মেসির পাশে। এখন পিএসজি, ফ্রান্সে খেলে। মেসি আবার চাইছে ওকে বার্সেলোনা তে নিয়ে আসতে। কিন্তু তাই বলে ছোট্টু পরীক্ষার খাতায় একেবারে লোকেশন বার্সেলোনা করে দিলো! তার উপর আবার ওই সব ইনটারন্যাশানাল নাম- অ্যারোন, গ্যারুন। মাথাটা জট পাকিয়ে যাচ্ছে। গাড়িটা একি স্পিডে চললেও মনের ভুলে বেশ কয়েকবার গিয়ার চেঞ্জ করে ফেললাম।
‘ওহো। তুমি আগে শুনেই দেখো না।‘ ছোট্টু আমার মনের অবস্থা আন্দাজ করে হালকা একটা টোকায় বলটা বাড়ালো।
“বেশ বেশ। বলতে থাক।“ আমি কৌতুহলী হয়ে বলটা আবার ব্যাক পাস করলাম। বেশ বুঝতে পারছি গোলটা আমি খাবোই।
ছোট্টু গল্পের গাড়ি চালিয়ে দিলো –
‘ অ্যারোনের খুব রাগ তার বাবা মায়ের উপর।
বছর দুয়েক আগে যখন গ্রান্ডপা মারা গেলেন তখন কিছুতেই বাবা মা তাকে গ্রান্ডপা কে শেষ দেখার জন্য বার্সেলোনার আউট স্কার্টে গ্রান্ডপার বিশাল খামারবাড়িতে নিয়ে গেলেন না। কারণ তখন অ্যারোনের টেনথ্ স্ট্যান্ডার্ডের বোর্ড এক্সাম চলছিল। সেই কবে ছোটবেলায় অ্যারোনের যখন চার পাঁচ বছর বয়স তখন ও গ্রান্ডপার কাছে গেছিল।খুব ভালোবাসতো গ্রান্ডপা ওকে। আদর করে ওকে একটা পুতুল দিয়েছিল ওর সাথে সবসময় খেলার জন্য। পুতুলটার নাম গ্যারুন। খুব ভাব হয়েছিল গ্যারুনের সাথে। গ্যারুনের মধ্যে কিছু একটা ছিল যেটা ওকে ম্যাগনেটের মতো টানতো। কিন্তু সেটা যে কি সেটা ও এখনো বুঝতে পারেনি। তাই এবার টুয়েলভথ্ স্ট্যান্ডার্ডের  বোর্ড এক্সাম শেষ হতেই ও দাবি করলো যে এবার ও একাই গ্রান্ডপার খামারবাড়িতে যাবে।‘
“ এই দাঁড়া দাঁড়া। তুই তো এবার ICSE  দিচ্ছিস। তা হঠাৎ নিজের বয়সী কাউকে না বেছে দুবছরের বড়ো দাদার বয়সী কাউকে বাছলি কেন?” গল্প লেখার সময় ছোট্টুর মনে ঠিক কি চলছিল তা বোঝার জন্য ওকে একটু থামালাম।
ছোট্টু কিঞ্চিৎ বিরক্ত হয়ে উত্তর দিলো –
‘ ওহো বাবা। বোঝার চেষ্টা করো। ১৮+ না হলে একা একা অ্যারোন কে বাড়ির বাইরে থাকার অনুমতি দিতো না ওঁর বাবা মা।‘
হুমম্। ছেলে বার্সেলোনার প্রেক্ষপটে লিখলে কি হবে ভিতরে বাঙালি ঐতিহ্য কাজ করছে। আবার গল্পের প্রয়োজনে বয়সটা বাড়িয়ে ১৮+ করে নিয়েছে যাতে সোশ্যালি অ্যাকস্পেটবল হয়!
“ বাঃ। সবদিকে নজর রেখেছিস তো!” আমি একটু পিঠ চাপড়ানি দিতেই ছোট্টু আবার গড় গড় করে বলতে শুরু করলো।
‘ অ্যারোন একাই যেতে চাই খামারবাড়িতে। কারণ খামারবাড়িতে এখন কেয়ারটেকার ছাড়া কেউ থাকে না। অতো বড়ো খামারবাড়ি এখন কিছুটা ঘোস্ট হাউসের চেহারা নিয়েছে। তাই পুরো থ্রিলটা পেতে গেলে ওকে একাই যেতে হবে ওখানে। তাছাড়া আরও একটা আকর্ষণ হলো গ্যারুন। সেই পুতুলটা। গ্রান্ডপা লাতিন আমেরিকা থেকে এনেছিল ওকে। যে সবসময় অ্যারোনের সাথে থাকতো, ওর চার পাঁচ বছর বয়সে খামার বাড়ি থাকার সময়। গ্রান্ডপা প্রথমে ওকে পুতুলটা দিতে চান নি কেন কি এক অজ্ঞাত কারণে।  কিন্তু যখন দেখলেন যে তাঁর আদরের নাতি খুব বোর হচ্ছে তখন দিয়ে দেন গ্যারুন কে ওর কাছে।‘ এই অবধি বলে ছোট্টু একটু জল চেয়ে নিয়ে খেলো।
“ তারপর?” আমি আমার কৌতুহলটা না চেপে আলতো করে ভাসিয়ে দিলাম।
‘ তারপর অ্যারোনের সর্বক্ষণের সঙ্গী হয়ে উঠলো গ্যারুন। খামারে ছোটাছুটি খেলার সময় গ্যারুন কে একটা বেঞ্চে বসিয়ে দিতো অ্যারোন। তারপর চকিতে একটা গোলাপ ফুলের বাগানের চারিদিকে চরকি পাক দিয়ে এসে কোমরে দুহাত দিয়ে দাঁড়িয়ে গ্যারুনকে বলতো- দেখলে আমি কেমন জোরে ছুটতে পারি! হাওয়ার চেয়েও জোরে। বলেই হা হা করে দুলে দুলে হেসে উঠতো অ্যারোন। সেই হাসি হাওয়ায় ভর দিয়ে গাছের পাতায় পাতায়, ঘাসের ডগায় ডগায় ছুঁয়ে খামার বাড়িটার চারপাশে ঘুরপাক খেয়ে আবার চলে আসতো ওদের কাছে। সেই হাওয়ায় গ্যারুনও যেন একটু দুলে উঠতো।
কখনো আন মনে গান গেয়ে উঠতো অ্যারোন। কান্ট্রি সং। ওর গ্রান্ডপা শিখিয়েছিল। ভারী মজাদার সেই গান। গাছের পাখিরাও চুপটি করে শুনতো সেই গান। তারপরে গান শেষ হলেই কিচিরমিচির করে আনন্দে উড়ে এক ডাল থেকে আর এক ডালে বসতো। রঙ বেরঙের প্রজাপতি গুলোও চলে আসতো গান শুনতে। গ্যারুনের হাতে বসে এমনভাবে পাখা দোলাতো যে মনে হতো গ্যারুনের হাতটা কাঁপছে। চোখ দুটো মনে হতো খুশীতে হাসছে। অদ্ভুত একটা আনন্দ হতো অ্যারোনের গ্যারুনের এই খুশি খুশি ভাবটা দেখে। মন খুলে গল্প বলতো ওর সাথে। কতো কি গল্প। যা যা গ্রান্ডপা ওকে শুনিয়েছে সব ও শোনাতো গ্যারুনকে। গ্যারুন সব শুনতো। পড়ন্ত বেলার সূর্যের রংবাহারি আলোর সাথে সাথে গ্যারুনেরও যেন মুখের রঙ চেঞ্জ হয়ে যেতো।  ও যেন সব বুঝতো গল্পের কথা।
রাতে ঘুমানোর সময়ও ও আর গ্যারুন একসাথে ঘুমাতো। পাশাপাশি বালিশ। ও গ্যারুনকে জড়িয়ে ধরে শুতো। কতো রাতে অ্যারোনের মনে হয়েছে যে গ্যারুনও ওকে জড়িয়ে ধরে আছে। মাঝরাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে গেলে ও উঠে দেখতো গ্যারুন ওর দিকে পাশ ফিরে শুয়ে আছে।
এমন সব মনে হতো অ্যারোনের তখন ছোটবেলায়। এখন অবশ্য ভাবলে হাসিই পাই ওর। কিন্তু শেষ দিনের অভিজ্ঞতাটা! সেটা ভুলবে কি করে অ্যারোন। সেটা যে আজও ও ওর মনের গভীর কোনে লুকিয়ে রেখেছে। কাউকে বলেনি। আজ আবার মনে পড়লো।
ছুটির দিনগুলো ফুরিয়ে আসছিলো দ্রুত। খামারবাড়ি থেকে সামার ভ্যাকেশন কাটিয়ে ফিরতে হবে এবার বার্সেলোনার নিজেদের বাড়িতে। বাবা মা বারবার তাগাদা দিচ্ছে। গ্রান্ডপাও চাইছে এবার অ্যারোন ফিরে যাক। শুধু গ্যারুন কিছুতেই যেন ছাড়তে চাইছে না। ও যেন যেন মনে মনে বলছে যেয়ো না অ্যারোন। যেয়ো না। তুমি চলে গেলে আমি...। শেষটা যে কি বলতে চেয়েছিল গ্যারুন এতো বড় হয়েও বুঝতে পারেনি অ্যারোন। শুধু ফিরে আসার সময় ও গ্যারুনকে সাথে নিয়ে যাওয়ার বায়না করাই গ্রান্ডপা ভীষণ রেগে গেছিলেন। এক ঝটকায় গ্যারুনকে ওর কোল থেকে কেড়ে নিয়ে জলন্ত দৃষ্টিতে তাকিয়েছিলেন ওর দিকে। আর ও স্পষ্ট দেখেছিল গ্যারুনের চোখটা চিকচিক করে উঠেছিল কান্নায়।
আজ সেই দিন। অ্যারোন আজ গ্রান্ডপার খামারবাড়িতে যাচ্ছে। ওকে আজ খুঁজে  বের করতেই হবে গ্যারুনকে। খুঁজে বের করবেই গ্রান্ডপার ওরকম আচরণের রহস্য।‘
আবার একবার বোতল থেকে জল খেলো ছোট্টু। গল্পের আবহে আমিও কেমন বমকে গেছি। এটা ছোট্টু লিখেছে? মৌলিক? একটা সন্দেহের তিরতিরে হাওয়া আনন্দটাকে ঠিক খেলতে দিচ্ছে না। তবু ছোট্টুকে বাহবায় দিলাম-
“বাঃ। সুন্দর হচ্ছে।  তারপর?”
ছোট্টু আবার বলে চললো-
‘খুব তাড়াতাড়িই পৌঁছে গেল অ্যারোন খামারবাড়িতে। কেয়ারটেকার থাকলেও অযত্নে কেমন একটা বিবর্ণ গা ছমছমে ভৌতিক পরিবেশ তৈরি হয়েছে সারা বাড়িটা জুড়ে। সেই গোলাপের বাগান, সেই গাছগুলো, সেই সবুজ ঘাস, সেই কালারফুল প্রজাপতিগুলো সব একই আছে। শুধু কি যেন একটা নেই। নেই,  নেই,  নেই। সেই ছুটে বেড়ানো ছোট্ট তুমিটাই তো নেই অ্যারোনদাদা। পাখিগুলো উড়তে উড়তে যেন বলে গেল। আর একজনও তো নেই।  ভাবলো অ্যারোন। তার প্রাণের বন্ধু গ্যারুনও তো নেই। ভাবতে ভাবতে মনটা ভার হয়ে গেল অ্যারোনের। তাই একটু খামার বাড়ির বাইরে বেড়িয়ে ছোটবেলার অন্য বন্ধুদের সাথে দেখা করে আসলো অ্যারোন। গল্পে মজায় কোথা থেকে যেন সকাল পেরিয়ে দুপুরে পৌঁছে গেল সময়। খুব খিদে পেয়েছিল অ্যারোনের। তাড়াতাড়ি ফিরে এসে কেয়ারটেকার আঙ্কেলের বানানো পাস্তা, জ্যামন সের্রানো, ইবেরিয়ান হালিবুট আর স্যালাড সহ টর্টেলো স্প্যানোলা ভাজা খাওয়ার পর চোখটা আর খুলে রাখতে পারেনি।
যখন ঘুম ভাঙলো তখন সন্ধ্যা হয়ে গেছে। চারিদিকটা নিঃঝুম। কেয়ারটেকার আঙ্কেল বিভিন্ন জায়গায় একটা করে বড় বড় মোমবাতি জ্বালিয়ে গেছেন। মোমবাতির স্বল্প আলোতে চারিদিকটায় কেমন একটা আবছায়া তৈরি হয়েছে। বাইরের একটানা ঝিঁঝির আওয়াজকে থামিয়ে দিয়ে মাঝে মাঝে একটা দমকা বাতাস কুঠিবাড়িটার কোনে কোনে ঘুরপাক খেয়ে একটা অদ্ভুত ফিসফিসানির আওয়াজ তুলে হারিয়ে যাচ্ছে।
বিছানা ছেড়ে উঠে পড়লো অ্যারোন। একটু কি গা ছমছম করছে এতো বড় বাড়িটায় একা থাকার জন্য। এমনটাই তো চেয়েছিল অ্যারোন। থ্রিলটা উপভোগ করতে চেয়েছিল। একটা মোমবাতি হাতে নিয়ে বারান্দায় বেরোতেই একটা দমকা হাওয়া এসে হাতের মোমবাতিটাকে নিভিয়ে দিলো। চারিদিক টা এতো অন্ধকার লাগছে কেন। অ্যারোন কি করবে বুঝতে না পেরে চেঁচিয়ে আঙ্কলকে ডাকতে যাবে ঠিক সেই মুহূর্তে সিঁড়ির দিকে একটা মোমবাতি যেন জ্বলে উঠলো। অদ্ভুত।  ওখানে তো কোন মোমবাতি জ্বলছিল না। তাহলে? ভয়ের একটা ঠান্ডা স্রোত শিরদাঁড়া দিয়ে নামতে থাকলো অ্যারোনের। তবু একটা অদম্য কৌতুহল অ্যারোনকে ঠেলে নিয়ে গেল সিঁড়িটার দিকে। সিঁড়ি টা গোল হয়ে ঘুরতে ঘুরতে একটা অংশ দোতালার দিকে চলে গেছে। আর একটা অংশ অল্প নীচে নেমে হঠাৎ ধাক্কা খেয়ে একটা দরজার সামনে থমকে দাঁড়িয়ে গেছে। কি করবে মনঃস্থির করার আগেই অ্যারোন চমকে উঠে দেখলো সিঁড়ির নীচের অংশে দরজাটা দড়াম করে খুলে গিয়ে আর একটা মোমবাতি ওখানে জ্বলে উঠলো।  মন্ত্রমুগ্ধের মতো ওদিকে এগিয়ে চললো অ্যারোন। দরজাটা ক্রশ করার পরই সিঁড়িটা আবার ঘুরে ঘুরে নীচে নামতে শুরু করেছে। একটা করে বাঁক আসছে আর একটা করে মোমবাতি জ্বলে উঠছে। বেশ কিছুটা নামার পর বাইরের ঝিঁঝির আওয়াজটা থেমে গিয়ে অদ্ভুত একটা নিস্তব্ধতা। তারপরে যেটা হলো সেটার জন্য প্রস্তুত ছিল না অ্যারোন। একটা স্পষ্ট পায়ের আওয়াজ। ছোট বাচ্চাদের হাটার মতো। সিঁড়ি দিয়ে নীচে নামছে। আর চুম্বকের মতো টানছে অ্যারোনকে। প্রতি বাঁকে মোমবাতিরাও জ্বলতে থাকছে। দেখতে দেখতে অ্যারোন একটা অন্ধকার কুঠুরির মধ্যে উপস্থিত হলো। এমন ঘর তো আগে কখনো দেখেনি অ্যারোন। এটা কি তবে গ্রান্ডপার গুপ্তকক্ষ। পায়ের শব্দটাও তো আর পাওয়া যাচ্ছে না। তবে কি সে এখানেই আছে। আশেপাশে। একটা বাতাস যেন খিলখিল করে হেসে উঠলো ওর চারপাশে। চেঁচিয়ে উঠতে গিয়ে অ্যারোন দেখলো শুকিয়ে ওর গলা কাঠ হয়ে গেছে। আর তারপরেই একটা ভারী পায়ের শব্দ ধুপধাপ করে এগিয়ে আসতে লাগলো। ছোট পায়ের শব্দটাও আবার শোনা যাচ্ছে। ত্রস্ত পায়ে সেটা যেন কোথায় মিলিয়ে যাচ্ছে। তারপরেই একটা বাক্স বন্ধ হওয়ার শব্দ।  তারপর সব চুপচাপ। শুধু বুকের ধুকপুকানি আওয়াজটা তীব্র হয়ে নিস্তব্ধতাকে খান খান করে দিচ্ছে। ভারী পায়ের শব্দটাও আর শোনা যাচ্ছে না। অন্ধকারটা আরও ভারী হয়ে  আসল চারিদিক থেকে । যেন গলা চেপে ধরতে চাইলো অ্যারোনকে। অ্যারোনের পা দুটো কে যেন শক্ত করে বেঁধে দিয়েছে । একটুও নড়তে পারছে না। ভয়ে চেঁচিয়ে উঠতে যাচ্ছিল অ্যারোন। এমন সময় হঠাৎ  করে আর একটা মোমবাতি জ্বলে উঠলো ঘরের মধ্যে।  অল্প আবছায়া তৈরি হলো ঘরটার মধ্যে। অল্প পরিসরের একটা পুরনো বাঙ্কার। তারমধ্যে একটা স্বর্ণখচিত বেশ কারুকাজ করা ছোট কফিনের মতো দেখতে একটা বাক্স। আর তার উপরই জ্বলছে মোমবাতিটা। কে যেন চুম্বকের মতো টেনে নিয়ে গেল অ্যারোনকে ওই বাক্সটার কাছে। বাক্সটার গায়ে হাত দিতেই একটা শতাব্দী প্রাচীন ঠান্ডার স্রোত হাত বেয়ে সারা শরীরে ছড়িয়ে গেল। মুহূর্তে  হাতটাকে টেনে সরিয়ে নিতে চাইলো অ্যারোন। কিন্তু কে যেন জোর করে টেনে ধরেছে হাতটা। তারপর ওর হাতটা দিয়ে মোমবাতিটা সরিয়ে কে যেন বাক্সটা খুলে ফেললো এক ঝটকায়।  বাক্সটা খুলতেই যা দেখলো অ্যারোন তাকে অবিশ্বাস্য বললে কম বলা হয়। একটা হাফ ডিকম্পোসড বডি শুয়ে আছে বাক্সের ভিতর যে অ্যারোনের খুব খুব চেনা। সে আর কেউ নয় গ্যারুন। এমন সময় মোমবাতি টা এক দমকা হাওয়ায় নিভে গেল। দড়াম করে বন্ধ হয়ে গেল বাক্সের দরজা। আর একটা দমবন্ধ করা ভারী বুড়ো মানুষের গায়ের গন্ধ ক্রমশ এগিয়ে আসতে থাকলো অ্যারোনের দিকে।‘

গল্প শেষ। শুনতে শুনতে কখন বাড়ি চলে এসেছি বুঝতেই পারিনি। ছোট্টুর দাদা সব শুনে বললো –
‘ উফফ্ বাবা! ভাই আবার গোল দিয়ে দিলো।‘
“ কেন রে? কি হয়েছে?”
‘ আর কি। কিছু দিন আগে আমি আমাদের ক্লাস টুয়েলভ এর সিলেবাসে সত্যজিত রায়ের The Fritz নামে যে শর্ট স্টোরি টা আছে সেটা পড়ছিলাম। ছোট্টু পাশে বসে শুনছিল....’
সত্যজিত রায়ের সেই শর্ট স্টোরির স্থান রাজস্থানের বুন্দি গ্রামে। মুখ্য চরিত্র জয়ন্ত ও তার বন্ধু শঙ্কর। আর জয়ন্তর ছোটবেলার সুইস পুতুল Fritz। সেই গল্পটাকে অনুসরণ করে, গ্রান্ডপার মতো একজন রহস্যময় চরিত্রের আমদানি করে, শেষ পর্বটা সম্পূর্ণ  নতুনভাবে তৈরী করে, তদুপরি নিজের মতো একেবারে বার্সেলোনায় ফেলে গল্পটা প্রায় পুরোটা চেঞ্জ করে ছোট্টু আমাকে একবারে তাক লাগিয়ে চলে গেল। লাঞ্চে যাওয়ার আগে চোখ নাচিয়ে বলে গেল –
‘কি! গোল দিলো তো বার্সেলোনা!




উপহার
শ্রাবণী গুপ্ত সরকার

সকাল থেকেই মা খুব ব্যস্ত আজকে। মা যে কারখানায় কাজ করেন, সেখানে কি যেন একটা আছে। তাই মিনির একটু ভয়ই করছিল বলতে। তারপর যা থাকে কপালে ভেবে বলেই ফেলল। যদিও এই সময় মা কথায় কথায় রেগে যান তাও। আসলে পরশু সোনালীর জন্মদিনে নেমতন্ন আছে তো, যেতেই হবে সেখানে। ওর প্রিয় বন্ধু বলে কথা। কিন্তু মাসের শেষে কি যে উপহার দেওয়া যায়। বাবার শরীর খারাপ হওয়ার পর মায়ের উপর বড্ড চাপ। সব বোঝে মিনি। কিন্তু ও আজ নিরুপায়। সোনালীরা রীতিমতো ধনী, কি উপহার নিয়ে যাবে ও?

ঘামে ভেজা মুখটা একটু কালচে দেখাচ্ছে মায়ের। খুব মায়া হচ্ছে মিনির। কিন্তু আজ ও নিরুপায়। মায়ের সঙ্গে আলোচনা না করলেই নয়। নাঃ! মা রাগ করলেন না তো। একটু হেসে ওর দিকে তাকিয়ে বললেন, “যা আলমারীর নীচের তাকটা দেখ তো একবার”।

সোনালীর জন্মদিনের পার্টিতে ঝকমকে সাজগোজের পাশে ফিকে বেগুনী ফ্রক পরে সাধ্যমতো সেজে এসেছে মিনি। একটু জড়োসড়ো লাগছিল নিজেকে। কিন্তু জড়তা কেটে গেল ওর দেওয়া ছোট্ট উপহারের প্যাকেট খুলেই সোনালী যখন ওকে দুহাতে জড়িয়ে ধরলো। বললো, “এটাই সেরা উপহার রে মিনি”। মায়ের হাতের চমৎকার এম্ব্রয়ডারীতে জ্বলজ্বল করছে নিতান্ত সাধারণ কাপড়ে তৈরী হেয়ার ব্যান্ডটা। কাকতালীয়ভাবে সেটা ম্যাচও করে গেছে সাদা ধপধপে বার্থডে গার্লের পোশাকের সঙ্গে।

কারখানার কাজের চাপ আর আকস্মিক অর্থনৈতিক চাপ মায়ের অনবদ্য এই গুণে মোটেই আঁচড় কাটতে পারেনি, তাই তো ওর আনা সামান্য উপহার এমন অসামান্য মাত্রায় পৌঁছে গেছে। আজ সোনালীর মুখের হাসিতে মনটা ভরে গেল মিনির। বাড়ী ফিরে মাকে অনেক আদর করবে ও।




ঘুণ পোকা 
আবদুস সাত্তার বিশ্বাস

                                এক

        আরাবুল তার বাড়ি থেকে বেরিয়ে তাকালেই  একটি মাঠ দেখতে পায়।বিরাট একটি মাঠ। পাম্পের মাঠ।পাম্পের জলে এই মাঠের সমস্ত জমি চাষ হয়।গ্রামের মানুষ মাঠটিকে তাই 'পাম্পের মাঠ' বলে।অন‍্য মাঠের তুলনায় এই মাঠে ফসল খুব ভালো হয়।ওইজন্য এই মাঠে জমির দাম খুব বেশি।এই মাঠেই আরাবুলের দশ বিঘা জমি রয়েছে।দশ বিঘা জমি।ডাকলে পরে কথা বলে যে জমি।বিকালে রোদ কমে যাওয়ার পর আরাবুল তাই একবার মাঠে নামবে ভাবল।জমি দেখতে মাঠে নামবে।

                                 দুই

       আরাবুল এখন গ্রামে থাকে না।শহরে থাকে। শহরে তার শ্বশুরবাড়ি থাকে।তা থাকলেও গ্রামে তার সমস্ত বিষয় সম্পত্তি রয়েছে।ঘর বাড়ি ও পুকুর,বাগান থেকে শুরু করে মাঠান জমি।গ্রামেই সব কিছু রয়েছে।গ্রাম থেকে সে কিছুই নিয়ে যায়নি শহরে।তার এক বন্ধু নূরুল দেখাশোনা করে।শহরে যাওয়ার সময় আরাবুল তাকে দেখাশোনার ভার দিয়ে গেছে বলে দেখাশোনা করে।তবে বছরে আরাবুল একবার করে গ্রামে আসে।এই জৈষ্ঠ মাসে।আম,কাঁঠাল পাকার সময়।সপরিবারে আসে।এবছর সে শুধু একা এসেছে।যখন আসে নূরুল তাকে ফসলের সব হিসাব ঠিকঠাক বুঝিয়ে দেয়।এবং তা বিক্রি করে টাকা দেয়।দু-দিন চার দিন গ্রামে থেকে তারপর আরাবুল আবার শহরে চলে যায়।নিজের বাগানের গাছে পাকা টাটকা কিছু ফল নিয়ে ব‍্যাগ ভর্তি করে।
                                   তিন

       শহরে যাওয়া আরাবুলের পাকা বারো বছর চলছে।দু-হাজার আট সাল থেকে দু-হাজার বিশ সাল পর্যন্ত হিসাব করলে পাকা বারো বছরই হচ্ছে।বারো বছর একেবারে কম সময় নয়।এক দশকেরও বেশি সময়।তার আগে আরাবুল গ্রামেই ছিল।গ্রামের মাঠ ঘাট,বন-জঙ্গল,নদী নালা তার আপনজন ছিল।বাবার সঙ্গে সে জমিতে চাষবাস করত।পড়াশোনা করে চাকরি পেয়েছিল না। পূর্বপুরুষের পেশা বাবার সঙ্গে তাই চাষবাসে নেমেছিল।তারপর হঠাৎ একদিন তার বাবা মারা গেলে চাষবাস ছেড়ে দিল।দিয়ে শহরে চলে গেল।
       আরাবুলের স্ত্রী রোজি বিবি।বিয়ের পরে রোজি বিবি।তার আগে সে রোজি খাতুন ছিল।সে ছাড়া আরাবুলের শ্বশুর শাশুড়ির কেউ নেই।না কোনো ছেলে না কোনো মেয়ে।রোজিই একমাত্র। ফলে রোজির মা-বাবার দেখভালের দায়িত্ব কিন্তু রোজির উপরই পড়ে।কিন্তু দূর থেকে সে তাদের দেখভাল করবে কিভাবে?উভয় পক্ষের সুবিধার জন্য তারা তাই শহরেই চলে যায়।

       কিছুদিন হল রোজির মা মারা গেছে।রোজির বাবারও শরীর খুব একটা ভালো নেই।কখন যে চলে যাবে বলা মুশকিল!তবু যে ক'টা দিন বেঁচে আছে দেখভাল করতে হবে।তারপর যেদিন নেই হয়ে যাবে তারা গ্রামে ফিরে আসবে।কারণ আরাবুলের জন্ম এবং বেড়ে ওঠা সবকিছুই গ্রামে। গ্রামে তার বন্ধু বান্ধব,আত্মীয় স্বজন,পাড়া প্রতিবেশী সবাই রয়েছে।রয়েছে তার পুরনো কত স্মৃতি।যেকারণে সে আবার গ্রামেই ফিরে আসবে। কিছু কিছু মানুষ থাকে গ্রামের মানুষ হয়েও তারা গ্রামকে অবহেলা করে।শহরকেই বেশি পছন্দ করে।আরাবুল তাদের দলে নেই।শহরের চাইতে গ্রামকেই তার বেশি ভালো লাগে।গ্রামকেই সে বেশি পছন্দ করে।গ্রামেই সে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে।কথায় আছে না,গ্রাম স্বর্গ!সে আবার তাই গ্রামেই ফিরে আসবে।এসে আগের পেশা চাষবাস আবার শুরু করবে।কারণ ভারতবর্ষের বেশিরভাগ মানুষের প্রধান জীবিকাই হল চাষবাস।অতএব কাজটা সে ছাড়বে না।আঁকড়ে ধরে থাকবে।

                               চার

        সে এলেও তার দুই ছেলে গ্রামে আসবে না। কারণ তাদের জন্ম যে গ্রামে নয়,শহরে।তারা বড়ও যে হচ্ছে শহরে।পড়াশোনাও করছে শহরে।শহরের ইট,পাথর,সরু গলি আর বদ্ধ হাওয়াই যে তাই তাদের কাছে অত্যন্ত প্রিয় হয়ে গেছে।ফলে গ্রামের পরিবেশ যতই মনোরম হোক।গ্রামের আকাশ যতই উদার হোক।গ্রামের মাঠ যতই খোলা হোক। নদী কুলকুল করে যতই প্রবাহিত হোক।গ্রাম যতই স্বর্গ হোক।তবু তাদের গ্রাম ভালো লাগবে না।গ্রামে মন বসবে না।গ্রামের মাটির রাস্তা।আর বন জঙ্গলে তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করবে না।গ্রামের পরিবেশে তাই তারা খাপ খাওয়াতে পারবে না। নিজেদের মানিয়ে নিতে পারবে না।এই জন‍্যই তারা গ্রামে আসতে চাইবে না।আসতে না চাইলে আরাবুলও তাদের আসার জন্য পীড়াপীড়ি করবে না।কারণ গ্রাম যতই স্বর্গ হোক সুযোগ সুবিধা কিন্তু শহরেই বেশি।তাই তারা না আসতে চাইলে না আসবে।আরাবুল তাদের আনবে না।শহরেই রেখে দেবে।তার শ্বশুর মশাইয়ের এখন যে বাড়িটায় তারা রয়েছে ওই বিরাট বাড়িটা তার শ্বশুর মশাই আগেই আরাবুলের দুই ছেলের নামে লিখে দিয়েছে।নাহলে মৃত্যুর পর তার ভাই ভাইপোরা যদি ভাগ পেয়ে যায়।যেকারণে আরাবুলের ছেলেরা যদি শহরে থাকতে চায় তো থাকবে।গ্রাম থেকে তারা মাঝে মাঝে শহরে গিয়ে ছেলেদের শুধু দেখে আসবে।

                              ‌   পাঁচ

       শহরে যাওয়ার আগে আরাবুল তার বিষয় সম্পত্তি যেমন পুকুর,বাগান এবং মাঠান জমি নিয়ে খুব দুশ্চিন্তায় ছিল।এসব সম্পত্তি গ্রামে একা ফেলে রেখে শহরে সে যাবে কি করে?গেলে তার সব সম্পত্তির কি হবে?পুকুর ভর্তি মাছ।তবু পুকুরে একটা মাছ থাকবে না।সব শালা বারো ভূতে ধরে খাবে।বাগানে যত ফল হবে একটাও ফল পাকতে দেবেনা।পাকার আগে কাঁচাতেই শালা ভূতেরা পেড়ে খেয়ে নেবে।শুধু গাছের ফল পেড়েই খাবেনা।গাছের ডাল ভেঙে বাড়িতে পাতা নিয়ে গিয়ে বাড়ির গরু,ছাগল দিয়ে সেই পাতা খাওয়াবে।যেন ভূতেদের সব বাপের গাছ!যখন যা ইচ্ছা তাই করবে!ফলে গাছ মরে যাওয়ার ভয় থাকবে বেশি।গাছ তো আর এমনি এমনি মানুষ হয়নি।মানুষ করতে হয়েছে।গাছ মানুষ করতে তার বাবাকে যথেষ্ট পরিশ্রম করতে হয়েছে। ছোটবেলায় সে তার বাবাকে গাছের পিছনে পরিশ্রম করতে দেখেছে।গাছ লাগানোর পর গাছের কি যত্ন নেওয়া!গরু ছাগলে মুখ দেবে বলে বাঁশের রেলিং করে গাছ ঘিরে রাখা থেকে শুরু করে সকাল সন্ধ্যা দু-বেলা করে গাছের গোড়ায় জল দেওয়া।গাছ যাতে মরে না যায় এবং তাড়াতাড়ি সুষ্ঠুভাবে বেড়ে উঠতে পারে।ঠিক ছেলে মানুষ করার মতো করে তার বাবা গাছ মানুষ করেছে।আর সেই গাছ,সেই বাগান,ভূতেরা নষ্ট করে দেবে!পেঁচার মতো বাগান তছনছ করে দেবে!না,এ হতে পারে না।কোনো ভাবেই এটা হতে দেওয়া যাবেনা।তার বাবা আজ পৃথিবীতে বেঁচে নেই ঠিকই।কিন্তু তার বাবার সম্পদ তো বেঁচে রয়েছে।হঠাৎ মরে যাওয়ার কারণে সে তার বাবার অন্তিম সেবা করতে পারেনি।কিন্তু তারজন্য যে সম্পদ তার বাবা রেখে গেছে সেই সম্পদের সে ঠিকই যত্ন নেবে।বাবার রেখে যাওয়া সম্পদ সে কোনোভাবেই নষ্ট হতে দেবেনা।আর তারজন‍্যই সে নূরুলকে দেখাশোনার ভার দিয়ে গেছে।ফলে ভূতেরা কিছুই করতে পারেনি।হয়তো চেষ্টা করেছিল।ওইসময় নূরুল তাদের টুঁটি চেপে ধরতে চেয়েছিল বলে হয়তো পারেনি।যেকারণে আরাবুলের এখন খুব ভালো লাগছে।খুব ভালো লাগছে।

                                  ছয়

        শহরে যাওয়ার কয়েক দিন আগে নূরুল আরাবুলের বাড়ি এসেছিল।আরাবুল তখন ঘরে ছিল।তার বাবার পুরনো রেডিওটা দীর্ঘদিন না বাজানোর ফলে নষ্ট হয়ে পড়েছিল।মুছে ঘষে রেডিওটা শহরের ভালো মেকানিকের কাছে নিয়ে গিয়ে সারিয়ে নিয়ে বাজাবে বলে আরাবুল রেডিওটা মোছা ঘষা করছিল।কিন্তু রোজি ঘরের বাইরে বারান্দায় চৌকির উপর বসে ছিল।নূরুল সেই সময় আরাবুলের বাড়ি এসে রোজিকে জিজ্ঞেস করেছিল,"আরাবুল আছে গো?"
        রোজি "আছে" বলেছিল।
       "কোথায় আছে?ঘরে?"পরে নূরুল জিজ্ঞেস করেছিল।
       "হ‍্যাঁ।"বলে রোজি জানিয়েছিল।
       নূরুল তখন রোজিকে আরাবুলকে একটু ডেকে দেওয়ার কথা বলেছিল।
       রোজি আরাবুলকে ডেকে দিয়েছিল,"তোমাকে ডাকছে গো।বেরিয়ে এসো।"
        আরাবুলের হাতে তখন কাজ ছিল।তাই সে বেরিয়েছিল না।না বেরিয়ে রোজিকে বরং জিজ্ঞেস করেছিল,"কে ডাকছে?"
       কে ডাকছে তার উত্তর এবার আর রোজিকে দিতে হয়েছিল না।নূরুলই দিয়েছিল,"আমি ডাকছি রে,আরাবুল।"
       গলা শুনে চিনতে পেরে আরাবুল বলেছিল,"কে,নূরুল?"
       "হ‍্যাঁ।কি করছিস?"
       "একটু কাজ করছি।বাবার রেডিওটা না বাজিয়ে না বাজিয়ে নষ্ট হয়ে পড়ে আছে। মেকানিকের কাছে নিয়ে গিয়ে সারিয়ে নেবো বলে একটু মোছা ঘষা করছি।"
       "যেকোনো জিনিস ব‍্যবহার করলেই ভালো থাকে।তা হবে তো।আগের ভালো রেডিও।"
       "তাই বলেই তো।"বলে আরাবুল বলেছিল,"কিছু বলছিলি?"
       "বলছিলাম তো।একটু বেরিয়ে আসবি না?"
       "আসছি।"আরাবুল ভেতর থেকে বেরিয়ে এসেছিল,"বল।"
       নূরুল বলেছিল,"তোর কাছে একটু এলাম।"
       "কি,বল।"
       নূরুল বলেছিল,"তোর কাছে একশোটা টাকা হবে?
       আরাবুল বলেছিল,"কি করবি?"
       "খুব দরকার আছে।থাকলে দে না!" তারপর বলেছিল,"ময়েজ আলির চারদিন কাজ করেছি। একটা পয়সা দেয়নি।সব কাল বিকালে মিটিয়ে দিবে বলেছে।দিলে কাল তোকে দিয়ে যাবো।"
       "ঠিক আছে।নিয়ে যা।"আরাবুল তাকে একশো টাকা দিয়েছিল।টাকাটা নিয়ে নূরুল তখন চলে যেতে গেলে আরাবুল তাকে বলেছিল,"চলে যাচ্ছিস?"
       "যাচ্ছি তো।কিছু বলবি নাকি?"
       আরাবুল বলেছিল,"তোর সঙ্গে আমার কিছু কথা ছিল।"
       নূরুল বলেছিল,"খুব জরুরি কথা নাকি?"
       আরাবুল বলেছিল,"খুব জরুরি না।আবার খুব জরুরি।"
        নূরুল বলেছিল,"কথাটা কাল শুনলে হবেনা?"
       "খুব ব‍্যস্ত আছিস নাকি?"
       "হ‍্যাঁ,একটু ব‍্যস্ত আছি।"
       "কোথাও যাবি নাকি?"
       "যাবো।"
       "কোথায়?"
       "শ্বশুর এসেছে।বাজার করতে যাবো।"
       "ঠিক আছে যা তাহলে।কাল একবার আসিস।"
       "আসব।"
        এরপর নূরুল বাড়ি থেকে বেরিয়ে চলে গিয়েছিল।
                                 

                                 সাত

       পরেরদিন কথামতো নূরুল ঠিকই এসেছিল। নূরুল যে আসবে সে বিষয়ে আরাবুলের একটা বিশ্বাসও ছিল।কারণ আগেও নূরুল অনেক দিন তার কাছ থেকে টাকা ধার নিয়ে গেছে।এবং যেদিন যে সময় দিয়ে যাবে বলেছে দিয়ে গেছে।কথার কোনো দিন খেলাপ করেনি। আরাবুলের তাই মনে এই বিশ্বাস ছিল যে,সে আসবে।
       এসে প্রথমেই নূরুল তার শার্টের বুক পকেটে হাত ঢুকিয়েছিল।ঢুকিয়ে পকেট থেকে একটা নোট টাকা বের করে আরাবুলকে দিয়ে বলেছিল,"টাকাটা নে।এক্ষুনি পেলাম।"
       আরাবুল টাকাটা নিয়ে বলেছিল,"এক্ষুনি পেয়ে এক্ষুনি দিতে চলে এলি?পরে দিলে হতো না?"
       নূরুল বলেছিল,"হতোনা আবার?হতো।"
       "তাহলে পরে দিলেই পারতিস।"
       নূরুল তখন বলেছিল,"আসলে কি জানিস, কেউ টাকা পেলে আমার ভালো লাগেনা।শান্তি পাই না।তাছাড়া অভাবের সংসার।কখন কোন দিকে খরচ হয়ে যাবে।তখন দিতে পারব না।কথার দাম থাকবে না।কথার দাম রাখলে পরে এলে আবার পাবো।"
      "তোর চিন্তাটা অবশ্য মন্দ না।কথার দাম রাখলে তার আলাদা একটা মূল্য আছে।"
       "আমি সেটা জানি তো।যাক,কাল কি কথা বলবি বলছিলি?বলবি নাকি?"
       "হ‍্যাঁ,বলব।বস,বলছি।"আরাবুল তাকে বসতে বলেছিল।
       নূরুল বসেছিল,"বল।"
       আরাবুল বলেছিল,"তোর শ্বশুর আছে?না চলে গেছে?"
        "চলে গেছে।"নূরুল বলেছিল।
        "কখন?"
        "কালই চলে গেছে।"
        "কাল এসে কালই চলে গেছে?"
        "হ‍্যাঁ।এসে থাকেনা।"
        "যাইহোক,নূরুল?"
        "বল।"
        "তোর সঙ্গে আমার কিছু কথা আছে।"
        "বল,শুনছি।"
        "কথাটা হল,আমরা শহরে চলে যাচ্ছি।"
        "কবে?"
        "কয়েক দিনের মধ্যেই যাচ্ছি।"
        "আসবি কবে?"
        "ঠিক নেই।"
        "তা-ও?"
        "তা-ও কোনো ঠিক নেই।শ্বশুর শাশুড়ি বেঁচে থাকা পর্যন্ত তো থাকতেই হচ্ছে।আমরা ছাড়া তাদের তো দেখাশোনা করার কেউ নেই।"
        "তাই তোরা দেখাশোনা করতে যাচ্ছিস তাইতো?"
        "হ‍্যাঁ।"
        "কিন্তু?"
        "বল।"
        "তোর পুকুর,বাগান,গাছ,জমি এসবের তাহলে কি হবে?বাড়িতে মানুষ না থাকলে যে একদিনও ঠিক থাকবে না।সব লোকে লণ্ডভণ্ড করে দেবে।"
       "ওই জন‍্যই তো ভীষণ চিন্তা হচ্ছে।কি করব বুঝতে পারছি না।তুই একটা কিছু বল না!ওই জন‍্যই তো তোকে বসতে বললাম।"
       মিনিট খানেক চিন্তা করে নূরুল বলেছিল,"তোকে তাহলে কাউকে দেখাশোনার ভার দিয়ে যেতে হবে।নাহলে কিন্তু কিছুই ঠিক থাকবে না।"
       আরাবুল অমনি নূরুলকে বলেছিল,"কাকে আর ভার দিয়ে যাবো?ভারটা তুই-ই নে না!" তারপর বলেছিল,"যা ফল,ফসল আর মাছ হবে তুই খাবি।আর আমার জন‍্য রাখবি।বছরে একবার করে যখন আসব তখন দিবি।"
       "ঠিক আছে।"
       তখন থেকে নূরুল দেখাশোনা করে।

                                আট

      গত পরশুদিন আরাবুল গ্রামে এসেছে।এসে গ্রামে তার যত পুরনো বন্ধু বান্ধব এবং শুভানুধ্যায়ী ছিল তাদের সঙ্গে দেখা করেছে। পুকুর,বাগান,গাছ ঘুরে দেখেছে।সব ঠিক আছে। কোনো কিছুরই কোনো ক্ষতি হয়নি।শুধু মাঠেই তার নামা হয়নি।জমি দেখতে।আজ বিকালে নামবে বলে ঠিক করেছে।ঘড়িতে এখন দুপুর বারোটা বেজে এক মিনিট বাজছে।বছর খানেক বাড়িটা তালাবন্ধ থাকায় ভিতরটা আগাছার জঙ্গলে পুরো জঙ্গল হয়ে আছে।পরশুদিন এলেও সাফ করবার সময় হয়নি।সকালের দিকে পুকুরের জলে জাল টেনে তিন কিলো ওজনের একটা মাছ ধরে নূরুলকে দিয়ে মাছের ঝোল করতে বলে আজ বেলা দশটার পরে তাই সাফ করতে শুরু করেছে।সাফ হয়ে গেলে সাবান মেখে চান করবে। তারপরই নূরুল মাছ ভাত নিয়ে আসবে।খেয়ে  ঘুমাবে।তারপর রোদ কমে গেলে বিকালের দিকে মাঠে নামবে।নেমে সব জমি দেখে সন্ধ্যার আগে মাঠ থেকে উঠে আসবে।আকাশে ঠিক ঝিকিমিকি বেলা থাকতে।

                                নয়

        রোদ কমে গেলে বিকালের দিকে আরাবুলের ঘুম ভাঙলো।এবং কথামতো সে মাঠে নামল।নেমে জমি দেখে সে সন্ধ‍্যার আগে মাঠ থেকে উঠে আসতে লাগল।আসতে আসতে হঠাৎ তার মনে পড়ে গেল,সে যে জমিটার আল দিয়ে এখন হাঁটছে জমিটা এক দাগে পাঁচ বিঘা।জমিটা এক সময় তার বাবার নামে ছিল।কিন্তু এখন নেই। এখন একটা নষ্টা মেয়ের নামে রয়েছে।কথাটা মনে পড়ে যাওয়ায় আরাবুল আর ওই জমির আল দিয়ে হাঁটল না।বরং সে জমিতে কয়েকবার 'ওয়াক থু','ওয়াক থু' শব্দ করে ঘৃণার থুতু ফেলল।ও আলে দাঁড়িয়ে জমিতে পেচ্ছাব করল।করে সে অন‍্য জমির আল ঘুরে মাঠ থেকে উঠে আসতে লাগল।

                                  দশ

        ঘটনাটা আজকের নয়।অনেক দিন আগের পুরনো ঘটনা।আরাবুল তখন ক্লাস ইলেভেনের ছাত্র ছিল।সেইসময় আরাবুলের বাবা আহমেদ আলি জমিটা ওই নষ্টা মেয়েটাকে লিখে দেয়।নষ্টা মেয়েটা হল রাবিয়া বিবি।আরাবুলের গর্ভধারিণী মা।তবু আরাবুলের চোখে সে একটা নষ্টা মেয়ে ছাড়া কিছু না।কারণ নষ্টাদের সকল বৈশিষ্ট্য আরাবুল তার মধ্যে দেখেছে।
       আরাবুল তাই মেয়েটাকে জমি দেওয়ার সময় তার বাবাকে বলেছিল,"ওকে জমি দিতে হবেনা। ওকে জমি দিবেন না।"
        "কিন্তু আমি তো অন্য কাউকে জমি দিচ্ছি না।তোর মাকে দিচ্ছি।"
       "তা-ও দিতে হবেনা।আপনার জমি আপনার নামেই থাকুক।"
       "তোর মায়ের নামে থাকলেই বা কি ক্ষতি? আমার নামে থাকলেও পরে তুই পাবি।তোর মায়ের নামে থাকলেও পরে তুই-ই পাবি।তুই ছাড়া আমাদের যে আর কেউ নেই।"
       "জমি নিয়ে যদি পালিয়ে যায়?তখন কি হবে?"
       "কোথায় পালিয়ে যাবে?"
       "পালিয়ে যাওয়ার আজকাল জায়গার শেষ আছে নাকি?কত জায়গা।ধরে নিন,আপনাকে বাদ দিয়ে অন্য ছেলের সঙ্গে পালিয়ে গেল।ওই জমি তখন আমি আর পাবো কি?পাবো না।যে ছেলের সঙ্গে পালিয়ে যাবে এবং তার সঙ্গে তার যত গুলো ছেলে হবে তারা পাবে।"
        "ধুর পাগল,তাই কখনো হয় নাকি?"
        "না হওয়ার কি আছে?হতেও তো পারে। আজকাল চার পাঁচ ছেলের মা-ও পালিয়ে যাচ্ছে। পালিয়ে যাওয়াটা মেয়েদের কাছে আজকাল ফ‍্যাশান হয়ে দাঁড়িয়েছে।"
        "তবে সবাই যাচ্ছে না।কেউ কেউ যাচ্ছে।যারা নাম্বার ওয়ান খারাপ মেয়ে তারা যাচ্ছে।তোর মা খুব ভালো মেয়ে।তোর মা যাবেনা।আমি এটা তোকে চ‍্যালেঞ্জ করে বলতে পারি।"
       "খুব ভালো মেয়ে আপনি কি করে জানলেন?"
       "কেন জানব না?তোর মা আমার স্ত্রী না? একটা স্বামী তার স্ত্রীকে যতটা জানবে তার থেকে ভালো পৃথিবীর আর কেউ জানবেনা।"
       "তাই নাকি?"
       "হ‍্যাঁ।"
       "তাহলে জমি দিবেনই?"
       "দিব বলেই তো ঠিক করেছি।এবং কথাও দিয়েছি।তাহলে না দিলে হয়?না দিলে যে তোর মা তোকে এবং আমাকে কাউকেই ভালোবাসবেনা। রান্না করে দেবেনা।সবসময় গালিগালাজ করবে।"
        "বেশি ভালোবাসা পাওয়ার জন‍্যই কি তাহলে আপনি জমি দিচ্ছেন?"
       "সেটা বলতে পারিস।"
       "কিন্তু আপনার ছোট ভাই সেফাতুলও যে তার স্ত্রীকে জমি দিয়েছিল।আপনার মতো বেশি ভালোবাসা পাওয়ার আশায়।এবং আপনার চেয়ে বেশি জমি দিয়েছিল।দ্বিগুণ।মানে দশ বিঘা। নিজের নামে মাত্র কয়েক বিঘা জমি রেখেছিল। কিন্তু আপনার ছোট ভাই তার স্ত্রীর কাছ থেকে ভালোবাসা পেয়েছে কি?পায়নি।বরং আপনার ভাইকে তার স্ত্রী ডিভোর্স দিয়ে পালিয়ে গেছে।এবং তার হাঁটুর বয়সী একটা ছেলেকে বিয়ে করেছে। সুতরাং ও যে তেমনটা করবেনা তার কি কোনো গ‍্যারান্টি আছে?"
       "সেফাতুলের স্ত্রী পাক্কা একটা খানকি মেয়ে ছিল।ওর কথা বলিস না।কিন্তু তোর মা মোটেও ও রকম মেয়ে নয়।একটা পরহেজগার মেয়ে।পাঁচ অক্ত নামাজ পড়ে।কোরান পড়া জানে।এবং রমজান মাসে পুরো একমাস রোজা রাখে।"
        "এসবের দিক থেকে কিন্তু আপনার ভাইয়ের স্ত্রী পাখি বিবিও কম ছিল না।আসলে সমাজে যারা খারাপ মেয়ে হয় তারা যতই ধর্ম করুক তাদের চরিত্র কোনোদিন বদলায় না।অতএব কোনো মেয়ের বাহ‍্যিক ধর্ম পালন দেখে তাকে চরিত্রবান ভাবাটা কিন্তু বুদ্ধিহীনের পরিচয়।"
       আরাবুল এত করে বললেও তার বাবা তার বারণ শুনেছিল না।জমিটা লিখে দিয়ে তবেই থেমেছিল।তারপর বেশিদিন হয়েছিল না।মাত্র ছ'মাসের মাথায় পাড়ার কুমারের সঙ্গে পালিয়ে গিয়েছিল।কুমার হিন্দু না,মুসলিম।এবং তার আগের বউ,ছেলে ছিল।

                                 এগারো

        আরাবুলের মা কুমারের সঙ্গে পালিয়ে গিয়ে তার ঘর করতে শুরু করেছিল।ফলে কুমার তার আগের বউকে তালাক দিয়ে তার বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছিল।তবু আরাবুলের বাবা পরে তাকে আবার নিতে চেয়েছিল।কিন্তু সে আর আসতে চেয়েছিল না।ঘটনাটা শুনতে পেয়ে পরে আরাবুল তার বাবাকে ভীষণ বকেছিল,"আপনি বলে আবার ওই খানকিকে নিতে চেয়েছিলেন? চেয়েছিলেন?"
        "হ‍্যাঁ,চেয়েছিলাম।"
        আরাবুল বলেছিল,"কেন নিতে চেয়েছিলেন? আপনার কি মনে কোনো ঘৃণা নেই?লজ্জা বলে কোনো জিনিস নেই?"
        "থাকবেনা কেন?আছে।"
        "আছে তো নিতে চেয়েছিলেন যে?"
        "আমি ওকে নিতে চেয়েছিলাম কেন জানিস?"
        "কেন?"
        "আমি ওকে অন্য কারণে নিতে চেয়েছিলাম।"
        "কি সেটা?"
        "ওকে দেওয়া জমিটা আবার ফুসলিয়ে ফিরিয়ে নেবো বলে।"
        আরাবুল বলেছিল,"আমাদের ভাগ্য ভালো যে,খানকি আমাদের মেরে পালিয়ে যায়নি।এসব ক্ষেত্রে বেশিরভাগ মেয়ে স্বামী সন্তানের মেরে দিয়ে পালিয়ে যায়।সেদিক থেকে আমরা কিন্তু বড় বাঁচা বেঁচে গেছি।আর আপনি ওকে আবার নিতে চেয়েছিলেন?আপনি কি একটা মানুষ?"
        আরাবুলের কথায় তার বাবা কোনো উত্তর করতে পেরেছিল না।নীরবে শুধু আরাবুলের বকুনি খেয়েছিল।এরপর বকুনি দেওয়া শেষ হলে আরাবুল বলেছিল,"আমি কি বলেছিলাম আমার কথা এবার সত‍্যি হল তো?"
        "আর বলিস না,যে ভুল করেছি এ ভুল আর জীবনে ভুলতে পারব না।সেদিন তোর কথা কেন যে শুনিনি?"
        আরাবুল তার বাবাকে পরে সান্ত্বনা দিয়েছিল,"যা হবার তা তো হয়েই গেছে।ও নিয়ে আর একদম ভাববেন না।একদম মন খারাপ করবেন না।মানুষের জীবনে যখন বিপর্যয় ঘটে অনিবার্য ভাবেই ঘটে।আমাদের জীবনেও সে রকমই ঘটেছে।"ও পরে বলেছিল,"মন চাইলে আপনি আবার বিয়ে করতে পারেন।আমি আপনাকে বাধা দেব না।"
       উত্তরে তার বাবা তখন আর বিয়ে করবে না বলে জানিয়েছিল।কারণ বিয়ে করে পরে সেই মেয়ে যদি আবার----
   
                                   বারো

       আরাবুলের মা যে এ গ্রেডের একটা চরিত্রহীনা মেয়ে ছিল আরাবুল সেটা ক্লাস সেভেনে পড়ার সময়ই দেখেছিল।কিন্তু আরাবুলের বাবা সেটা জানত না।কারণ তার বাবা যে বাড়িতে থাকতো না।কলকাতায় রাজমিস্ত্রি কাজের ঠিকাদারি করত।বছরে দু-বার চারবার করে বাড়ি আসত।বাড়ি এলেও বাড়িতে বেশি দিন থাকতো না।বড়জোর চারদিন।তারপর আবার লেবার, মিস্ত্রি নিয়ে চলে যেত।যে ক'টা দিন বাড়িতে থাকতো আরাবুলের মা খুব চাপে থাকতো।তার বাবার সঙ্গে ভালো ব‍্যবহার করত।বাড়ি থেকে কখনো বের হতো না।কোনো পরপুরুষের সঙ্গে মিশত না।কোনো পরপুরুষের মুখ দেখাত না। নিজের শরীরটা আর সুন্দর মুখটা পর্দার আড়ালে সবসময় ঢেকে রাখত।ধর্ম কর্ম করত।কোরান পড়ত।নামাজ পড়ত।সে যে একটা চরিত্রবান মেয়ে এবং একটা ভালো স্ত্রী সেটা দেখাত।কিন্তু নিজের কর্মক্ষেত্রে তার বাবা যেই চলে যেত অমনি তার মা সব ছেড়ে দিত।তখন কি বা প‍র্দা করা।কি বা নামাজ পড়া।কি বা কোরান পড়া।সাজগোজ করে আলগা মাথায় অর্ধেকেরও বেশি বুক উদোম করে শুধু পাড়া পাড়া ঘুরে বেড়াত।আর মাংসবহুল নিতম্বে ঢেউ তুলে।আরাবুলের বাবা তো এসব দেখতে পেত না।কিন্তু বাড়িতে থাকতো বলে আরাবুল সব দেখতে পেত।এবং শুনতে পেত।সে তাই একদিন তার মাকে বলেছিল,"মা,বাড়িতে বাবা না থাকলে তুমি অত সাজগোজ করো কেন?দেখতে ভালো লাগেনা।"
        "তোর ভালো লাগার জন‍্য তো আমি সাজগোজ করিনা।তাহলে তোর ভালো লাগলো না লাগলো তাতে আমার কি এসে গেল?"
       "অত পাড়া বেড়াও কেন?মেয়েমানুষের অত পাড়া বেড়ানো ঠিক নয়।লোকে অনেক কথা বলবে।"
       "যে শালা বলবে সে শালাকে তখন দেখে নেবো।অণ্ডকোষ কেটে নেবো।"
        "মেয়েমানুষ হয়ে তুমি-----"
        "কি ভেবেছিস আমাকে!"
        "তুমি যাই বলো মা,পাড়া বেড়াতে আমার কিন্তু একদম ভালো লাগেনা।"
        "তোর ভালো লাগা না লাগা সেটা তোর ব‍্যাপার।কি বলছিস আমাকে তার?আমার ভালো লাগে আমি পাড়া বেড়াব।"
        আরাবুল বলেছিল,"ভালো লাগলেও তুমি আর পাড়া বেড়াবে না।"
        "কি বললি!পাড়া বেড়াব না?"
         "না।আমি তোমাকে নিষেধ করছি।"
         "তুই আমার ভাতার নাকি যে আমি তোর নিষেধ শুনব?তুই আমাকে নিষেধ করার কে?"
         "ছি: মা,ছি:!"
         "তুই যতই ছি-ছি কর,আমি কিন্তু পাড়া বেড়াবোই।তোর নিষেধ আমি শুনবো না।তোর তাতে কিছু বলার আছে?"
        "বাবা এলে আমি তাহলে বাবাকে সব বলে দেবো।দিয়ে আচ্ছা করে তোমাকে মার দিতে বলবো।যাতে তুমি জীবনে কোনোদিন পাড়া না বেড়াও।"আরাবুল তার বাবার ভয় দেখিয়েছিল।
       তার মা তখন আরাবুলকে বলেছিল,"বলে দিস!তোর বাবাকে আর তোকে তাহলে খাবারের সঙ্গে বিষ দিয়ে মেরে দেব।আমাকে তোরা চিনিস না তো।আমি কেমন মেয়ে তখন চিনবি।"
       ফলে আরাবুল তার বাবাকে তার মায়ের সম্পর্কে কোনো দিন কোনো কথা বলত না।তার মায়ের পাড়া বেড়ানো সুতরাং কমেছিল না।তবু তার মায়ের সঙ্গে সম্পর্ক ছিল।দূরত্ব ছিল না। সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে গেল এবং দূরত্ব বাড়লো যেদিন তার মাকে আরাবুল কুমারের সঙ্গে দেখে ফেলল। এক ঘরে এক বিছানায়।পোশাক ছাড়া অবস্থায়। আরাবুল তাদের দেখে ফেললেও তারা কিন্তু তাকে দেখেছিল না।দেখলে পরে কি যে হতো বলা যেত না।হয়তো তারা তাদের চরিত্র দোষ ঢাকবার জন্য তাকে মেরে দিত।দিয়ে মাটি খুঁড়ে পুঁতে রাখত।পরে আরাবুলও আর তাকে কোনোদিন বুঝতে দেয়নি যে,সে তাদের কুকীর্তি দেখেছে।সে তাদের গোপন পাপ দেখেছে।সে তাদের গোপন পাপের খবর সব জানে।কিছুদিন বাদে তার বাবা এসেছিল। আরাবুল তার বাবাকেও ঘটনাটা বলেছিল না। বলতে তার সম্মানে বেধেছিল।মায়ের এতবড় কুকীর্তির কথা পরমপূজনীয় বাবাকে সে বলবে কিভাবে?কাউকে বলতে না পারার দুঃখে সবসময় সে তাই মনমরা হয়ে থাকতো।যে নারীকে পৃথিবীতে সে শ্রেষ্ঠ নারী বলে চিনে এসেছে।যে নারীকে সে মা বলে জেনে এসেছে।যে নারীকে সে হৃদয় মন্দিরে অধিষ্ঠিত করে মাতৃ রূপে পূজা করে এসেছে।তার চরিত্রে এত কালিমা!তার চরিত্রে এত কলুষতা!তার চরিত্রে এত পাপ!এত দাগ!বাবাকে সেদিন তার জমি দিতে বারণ করার কারণই ছিল এটা।তার বাবা আসল বিষয়টা জানত না বলেই সেদিন জমিটা দিয়েছিল।জানলে পরে কক্ষনো দিত না।আরাবুল এখন বুঝতে পারছে,বিষয়টা তার বাবাকে জানানো উচিত ছিল।একটু লজ্জা হয়তো লাগতো।তার বাবার শুনে একটু খারাপ হয়তো লাগতো।কিন্তু তার বাবার জমির মধ্যে যেটা সেরা জমি সেই জমিটা হারাত না।তার বাবার নামে থাকতো।তার বাবা মরে গেছে।সুতরাং এখন তার নামে থাকতো।তার আরো পাঁচ বিঘা জমি বেশি হতো।পাঁচ বিঘা জমির আজকাল কি দাম!সেই ঘুণ পোকাটা আরাবুলকে এখন সবসময় কুরে কুরে খায়।





নৈঃশব্দের চূড়ায়
শ্যামাপ্রসাদ সরকার


বিরাট একটা পাঁচিল। দূর থেকে দেখলে জেলখানারর কথা মনে পড়ে যাবে। তারপর একটা ফটকের ওপারে উঁচু মিনারটা আজও শহরের সমস্ত কোলাহলের সীমানা পেরিয়ে চুপ করে টিকে আছে। আসলে চারপাশটাই বদলে গিয়েছে অনেকটা। এখন শহরের  আশেপাশে তেমন  চিল-শকুনের দেখা মেলে না।
কিন্তু একটা সময় তারাও এখানে অপেক্ষা করে থাকত। কখন একটি মৃতদেহ নিয়ে বাড়ির লোকেরা পল-বিয়ারারের দলের হাতে সেটিকে নীরবে তুলে দেবে সেই মিনারের চূড়ায়। আর তারপর সেই মৃতদেহের দিকে ঝাঁকে ঝাঁকে এগিয়ে আসবে মাংসাশী পাখিরা। তাদেরডানার ঝাপটে আর ক্ষুধার  চিৎকারে সমস্ত নীরবতা ভেঙে খানখান হয়ে যাবে। এখনতো আর চিল-শকুনেরা আর অপেক্ষা করে থাকে না। মৃতদেহও আসে না বললেই চলে।  নওরোজজী দুকানওয়ালাদের মত শ' তিনেক পার্সী পরিবার টিকে আছে এই কলকাতায়। হ‍্যাঁ, বললে কি কেউ মানবে এই সেদিন পর্যন্ত  কলকাতা শহরেই এক লক্ষ পার্সি নাগরিক বাস করত। ইস্ট ইন্ডিয়া
কোম্পানির বদান‍্যতায় কলকাতা তখন সদ‍্যযৌবনা। কত জাতের বর্ণময় লোকের সমাহার তখন  আর ততই  বিচিত্র তাদের  ব্যবসা।  সেই সময় অগ্নি-দেব আহুর মাজ্দা র উপাসক পার্সিরাও এল কলকাতায়। বোম্বাই, সুরাটের পর জাঁকিয়ে বসল তিলোত্তমায়। আগে থেকেই ধনে-বিদ্যায়-ঐশ্বর্যে এগিয়ে ছিল সকলের থেকে। পসার জমিয়ে আরওবড়লোক হয়ে উঠল তারা।
পার্সি ব্যবসায়ী দাদাভাই বেহরামজি বানাজি সুরাট থেকে কলকাতা এসেছিলেন ১৭৬৭ সালে।  কলকাতায় তাঁদের উদ্যোগে তৈরি হয়েছিল একাধিক এন্টারপ্রাইজ। তবে বাঙলা ও বাঙালির সঙ্গে মিলেমিশে যেতে তাঁদের বেশি সময় লাগেনি। অনেকের তো পদবীর শেষে ‘বেঙ্গলি’ শব্দটাও যুক্ত হয়ে গিয়েছিল। ঠিক যেমন করে পেশা বা ব‍্যবসাভিত্তিক ভাবে
 ' বাটলিওয়ালা', 'দারুওয়ালা', 'মিস্ত্রী এসব পদবী গুলো এসেছে।
*********
নওরোজজী দুকানওয়ালার বয়স এখন আশি ছুঁই ছুঁই। একা নির্জন একটা কামরায় সিনাগগ্ স্ট্রীটের ভেতরে তার পঞ্চাশ বছরের ভাড়া করা ফ্ল‍্যাট। তখন ভাড়া ছিল মাসে একশো দশ টাকা এতদিনে বেড়ে বারশো পঞ্চাশ। মালিক টালিক কেউ নেই। ফ্ল‍্যাটটা আদালতের রেজিস্টারের হাতে চলে গেছে তাও নয় নয় করে বছর দশেক হল। যে কোন দিন শমন পাঠিয়ে উঠিয়ে দিতে পারে। তাও নিজে  নিয়ম করে রেন্ট কন্ট্রোলের অফিসে গিয়ে ভাড়া দিয়ে বেরোবার সময় রেভিনিউ স্ট‍্যাম্ন লাগানো রসিদটা পকেটে পুরতে পুরতে প্রতিবার একবার করে ভাবেন,
'যাঃ! এই শেষবার! সামনের মাসে বোধহয় আর আসতে হবেনা! '
নওরোজজীর  জীবনেও যেমন ছুটির নোটিস আসতে দেরী করছে , তেমনি আদালতের ঘর ছেড়ে উঠে যাওয়ার শমনটাও আসব আসব করে এখনো আসেনি।
************
একা থাকাটাই অভ‍্যেস হয়ে গেছে বলে হলদেটে দেওয়ালে বাল্বের আলোয় নিজের কাঁপাকাঁপা ছায়াটাকেও আজকাল পছন্দ হয়না যেন! এতরকমের মৃত‍্যু দেখেছেন যে, সে আজ সব গা সওয়া হয়ে গেছে।

নওরোজজীর একমাত্র  ছেলে সোরাবজী  গেল এয়ারফোর্সে চাকরী করতে । সেই তরতাজা তিরিশ বছরের ছেলে যখন প্লেন ক্র‍্যাশে মারা গেল তখন থেকেই আবার নতুন করে শূন‍্যতার সাথে বন্ধুত্ব পাতাতে বসা। ওই একবারই যা নওরোজজীর টাওয়ারে আসা হয়নি। নইলে  তার আগে অবধি বাবা, মা, কাকা, ভাই, সোফিয়া...প্রতিটা প্রিয়জনকেই শেষবার নিয়ে এসে নিজের হাতে পল-বিয়ারারের হাতে জমা করে গেছেন। মাংসলোভী গৃধিণীদের ভুক্তাবশেষ হয়ে আস্তে আস্তে মিলিয়ে গেছে তারা। স্ত্রী সোফিয়া তো আগেই গেছিল। সোরাব তখন স্কুলে পড়ত। কাপড়ের ব‍্যবসায়ী রনি বিলিমোরিয়ার মেয়ে সোফিয়া যে কি করে নওরোজজীর প্রেমে পড়েছিল তা এক রহস‍্য বটে। অবশ‍্য তখন নওরোজজীও সুপুরুষ ছিল। পাক্কা ছ'ফুট লম্বা, হকি খেলা চেহারা আর টকটকে গায়ের রঙ।  ওদের ছিল পোর্সেলিনের বাসন আর ফুলদানী তৈরীর একটা ছোট কারখানা। ট‍্যাংরা ছাড়িয়ে সে সব জায়গা তখন ধূ ধূ প্রান্তর একেবারে। বেশ ছিল কিন্তু দিনগুলো তখন।
*********
এরপর ছেলের বউ আফরিন একদিন সন্ধেবেলা  ওদের বাড়ি ছেড়ে চলে গেল দুবছরের  ফুটফুটে নাতনি শিরিনকে নিয়ে। সে আবার সংসার পাততে চায়!  নাঃ, নওরোজজীর এ বিয়েতে কোনরকম আপত্তি ছিল না ঠিকই  তবে নাতনীটাকে দেখতে না পাওয়া আর সিনাগগ স্ট্রীটের চারটে দেওয়ালের চাপা একাকীত্বটাই যা  শুধু গিলে খেতে আসত। নাতনীটার ফেলে যাওয়া ফিডিং বোতলটায় দুধের গন্ধও শুকিয়ে চড়া পরে গেছে কবেই।
এরমধ‍্যে তো একবার তো ঘুমের ওষুধ খেয়ে আত্মহত‍্যাও করার কথাও মনে হয়েছিল। কিন্তু না, ওষুধের  স্ট্রীপটা খালি করতে আর শেষ অবধি সাহসে কুলোয়নি।

*********
শীতকালে হাঁপানির কষ্টটা বাড়ে। বুড়ো হওয়াটায় এটাই একটা অসুবিধা। বড্ড নড়বড়ে হয়ে যেতে হয়। বন্ধুবান্ধবের অধিকাংশই এখন সাদা কালো এ‍্যালবামের পাতা থেকে হাতছানি দেয়। সোফিয়াও ওকে ডাকে শুনতে পান! সোরাব ও যেন 'পাপা! পাপা! ' বলে সেইদিনগুলোর মত ট্রাইসাইকেলে চক্কর দেয়। এগুলোর কোনটাই যদিও চোখে দেখা যায়না। মনে হয় চারদিকের অনন্ত শূন‍্যতার মধ‍্যে এই ফিসফিসানিগুলোই  বোধহয় বেঁচে আছে।

**********
রোববার সকালবেলায় হাঁটতে হাঁটতে একবার টাওয়ারের কাছটায় গিয়ে দাঁড়ালেন। অনেক অনেক বছর আগে, যখন বেলেঘাটার খালটাও ছিল না, তখনকার সেই  নিদ্রিত নীরবতার চেহারাটা যেন  টাওয়ার অফ সাইলেন্সের আশেপাশে আজও থমকে আছে। আজকাল বোধহয় আর কেউ আসেনা এখানে। বিরাট পাঁচিলটা দূর থেকে দেখলে জেলখানার মত  মনে হয়। তারপর  সেটা পেরিয়ে একটা ফটকের ওপারে উঁচু মিনারটা বৃদ্ধ নওরোজজীর মতই উদাস, একা,  শূন‍্য আর নিশ্চুপ হয়ে আছে বহুদিনই।

পা টিপে টিপে ওপরটায় উঠে আসলেন নিজেই। কিছু সামান‍্য শুকনো হাড়গোড় পড়ে আছে বলেই হয়তো মৃত‍্যুর গন্ধটা কিন্তু এখনো বেশ টের পাওয়া যাচ্ছে।
কতজনের অশ্রু আর স্মৃতির অবশেষ এখানে!
নিজের আসার সময় হলে তো আর টের পাবেননা মৃত‍্যুর সেই  নিরবিচ্ছিন্ন স্তব্ধতা কেমন করে চিল শকুনের ডানা ঝাপটানোর আওয়াজে টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙে যায়।

পল-বিয়ারার দলের কাউকে দেখা যাচ্ছে না এখন। আচ্ছা যদি সোফিয়া, পল, সবার সাথে এখানে একবার দেখা হয়ে গেলে প্রথমে  কি বলে ডাকবেন নওরোজজী?  তারা যদি আজ সামনে এসে দাঁড়ায় ওঁকে চিনতে পারবে আগের মতোই? সোরাবের দেহের কয়লা হয়ে যাওয়া টুকরোগুলোই মিলেছিল আর্মির কফিনের ম‍ধ‍্যে। নয়তো সোরাবকেও তো যদি এখানে আনতে হত.....

আর এসব ভাবতে ইচ্ছে করছেনা। চুপ করে মাথায় হাত  দিয়ে বৃদ্ধ বসে থাকেন খানিক্ষণ। দুচোখের পাতায় যেন অন্ধকারের ডাক আসছে ধীর পায়ে।
সূর্যের আলো ঢেকে ততোক্ষণে লম্বা লম্বা  ডানা ছড়িয়ে আস্তে আস্তে অসংখ‍্য শকুন আর মাংসভোজী পাখির দল নেমে আসছে....
আরো নীচে....আরো নীচে......
আর তাদের ডানার ঝটপট শব্দে একটু একটু করে ঘুম ভাঙছে নৈঃশব্দের চূড়োয়।




হার্ট অ্যাটাক
সৌরদীপ বর্দ্ধন


জীবনের বাকি দিনগুলি অর্থাৎ গত ১৫  বছরের দিনগুলি থেকে আজকের দিনটা একটু অন্যরকম মনে হল অবিনাশবাবুর।একটু পিছিয়ে গেলেই ধরা পড়বে শহরের নামকরা উকিল,ধোপদুরস্ত চেহারা,হাতে দামি সিগারেট নিয়ে গাড়িতে উঠে পড়া কিংবা নাইটক্লাব,পার্টি এনিয়ে বেশ একরকম বিলাসবহুল জীবনযাত্রায় অভ্যস্ত অবিনাশ সেন।স্ত্রী মারা গেছেন ৮ বছর।একমাত্র ছেলে অস্ট্রেলিয়াতে, তারও নতুন সংসার।কিন্তু সমস্যাটা হল পাড়াটা একেবারেই নাপসন্দ তার।শুধু অনেকদিন ধরে রয়েছেন বলেই থেকে গেলেন অনেকটা এইরকম মনে রেখে চলেন।অথচ আজ তার মনে হল একটা ফেনিল আবহ ঘর জুড়ে, সাদা পরদা আদরহীন আঁচলের মত হাওয়ায় অান্দোলিত হচ্ছে।সামনে খোলা জানালা,খানিকটা ওপরে আকাশ আশ্চর্যজনকভাবে ঝুলে রয়েছে।
মেঘগুলি নিশ্চুপ, শুধু বাতাস জানান দিচ্ছে সে অবিরাম বয়ে চলে।
ঘড়ির পেন্ডুলাম একের পর এক স্টেশন পার করে চলেছে ক্রমশ।তবে বাইরেটা একরকম;পাশের বাড়ির ঝগড়াটা আজও চলছে,ঝন্টুর দোকানে বিকিকিনি শুরু,পাড়ার রক ভরতে শুরু করেছে ধীরে ধীরে।অরিন্দমদের বাড়ির সামনে কুকুরগুলি শুয়ে রয়েছে এখনো।বিকেলের পার্কটা অথবা মোড়ের ছোট্ট বেকারির দোকানটা আজও খুলবে।তবে ডেকচেয়ারটা দুলছে আপন মনে, অবিনাশবাবুর সাথেই।গতকাল সকাল অব্দিও এই চিত্রগুলি একত্রে বিরক্তির উদ্রেক করত অবিনাশবাবুর।মনে হত পৃথিবীর সেরা সার্কাসের তাবুটা বোধহয় তার পাড়াতেই।তাই তিনি বরাবর বাড়ির ভেতরটাকে প্রাধান্য দিতেন বেশি করে।তবে আজ খারাপ লাগা চেপে ধরছে হঠাৎ।তার মনে হচ্ছে এক ছুটে গিয়ে আকাশের টুঁটি টিপে ধরে বলে চলো যেখানে ইচ্ছে চলো! মনে হচ্ছে পাড়ার রকে বসে চা আর কমদামি সিগারেটটায় টান দিয়ে হেসে উঠতে।ইচ্ছে করছে কুকুরগুলি আদর করে দুটি বিস্কুট ছুঁড়ে দিতে কিংবা পাশের বাড়ির ঝগড়াটা তারিয়ে উপভোগ করতে;মনে হচ্ছে অন্তত একবার মোড়ের বেকারির কেকটা চেখে দেখেন। দীর্ঘনিশ্বাস ফেললেন অবিনাশ সেন। তবে কি তিনি পারলেন না?  সেই অবিনাশ সেন যার কোচবিহারের মত এক প্রান্তিক শহরে বড় হয়ে উঠলেও কোলকাতায় পড়তে এসে সাফল্যের সিড়ি বেয়ে তরতর করে ওঠা,তিনি পারলেন না!  তবে কি, তিনি পারতেন অবশ্যই পারতেন, আলবাত পারতেন শুধু কাল হার্ট অ্যাটাকটা হয়েই হল যাবতীয় বিপত্তি। শ্মশানঘাটেও তিনি শুনেছেন, হ্যাঁ তিনি শুনেছেন যে ওরা বলছে টাকা থাকলেই 'সুখী' হয়ে উঠতে পারা যায় না।তখন তিনি পুড়ছেন!





।। নিবন্ধ ।।


প্রসঙ্গ : বাংলা প্রেমের কবিতায় বৈষ্ণব পদাবলীর প্রভাব
শংকর ব্রহ্ম

একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে,আজকাল বাংলায় যত কবিতা লেখা হচ্ছে, তার ষাট ভাগই প্রেমের,বাকী চল্লিশ ভাগের মধ্যে দৈব ও প্রকৃতি বিষয়ক কুড়ি ভাগ,
সমাজ সচেতনতা প্রতিবাদ রাজনীতি বিষয়ক দশ ভাগ,ও বাকী দশ ভাগ অন্যান্য বিষয়ক।
            আবহমানকাল ধরে ভারতবর্ষের
কবিগণ প্রেমের কবিতায় বৈষ্ণব কবিগণের ইঙ্গিতকে অনুসরণ করে রসোৎকর্ষ সাধন করেছেন তাদের নিজেদের কবিতায়।এ'কালের কবিরাও তার ব্যতিক্রম নন।

           বৈষ্ণব কবিতার সার কথা, সম্ভোগকে প্রধান করে ধরলে,প্রেম অনেকখানি স্থূল হয়ে পড়ে।তাই তারা বিরহকে প্রধান করে প্রেমের ভিতরে সূক্ষতার ও অতলতার সৃষ্ট করেছেন,যাতে প্রেম রূপ থেকে অরূপে পৌঁছাতে পারে।বিরহের অনুভূতি বৈষ্ণব কবিতায় বিশিষ্টতা লাভ করেছে।বৈষ্ণব কবিতায় সমস্ত আয়োজনই প্রেমাস্পদের সঙ্গে ব্যবধানের যন্ত্রণাকে ব্যক্ত করার জন্য। কলঙ্ক,প্রতিকূলতা,নিষিদ্ধতা এ'সবের প্রকাশে সে বেদনা আরও তীব্র হয়ে ওঠে।

      শাস্ত্রীয় ও সামাজিক নির্দেশের প্রতিকূলে দাঁড়িয়ে বৈষ্ণব কবিগণ তাদের
অনুভূতিকে যাচাই করে নিতে ভয় পাননি।
রাধা কুলবধূ। প্রতিদিনের আটপৌরে সংসারের মাঝে হঠাৎ কৃষ্ণের সঙ্গে তার দেখা,আর এই দেখা থেকেই প্রেমের যন্ত্রণার শুরু।কুলবধূর দিক থেকে এ'ব্যাপরটা মোটেই সামাজিক নয়।
এর আগে এই মানবিক আবেদনকে স্বীকার করতে আমরা প্রস্তুত ছিলাম না।
কি জীবনে কি শিল্পে এই মানবিক আবেদনের কোন জয়ধ্বনিই ধ্বনিত হয়নি।আমাদের জীবন ছিল কর্তব্য ও আচার নির্ভর।কখনও স্মৃতির অনুশাসনে কখনও সাধনমার্গের নির্দেশে সে ছিল নিয়ন্ত্রিত।আমরা পত্নীসঙ্গ উপভোগ করেছি পুত্রার্থে,আবার পুত্র কামনা করেছি পুন্নাম নরকের কথা চিন্তা করে।
আর বৈষ্ণব কাব্যের প্রয়াস প্রেমের পার্থিব বেদনা থেকে অপার্থিব দ্যুতির সন্ধানে চলা।ফলে স্পর্শ করতে পেরেছে মানুষের মনকে,তত্ত্বনিরপেক্ষ ভাবে।
       যা কিছু স্থূল দৈহিকতা, প্রথানুগ ক্লিন্নতা,অলঙ্কার,বর্ণনা যেন সব ধুয়ে মুছে গেছে বেদনার করুণ স্পর্শে।তাই মেঘের দিকে চেয়ে,চাঁদের দিকে চেয়ে,সমুদ্রের নীল জলের দিকে চেয়ে,বনের দিকে চেয়ে,ময়ূরের কন্ঠধ্বনি শুনে প্রেমিকার চোখে জল আসে।পূর্বরাগের উজ্জ্বল মুহূর্তে তার মনে হয় - " হেরি অহরহ তোমারই বিরহ বিশ্বভুবন মাঝে।"
         যে প্রেমে সামজিক বরমাল্য নেই, সাংসারিক স্বীকৃতি নেই সেই অকৃতার্থতায়
আসে এক দিব্যদ্যুতি, তারই স্ফূরণ ঘটে কাব্যে - " দুহুঁ কোরে দুহুঁ কাঁদে বিচ্ছেদ ভাবিয়া।"
বৈষ্ণব নায়িকা জীবনের যন্ত্রণার মন্দিরে
প্রেমকে প্রতিষ্ঠা করেছেন।প্রেমই সেই মন্দিরের বিগ্রহ।" তারই স্নান লাগি হৃদি যমুনায় আঁখির কুম্ভ ভরি।"
    আধুনিক কবি বলেন,প্রেমের চেয়ে জীবন বড়। আর বৈষ্ণবী নায়িকা বলেন,
জীবনের চেয়ে প্রেম বড়।
      অবশ্য প্রেমের এই ব্যক্তিগত ইচ্ছেকে
ইচ্ছের স্বাধীনতা বলা চলে না।তবুও সন্দেহ থাকে না যে প্রেম কি পরিমাণ আলোড়ণ সৃষ্টি করে মানুষের মনে।
        ইওরোপের মধ্যযুগীয় প্রেমের আখ্যানে এই শাশ্বত প্রেমের অনুভব স্পষ্ট
শোনা গেছে।ত্রুবাদুরদের গানে ব্যক্তিহত
আবেগময় বাসনাকেই স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে।সুফিবাদের সঙ্গে আত্মিকতা কিংবা ত্রুবাদুরদের মরমী আকুলতা মিলে মিশে যায়।বিখ্যাত কাব্যগীতি আলেখ্য
Tristan and Iseult যার নায়ক নায়িকা,
সেখানে একস্থানে Iseult জিজ্ঞেস করছে
Tristan কে," We have lost the world
and the world has lost us.How does it seem to you Tristan my love?"
   Tristan জবাব দিল " When I have you with me beloved,what do I lack? If all the worlds were with us here and now I should have eyes for nothing but you alone. " যে কথা আমরা এখানে Tristan-এর মুখে শুনলাম, রাধার প্রেমের ঘোষণায় তারই প্রতিধ্বনি,
" ছাড়ে ছাড়ুক পতি             কি ঘর বসতি
          কিবা বা করিবে বাপ মায়
জাতি জীবন ধন                 এ রূপ যৌবন
          নিছনি ফেলিব শ্যাম পায়
সমুখে রাখিয়া                    নয়ানে দেখিমু
          লইয়া থাকিমু চোখে চোখে
হার করিয়া                         গলায় বান্ধিয়া
           লইয়া থাকিমু বুকে।।

এই কবিতার শেষ ভাগে কবি বলরাম দাস
জানাচ্ছেন,যে রাধার ইচ্ছে করছে এমন এক দেশে চলে যেতে, যেখানে 'রাধা' বলে
কেউ তাকে পিছে ডাকবে না।কোন সাংসারিক বা সামাজিক আবেদন তাকে
বিরক্ত করবে না।এই পলায়নী মনোবৃত্তি
ব্যক্তিগত বাসনার তীব্রতার দ্যোতক।
অনড় সমাজের পটভূমিতে সেই তীব্রতা বিদ্যুল্লেখার মতো ঝলসে উঠেছে।অসামাজিক প্রেম বলে বোধহয় মিলনেও
চরম তৃপ্তি নেই।বৈষ্ণব কবিতায় তা প্রতিফলিত হয়েছে,
" এক তনু হইয়া মোরা রজনী গোঙাই।
   সুখের সাগরে ডুবি অবধি না পাই।।
   রজনী প্রভাত হইলে কাতর হিয়ায়।
   দেহ ছাড়ি যেন মোর প্রাণ চলে যায়।।"
ত্রুবাদারদের কন্ঠে সেই একই বেদনার সুর
" Oh would to God night might forever stay,
And my friend never again be far away,
And the watchman never spy the dawn of day !
Oh God ! Oh God ! How quickly dawn comes round.
( ওগো ভগবান,আজ রাত হোক অফুরান চির রাতি
রাত্রি থাকুক থামি,যেন আমাকে ছেড়ে না যেতে পারে আমার সাথী,
প্রহরী যেন না দেখে, দিনের প্রথম আলোর বাতি
হায় ভগবান, কেন দিবস ফিরে আসে এত দ্রুতি?)

*অনুবাদ - লেখকের।
[ঋণস্বীকার - সরোজ বন্দ্যোপাধ্যায় ]


।। কবিতাগুচ্ছ ।।

    তৈমুর খান



 মঞ্চ

 কাছাকাছি সরে এসো
 আমাদের গল্পগুলি চেয়ার টেবিল সাজাচ্ছে
 মঞ্চে শুধু আমরাই
 প্রাচীন অবাস্তবেরা চেয়ে আছে আমাদের দিকে
 তাদের করুণা ভরা চোখ ,চোখে চোখে বিগত উচ্ছ্বাস

নক্ষত্র ঝরার রাতে

 রাত বড় ভারী, গর্জনও শোনা যাচ্ছে
 সবাই আলো নিভিয়ে চুপচাপ
 আমারও কি ঘর নেই ? আলো নেই?
 স্মৃতিরা ডুব মারছে হৃদয়ে
 তুমিও কি ঘুমিয়ে পড়েছ তবে?

 নক্ষত্র ঝরার বিরাম নেই বলে
অস্পষ্ট ধূসর চরাচরে জেগে আছি একা
শব্দগুলি ফিরে আসছে দরজায় করাঘাত করে

 সিঁড়ি

 সিঁড়ি দিয়ে উঠছি আর নামছি
 উঠছি আর নামছি
 কখন সূর্য ডুবে গেল

 অন্ধকার চুমু খেতে এল
 চলো স্তব্ধতা বিছিয়ে বসি
আজ আমার অনন্ত নাম
 যে নামেই ডাকো
নীল একটি অজগর আমাদের রাস্তায় চলাফেরা করে

 সিঁড়ি কারা নির্মাণ করে গেল ?
উঠছি আর নামছি
চাঁদ নেই,
সব চাঁদ হয়ে গেছে চুরি

 শুধু বিদ্বেষের দর্প
 আলো জ্বেলে ঘুম ভাঙাচ্ছে
এই শান্ত শতাব্দীর






প্রচ্ছদ ও অলংকরণ : সুকান্ত দাস
পরিকল্পনায়: খোঁজ
 © 'খোঁজ' পরিবারের একটি প্রয়াস 'এবং খোঁজ'